সংখ্যার একটু এদিক ওদিক হলেই রিসর্ট রাজনীতিতে প্রচুর স্যানিটাইজার খরচ হতে পারে

এর মধ্যেই আসতে শুরু করেছে ভোটগণনার প্রাথমিক গতিপ্রকৃতি। কোভিড পরিস্থিতিতে এ বার গণনার গতি কিছুটা শ্লথ হওয়াই স্বাভাবিক। ফলে বিকেলের মধ্যে যে রকম অন্যান্য বার ফল পুরোপুরি জানা হয়ে যায়, এ বার তেমনটা না হওয়ার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। হয়তো সন্ধের দিকে পরিষ্কার হয়ে যাবে চিত্রটা। যে হেতু এখনও ভোটের ফল আমাদের হাতে আসেনি, তাই সমীক্ষাভিত্তিক সামান্য আলোচনার সুযোগ নেওয়া যাক। এর মধ্যেই জানা শুরু হয়েছে পোস্টাল ব্যালট সংক্রান্ত পরিসংখ্যান। তাতে সামান্য কিছুটা এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল। তবে এর থেকে সামগ্রিক ভোটফল বোঝার চেষ্টা না করাই ভাল।

বেশ কয়েকটি সংস্থার নির্বাচনের আগের জনমত বিশ্লেষণ এবং সাম্প্রতিক বুথফেরত সমীক্ষা থেকে যে সম্ভাব্য প্রবণতা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ক্ষমতাসীন তৃণমূল এবং প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপি-র মধ্যে লড়াই হাড্ডাহাড্ডি। তুলনায় বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি এক করে তৃতীয় পক্ষকে কেউ খুব একটা বেশি আসন দিচ্ছেন না। সব ক’টি জনমতের গড় হিসেবের দিকে নজর রাখলে আসনের হিসেবে সামান্য এগিয়ে থাকছে তৃণমূল। তবে সকলেই জানেন সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে থেকে এবং সংবিধানকে মান্যতা দিয়ে কী ভাবে অন্যদলের নির্বাচিত বিধায়কদের নিজের দিকে টেনে আনা যায়। সে রকম হলে এ বারের রিসর্ট রাজনীতিতে প্রচুর স্যানিটাইজার খরচ হতে পারে। সেই প্রেক্ষিতে এ বার এ কথা বারবার আলোচিত হচ্ছে যে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও তৃণমূল ভেঙে কিছু বিধায়ক চলে যেতে পারেন বিজেপি-র দিকে।

আপাতত ২৯৪ এর মধ্যে ২৯২টি আসনের ফল ঘোষণা হবে। কোভিড পরিস্থিতিতে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে নির্বাচনের আগেই প্রয়াত হয়েছেন দুই প্রার্থী। সেখানে নির্বাচন হয়নি। নির্বাচনের পরেও এক প্রার্থীর জীবনাবসান হয়েছে, তবে সেখানে গণনা চলবে। এ কথা মানতেই হবে যে এই কালবেলা নির্বাচনের রঙ-রস শুষে নিয়েছে অনেকটা। তবু পরিস্থিতি যে জায়গায়, তাতে ১৮০-র বেশি আসন পেলে তৃণমূল থেকে বিজেপি-র পক্ষে লোক ভাঙানো মুশকিল। অন্য দিকে বিজেপি যদি ১২০-তে পৌঁছে যায়, সে ক্ষেত্রে বাকি ২০-৩০টি আসন জোগাড় করলেই শাসক বদলে যাবে। তখন তৃণমূল সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে বারবার। মোটের উপর এই দুই সংখ্যায় আমাদের নজর থাকবে। এক, তৃণমূল ১৮০-র কোন দিকে থাকে, এবং দুই, বিজেপি ১২০-র কোন দিকে থাকে। তৃতীয় ফ্রন্টের কথা এখানে একবার ছুঁয়ে যাওয়া যাক। নির্বাচনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই আলোচনা উঠে এসেছে যে বেশ কিছু উজ্জ্বল এবং শিক্ষিত যুবক-যুবতীকে প্রার্থী হিসেবে বেছেছেন তারা। তবে নির্বাচনে আসন জয়ের অঙ্কে তা কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে সেটা আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বোঝা যাবে। মোটের ওপর ২০-র আশেপাশে এই জোট পৌঁছতে পারবে বলে আভাস দিয়েছে সমীক্ষাগুলি। বিশেষ করে তৃণমূল এবং বিজেপি-র তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যদি কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, সে ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যেতে পারে এই অল্প কটি আসনও। আর কোনও ভাবে যদি এই জোট ৪০-এর কাছে পৌঁছে যায়, তা হলে কিন্তু এ বারের নির্বাচন অনেক ওলটপালট দেখবে।

সমীক্ষার খবর তো দেওয়া গেল। এ বার সামান্য আলোচনা করা যাক বিষয়টার পক্ষে-বিপক্ষে। সমীক্ষা রাশিবিজ্ঞানের অত্যন্ত পরিণত একটি পদ্ধতি। সঠিক সমীক্ষায় ফলাফলের দিকনির্দেশ পাওয়া সম্ভব, এবং খুব কমানো যেতে পারে ভুলের মাত্রা। তবে ভোট শতাংশের হিসেবে তিন শতাংশের মত গোলমাল অনেক সময় হয়েই যায়। তাই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই সমীক্ষায় বোঝা গেলেও, সে ক্ষেত্রে আসনের হিসেবে কে জিতবে তা বলা অসম্ভব। সেই অনিশ্চয়তা বিজ্ঞানেরই অংশ। তবে সমীক্ষা করতে প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ, মাঠে নেমে কাজ করার মত প্রশিক্ষিত কর্মী, এবং অর্থ। সেগুলি যদি না থাকে তা হলে সমীক্ষার বিশেষ অর্থ হয় না। সে ফলাফল যদৃচ্ছ বা র‍্যানডম। সেখানে নির্বাচনী ফল মেলা বা না মেলায় হাততালি কিংবা ধমক থাকতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞান নেই। আর সে দোষ রাশিবিজ্ঞানের নয়। তবে সমীক্ষার একটি বড় অবদান থাকে বিনোদনে। আর বিনোদনের সাফল্য সঠিক পরিসংখ্যানের সঙ্গে সমানুপাতে বিরাজ করে না। তাই মনের মাধুরী মেশানো সমীক্ষার সঙ্গে পছন্দের রাজনৈতিক দলের জয়ের সম্ভাবনা মিলে গেলে ভালই লাগেই। উল্টো ফলে জন্মায় বিরক্তি। তবে মোটের ওপর ক্রিকেটের মতই রাজনীতির সংখ্যা দেখতে পছন্দ করেন ভোটরসিক বাঙালি। আজকে বিশ্বজুড়ে অন্তত ১০ কোটি পূর্ণবয়স্ক বঙ্গভাষাভাষী যে এই ফলাফলের দিকে নজর রাখছেন তা নিশ্চিত। সেই হিসেবে এই নির্বাচনে সমীক্ষা মিলুক কি না মিলুক কিচ্ছু যায় আসে না। তা নিয়ে উৎসাহ প্রচুর, এবং সোজা কথায় এর একটা বাজার আছে।

নির্বাচনে শাসক নির্ধারণের মতই গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ কিছু আসনের ফলাফল। সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত আসনভিত্তিক সমীক্ষার কিছু ফল এই প্রসঙ্গে পেশ করা যাক। এই নির্বাচনের ডার্বি অবশ্যই নন্দীগ্রাম। সমীক্ষা বলেছে লড়াই হাড্ডাহাড্ডি, তবে শুভেন্দু অধিকারীর থেকে নাকি সামান্য এগিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিপিএমের মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায় কত ভোট পাচ্ছেন সে দিকেও নজর থাকবে সকলের। এ রকম আরও কিছু আসন রয়েছে। তার মধ্যে বিধাননগর অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সব্যসাচী দত্ত বনাম সুজিত বসু। লড়াই হাড্ডাহাড্ডি, তবে সমীক্ষায় সামান্য এগিয়ে বিজেপি-র সব্যসাচী। দমদমে ত্রিমুখী লড়াই। তৃণমূলের ব্রাত্য বসু, বিজেপি-র বিমলশঙ্কর নন্দ, সিপিএমের পলাশ দাস। সমীক্ষায় সামনে ব্রাত্য। গত কয়েকবছর ধরে বামফ্রন্টের উজ্জ্বল প্রতিনিধি শতরূপ ঘোষ। সমীক্ষা বলছে সেই কেন্দ্র কসবায় এগিয়ে তৃণমূলের জাভেদ খান। সেখানে বিজেপি-র প্রার্থী ইন্দ্রনীল খান। টালিগঞ্জও জমজমাট, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃণমূলের অরূপ বিশ্বাস, বিজেপি-র বাবুল সুপ্রিয় এবং সিপিএমের দেবদূত ঘোষ। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইতে সমীক্ষার ফলে সামান্য এগিয়ে অরূপ বিশ্বাস। যাদবপুর নিয়েও উত্তেজনা তুঙ্গে, এখানে সিপিএমের প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী, বিজেপি-র (সিপিএম ত্যাগী) রিঙ্কু নস্কর। সমীক্ষা বলছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইতে সামান্য পা বাড়িয়ে তৃণমূল প্রার্থী দেবব্রত মজুমদার। এমন জমজমাট আসনের সংখ্যা প্রচুর।

তবে এই মুহূর্তে আমরা বিশেষ ভাবে তিনটি আসন নিয়ে আলোচনা করব, যার মধ্যে প্রথমটি যাদবপুর। দুই হল বালি, যেখানে প্রার্থী বিজেপি প্রার্থী (তৃণমূল থেকে আসা) বৈশালী ডালমিয়া, তৃণমূলের চিকিৎসক রানা চট্টোপাধ্যায় এবং সিপিএমের জেএনইউ থেকে পড়া বালির লড়াকু নেত্রী দীপ্সিতা ধর। তিন, উত্তর দমদম, যেখানে সিপিএমের প্রার্থী গত বিধানসভায় জয়ী তন্ময় ভট্টাচার্য, তৃণমূল মন্ত্রীসভার সদস্য চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং বিজেপি-র অর্চনা মজুমদার। এই তিন জায়গাতেই দুর্দান্ত ত্রিমুখী লড়াই। সমীক্ষা বলছে শেষের দু’টিতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলেও নাকি সামান্য এগিয়ে বিজেপি। এই দু’টি আসনই যাদবপুরের (দক্ষিণে) মতই কলকাতার উপকণ্ঠে (উত্তরে) এবং এখানে যে ধরনের ফলাফল হবে তা কিন্তু শহরতলির বহু আসনে প্রতিফলিত হতে পারে। বিশেষ ভাবে গোটা রাজ্যে অন্তত ৫০টি আসন আছে যেখানে লড়াই ত্রিমুখী, এবং অনেকটা একই বৈশিষ্ট্যের। আর এই তিন জায়গাতেই যা বিশেষ ভাবে লক্ষ করার মতো তা হল, বিজেপি প্রার্থীরা কিন্তু ততটা হেভিওয়েট নন। তা সত্ত্বেও এই জায়গাগুলোতে যদি বিজেপি প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানে চলে আসে তা হলে বুঝতে হবে শহরাঞ্চলে তাদের ভালো ফল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সিপিএমের ক্ষেত্রে এই তিনটি আসনে জয় তাদের জোটকে ৩০-এর ওপরে পৌঁছে দেওয়ার সম্ভাবনা জোরাল করবে। একইরকম ভাবে আবার ক্ষমতায় ফিরতে হলে তৃণমূলকেও কিন্তু একেবারে সামনে থাকতে হবে এই তিন আসনে।

কলকাতার বাইরে নজর থাকবে মুর্শিদাবাদে। তৃণমূলের এখানে ভাল ফলের সম্ভাবনার কথা বলছেন অনেকে। সে ক্ষেত্রে কংগ্রেসের আসন যদি কমে, তখন জোটের পক্ষে ভাল ফল করা মুশকিল। আর অধীর চৌধুরী নিজের ঘর ধরে রাখতে পারলে জোট ২০ পার করার সম্ভাবনা প্রবল। দুই মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রামে লক্ষ করার বিষয়, শুভেন্দুর প্রভাব। এখানে তৃণমূল এবং বিজেপি-র মধ্যে যে এগোবে তার গোটা রাজ্যে প্রভাব বাড়বে অনেকটা। সিপিএমের সুশান্ত ঘোষের আসনের দিকেও নজর থাকবে অনেকের। রাজ্যের উত্তরে শিলিগুড়িতেও জমজমাট ত্রিমুখী লড়াই। সেখানে সিপিএমের বর্তমান বিধায়ক অশোক ভট্টাচার্য, বিজেপি-র (সদ্য সিপিএম ত্যাগী) শঙ্কর ঘোষ এবং তৃণমূলের (বেশ কিছুদিন আগে কংগ্রেস থেকে আসা) অধ্যাপক ওমপ্রকাশ মিশ্র। আব্বাস সিদ্দিকির আইএসএফ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ভাঙড়ের দিকে নজর রাখতে হবে। সেখানে তৃণমূল বনাম আইএসএফ লড়াই জমজমাট বলে মনে করছেন অনেকে। আপাতত এইটুকুই থাক। দুপুর ১২টা নাগাদ চিত্রটা সামান্য বোঝা গেলে ফের আলোচনা করব আমরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.