তৃতীয় পর্ব

কোথায় অবন্তিপুরী; নির্বিন্ধ্যা তটিনী;

কোথা শিপ্রানদীনীরে হেরে উজ্জয়িনী

স্বমহিমচ্ছায়া– সেথা নিশিদ্বিপ্রহরে

প্রণয়চাঞ্চল্য ভুলি ভবনশিখরে

সুপ্ত পারাবত, শুধু বিরহবিকারে

রমণী বাহির হয় প্রেম-অভিসারে

সূচিভেদ্য অন্ধকারে রাজপথমাঝে

ক্বচিৎ-বিদ্যুতালোকে; কোথা সে বিরাজে

ব্রহ্মাবর্তে কুরুক্ষেত্র; কোথা কন্‌খল,

যেথা সেই জহ্নুকন্যা যৌবনচঞ্চল,

গৌরীর ভ্রুকুটিভঙ্গী করি অবহেলা

ফেনপরিহাসচ্ছলে করিতেছে খেলা

লয়ে ধূর্জটির জটা চন্দ্রকরোজ্জ্বল।

কেঁদুলি জয়দেবের ভিটে জয়দেবের মেলায় রাধাবিনোদের মন্দির ছাড়াও আছে বহু দর্শনীয় স্থান, যেমন কুশেশ্বর শিবমন্দির, কদমখন্ডির ঘাট, শ্মশান , তমালতলা এবং অজস্র আখড়া – আশ্রম । অতীতে এই সব তীর্থক্ষেত্র গুলিতে ভক্তজনের মহামিলনের সামগান রচিত হতো , যোগাযোগ গড়ে উঠত মানুষের সঙ্গে মানুষের।  জয়দেব মেলা তেমনি একটি মহামিলন ক্ষেত্র। পরবর্তীকালে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভবা পাগলার আশ্রম, অনুকূল ঠাকুরের আশ্রম , হরিদাস  আশ্রম, তিলোত্তমা আশ্রম,  সুধীর বাবার আশ্রম, তমালতলা আশ্রম, জয়কৃষ্ণ আশ্রম… এমন শতাধিক আশ্রম।  সবার উপরে আছে মহান্ত অস্থল।  আগে অর্থাৎ সরকার গ্রহণ করার পূর্বে এই মেলাটি পরিচালিত হতো মহান্ত অস্থল দ্বারাই। তাদের দোতলা মাটির যাত্রী নিবাস ছিল। পিতলের রথ ছিল, যদিও এখন তা চুরি গেছে।

 আগে মেলার মাঠে ম্যারাপ বেঁধে অনুষ্ঠান হতো। এখন পাকা বাউল মঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । স্থাপিত হয়েছে সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য ভক্তিভবন । অনেক উন্নতি হয়েছে এখনকার জয়দেব কেঁদুলি মেলার।  প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এখানেই বাউল একাডেমি ।

যদিও এই মেলার  সর্বাপেক্ষা টান বাউলেরই। তথাপি শান্তিনিকেতনেও বাউলের প্রচার ও প্রসারে নিমগ্ন হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি রক্তে মিশিয়ে নিয়েছিলেন বাউলকে। রচনা করেছিলেন কতশত বাউল সংগীত। রবি ঠাকুর নিজে উদ্যোগী হয়ে প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, ক্ষিতিমোহন সেনকে গরুর গাড়িতে করে পাঠিয়েছিলেন কেঁদুলির মেলায়। ফেরার পর তাঁদের কাছ থেকে বিবরণ শুনেছিলেন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ।

এই   উদাসী হাওয়ার পথে পথে   মুকুলগুলি ঝরে ;

     আমি  কুড়িয়ে নিয়েছি,   তোমার   চরণে দিয়েছি–

                লহো লহো করুণ করে॥

            যখন যাব চলে     ওরা     ফুটবে তোমার কোলে,

          তোমার  মালা গাঁথার আঙুলগুলি  মধুর বেদনভরে

                   যেন  আমায় স্মরণ করে॥

আসলে যে প্রাণের আনন্দে বাউল গান গাইত , শুধুমাত্র সেটারই এখন অভাব দেখাযাচ্ছে কেঁদুলির মেলায় । উদাসী হওয়ার পথে পথে গেরুয়া পোশাক এই মানুষগুলিকে আজকের মেলায় খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁরা হারিয়ে গেছেন অজয় নদের বুকে আখড়া গুলো আসার সঙ্গে সঙ্গেই।

লাগি সেই হৃদয় শশী, সদা প্রাণ হয় উদাসী, পেলে মন হতো খুশি, দিবা-নিশি দেখিতাম নয়ন ভরে।

আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে, নিভাই কেমন করে-

মরি হায়, হায় রে- ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে

(ও রে) দেখনা তোরা হৃদয় চিরে কোথায় পাব তারে,

আমার মনের মানুষ যে রে।।

 সব দ্বন্দ্ব মুছে ভিতরের আমিটিকে বাউল খুঁজে বেড়ায় বাইরের আমি সঙ্গে মিলিয়ে দেবার সাধনায়। গানই তার মন্ত্র। সহজ-সাধন । নিয়ত মনের মানুষের অনুসন্ধানে সকাল থেকে রাত হয়। এমন উদাসী বিবাগী সাধক শ্রেণীর অবলুপ্তি ঘটে গেছে ভেতরে ভেতরে । জয়দেব কেঁদুলি মেলায় এলে সেসব স্পষ্ট দেখা যায় । মদ -মাংস-  ডিম বিদেশ আর বিদেশিনী বাউলের নেশার বস্তু। ওদিকে গর্বের গলাটি হারিয়ে যাচ্ছে অকালে । কথায় সুরে উচ্চারণে সবখানেই ভাঙ্গা। সাধারণের সমতলে এসেও কন্ঠ হারালে বাউল বাঁচবে কি নিয়ে?

 সাধনা বর্জিত হয়েছে বহুদিন পূর্বেই।  এখন সংগীতের গলাটুকু হারালে মাধুকরী ভিন্ন উপায় থাকবে না। ওদিকে বাউলের জনপ্রিয় গানগুলি নানা বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী, যারা টিভিতে গায়,  সিনেমায় গায় – তাঁরা গাইছেন তাঁদের গলার প্রতিযোগিতায় দীনজীবী , ভিক্ষাজীবী বাউলেরা পেরে উঠতে পারবে ? বর্তমানে বাউল কেবলমাত্র গায়ক। সন্তান, জমিজমা, বাড়ি ,গাড়ি, বাইক নিয়ে সাধারণ । সুতরাং তাকে টিকে থাকতে গেলে এখন সুরের সাধনা করতেই হবে । পূর্ণদাস বাউল ,সনাতন দাস, লক্ষণ দাস, চিন্তামণি, দেবদাস , গোরাক্ষ্যাপা , বৈদ্যনাথ দাস , বিশ্বনাথ দাস, খাঁদু দাস, ব্রজবালা দাসী প্রমুখেরা আর কেউ নেই মঞ্চে। অনেকেই অন্যলোকে চলে গেছেন। যাঁরা আছেন তাঁদেরও অনেক বয়স হল।  সে অর্থে  দুই কার্তিক দাস , দুই নিতাই দাস , রিণা- গঙ্গাধর- তুলিকা – নিমাই করে কয়েকজনই মাত্র এখনো হাল টিকিয়ে রেখে দিয়েছেন।

জয়দেব কেঁদুলি মেলা বাউলের মেলা , কীর্তনীয়া দের মেলা,  পুণ্যার্থী তীর্থযাত্রী ভক্তের মেলা, কুটির শিল্পীদের মেলা । কেউ কেউ বলে থাকেন নবরত্ন মন্দিরের নিচে ভক্ত সাধক জয়দেব গোস্বামী পিতৃভূমি আছে। কবি তাঁর পিতৃঋণ শোধ করার জন্য ভিটা লিখে দিয়েছিলেন নিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়কে।  তারপর রাধামাধবকে বুকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন বৃন্দাবনে।

 এখনো ফুলেশ্বর ঘাটের কাছে একটি পাথর দেখিয়ে স্থানীয়রা বলেন-  এটি জয়দেবের সিদ্ধাসন । অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে বর্ধমানের কীর্তিচন্দ্রের মাতা ব্রজসুন্দরী দেবী এই মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন।  এই মন্দিরে মধ্যভাগে রাধাবিনোদ , বাঁদিকে জয়দেব এবং ডানদিকে পদ্মাবতীর মূর্তি পূজিত হয় প্রতিদিন । জনশ্রুতি আছে এখানে গীতগোবিন্দের মূল পুঁথির পাণ্ডুলিপি  সংরক্ষিত আছে।

 বল্লাল সেনের ছেলে শৈব লক্ষণ সেন ( ১১৬৯ – ১২০৫ )  গৌড়েশ্বর নাম নিয়ে বৈষ্ণব অনুরাগী হয়ে উঠেছিলেন কৃষ্ণপ্রেমিক সাধককবি জয়দেবের প্রভাবে। বর্ধমানের মহারাণী ব্রজসুন্দরী বা ব্রজকিশোরী তা সভাপন্ডিত কেঁদুলির যুগলকিশোর মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে ম্ভবত অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় দশকের কোন এক সময় মুখোপাধ্যায় পরিবারের গৃহদেবতা রাধা বিনোদ এর জন্য টেরাকোটার শোভিত নচূড়া এই সুদৃশ্য মন্দিরটি নির্মাণ করিয়ে দেন ।

কেঁদুলির তীর্থক্ষেত্র মকর উপলক্ষে একটি গ্রামীণ মেলা ছিলই , সেখানে যুক্ত হয়েছে জয়দেব পদ্মাবতী, ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়েছে। মেলায় বাউল ,কীর্তনিয়ারা এসেছে,  ভিড় বাড়িয়েছে অবশ্যই জয়দেব,  তাঁর রাধাকৃষ্ণ এবং  রাধাকৃষ্ণ প্রেমের গীতগোবিন্দ গ্রন্থ ও শ্রীচৈতন্যের গ্রন্থ সুধা পানের  পরিপ্রেক্ষিতেই। গৌণধর্মী নানান সাধক বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে এই মেলায় এসেছেন ।

জয়দেব গবেষক অজিতকুমার দাসের দাবি ছিল- মন্দিরাতেই ছিল রাজা লক্ষ্মণ সেনের তৈরি করে দেওয়া পাথরের রাধামাধব মন্দির । বর্তমানের রাধাবিনোদ মন্দির সুউচ্চ এবং বীরভূমের বিশিষ্ট টেরাকোটার কাজের অলংকৃত নবরত্ন মন্দির। অধিকারীরা রাধাবিনোদের সেবায়েত। রাধাবিনোদ প্রতিষ্ঠার পর শ্রীধাম থেকেই রাধারমণ ব্রজবাসী কেঁদুলিতে এসে বর্ধমান রাজবাড়ির সহায়তায় নিম্বার্ক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ক্রমান্বয়ে ভরত দাস, প্যারীলাল,  হীরালাল , ফুলচাঁদ, রামগোপাল, সর্বেশ্বর, দামোদরচন্দ্র, রাসবিহারী, হরিকান্ত শরণদেব আশ্রমের মোহান্ত হয়েছেন । তাঁরা মন্দিরের রথ দেখাশোনা এবং মেলা পরিচালনা করতেন। দামোদর চন্দ্র নকশাল আততায়ীদের হাতে খুন হয়েছিলেন অজয়ের চরে নকশাল আমলে।

 রাজা লক্ষ্মণ সেন কবি জয়দেবের থেকে চার বছরের বড় ছিলেন। ইতিহাস অনুসারে লক্ষ্মণ সেনের জন্ম ১১১৯ খ্রিস্টাব্দে হলে জয়দেবের জন্মসাল ১১২৩ খ্রিস্টাব্দ হবে।  তবে সে যাই হোক ,  তাঁদের মধ্যে সখ্যতা ছিল অসম্ভব।  কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে জয়দেবের জন্ম বলে মনে করেন জয়দেব অনুসন্ধান সমিতি।  ১৩৯৯  বঙ্গাব্দে সেইসূত্রে  সাড়ম্বরে কেঁদুলিতে জয়দেবের জন্মজয়ন্তী পালিত হয় । কবি জয়দেব দেহরক্ষা করেন ১২২৮ খ্রিস্টাব্দের পৌষ সংক্রান্তির দিন । সেই অর্থে দেখতে গেলে কেঁদুলিতে তাঁর মৃত্যু তিথি স্মরণেই বাউল, কীর্তনীয়া , সাধুসন্ত ,বৈরাগীদের সমাগম । বৃন্দাবনের নিম্বার্ক শ্রী শ্রী টাট্টিস্থান আশ্রমের ছেচল্লিশতম আচার্য ছিলেন জয়দেব গোস্বামী।

এইমতো মেঘরূপে ফিরি দেশে দেশে

হৃদয় ভাসিয়া চলে, উত্তরিতে শেষে

কামনার মোক্ষধাম অলকার মাঝে,

বিরহিণী প্রিয়তমা যেথায় বিরাজে

সৌন্দর্যের আদিসৃষ্টি। সেথা কে পারিত

লয়ে যেতে, তুমি ছাড়া, করি অবায়িত

লক্ষ্মীর বিলাসপুরী– অমর ভুবনে!

অনন্ত বসন্তে যেথা নিত্য পুষ্পবনে

নিত্য চন্দ্রালোকে, ইন্দ্রনীলশৈলমূলে

সুবর্ণসরোজফুল্ল সরোবরকূলে

মণিহর্ম্যে অসীম সম্পদে নিমগনা

কাঁদিতেছে একাকিনী বিরহবেদনা।

আসলে জয়দেব, তাঁর জন্ম তিথি, সাল কি মাস , বছর কি দিন , জন্মস্থান নিয়ে বহু বিতর্ক আছে। বিতর্ক আছে কারণ আমরা হিন্দুরা , বাঙ্গালীরা সত্য উদ্ঘাটনের নিমিত্ত চরম থেকে চরমতম প্রচেষ্টা চালাই নি। যাই হোক তবু আজও লক্ষ লক্ষ লোক সমস্ত কিছুকে অগ্রাহ্য করে পৌষ সংক্রান্তি ,  পয়লা মাঘ এবং বন্ধু পরাশরের ( জয়দেব) স্মৃতিতে  তিনদিনের মিলিত হন অজয়ের চরে।  এমন লক্ষ লোকের গ্রামীণ সমাবেশে ভারতের গঙ্গাসাগর ভিন্ন অন্য কোথাও দেখা যায়না ।

যদি মনের মানুষকে ধরতে হয় ,  যদি মনের মত মানুষকে খুঁজে পেতে হয় তাহলে জয়দেবের কেঁদুলির মেলায় একবার নয় বারবার আসতে হয় । রাত জাগতে হয়। হরিদাস আশ্রম, তমাল তলা, মনের মানুষ আখড়া, শ্যামসখা প্রভৃতি আশ্রম ঘুরে দেখতেই হয়।কবি, গায়ক, বাউল, লেখক এঁরা বড় কাছাকাছি।  এই মেলায় এসেছেন গবেষক সুধীর চক্রবর্তীর,  দেবাশীষ দাশগুপ্ত , প্রশান্ত রায় , অতনু নাগ প্রমুখরা। আশানন্দ চট্টরাজকে জয়দেব মেলার নীলকন্ঠ পাখি বলা হতো । অমিত গুপ্ত ও শকুন্তলা পত্রিকা এক অনন্য অঙ্গ মেলার।  পবনদাস বাউলের আর গৌর ক্ষ্যাপার জন্য অমিত গুপ্ত এবং দীপক মজুমদারের আত্মত্যাগ কোনো দিন ভোলা যাবে না। সে মেলা আজ আর নেই।  তবে অজয় নদের কূলে ও কিনারায় কবি জয়দেবের সঙ্গে বাউল – কীর্তনিয়া আর মহামিলনের তীর্থটি রয়ে গেছে।

মুক্ত বাতায়ন হতে যায় তারে দেখা

শয্যাপ্রান্তে লীনতনু ক্ষীণ শশীরেখা

পূর্বগগনের মূলে যেন অস্তপ্রায়।

কবি, তব মন্ত্রে আজি মুক্ত হয়ে যায়

রুদ্ধ এই হৃদয়ের বন্ধনের ব্যথা;

লভিয়াছি বিরহের স্বর্গলোক, যেথা

চিরনিশি যাপিতেছে বিরহিণী প্রিয়া

অনন্তসৌন্দর্যমাঝে একাকী জাগিয়া।

আবার হারায়ে যায়– হেরি চারি ধার

বৃষ্টি পড়ে অবিশ্রাম; ঘনায়ে আঁধার

আসিছে নির্জননিশা; প্রান্তরের শেষে

কেঁদে চলিয়াছে বায়ূ অকূল-উদ্দেশে।

ভাবিতেছি অর্ধরাত্রি অনিদ্রনয়ান,

কে দিয়েছে হেন শাপ, কেন ব্যবধান?

কেন ঊর্ধ্বে চেয়ে কাঁদে রুদ্ধ মনোরথ?

কেন প্রেম আপনার নাহি পায় পথ?

সশরীরে কোন্‌ নর গেছে সেইখানে,

মানসসরসীতীরে বিরহশয়ানে,

রবিহীন মণিদীপ্ত প্রদোষের দেশে

জগতের নদী গিরি সকলের শেষে।

 সমাপ্ত

© দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ ১. জয়দেব কেঁদুলির মেলা

২. গীতগোবিন্দম্

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.