কলকাতা, ১২ জুন (হি স)। রাজনীতি থেকে নীতি কথাটা কি খসে পড়েছে? আদর্শ বলে কোনও বিশেষণ কি রাজনীতির অভিধানে আর থাকবে না? এ রকম নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে জনমানসে। জর্জ বার্নার্ড শ, বলেছিলেন ‘রাজনীতি হচ্ছে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষদের শেষ আশ্রয়’। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, বহু দিন আগের ওই আপ্তবাক্য কি পূর্ণতা পাচ্ছে হালফিলের রাজনীতিতে?
১৯৮৯ থেকে ’৯৬— ৭ বছর সাংসদ ছিলেন প্রাক্তন অধ্যাপিকা মালিনী ভট্টাচার্য। সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সর্বভারতীয় সভানেত্রী। ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-কে বলেন, “বর্তমানে আমরা এদেশে যে স্যাঙাতি পুঁজিবাদ বা ক্রোনি ক্যাপিটালিজ্মের রমরমা দেখছি তার সূত্রপাত হয়তো কমবেশি কুড়ি বছর আগে। নয়া উদারবাদের এক আবশ্যিক শর্ত হিসাবে। এই অধঃপতিত রাজনীতির শুরু সেখানে। সেটা স্বাধীনতার যুগের আদর্শের শ্মশানশয্যা। যারা অর্থনীতি চালাবে রাজনীতির প্রভুরা তাদের সঙ্গে যোগসাজসে রাজ্য চালাবে। সেখানে রাজনীতিতে আদর্শ বজায় থাকবে কীকরে?
আজ কার্টুনিস্ট মঞ্জুলের ঘটনা দেখাচ্ছে এর বিনিময়ে তাদের ফ্যাসিস্ট আচরণকে কর্পোরেট মুনাফাবাজরাও সমর্থন করবে। এভাবেই যেখানে গণতন্ত্র খতম হয় সেখানে এমনকী সরকারি নানা প্রকল্প যা জনগণের টাকায় জনগণের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে চালু হয় সেগুলোও প্রচারিত হয় কিন্তু সরকারি সদাশয়তার উদাহরণ হিসাবে কেন্দ্র-রাজ্যতে কুৎসিত দড়ি টানাটানি চলে তাই নিয়ে। সেখানেই বা নীতি কোথায়? মানুষের প্রয়োজন কি লেশমাত্র সম্মান পায় সেখানে? মানুষ কী করবে? যতই বীতশ্রদ্ধ হোক এটা না মানলে সে তো বাঁচবে না। তাকে এতে কিছুটা অভ্যস্তও হয়ে যেতে হয়। তার আত্মসম্মানের কথা তাকে ভুলতে হয়। ক্ষমতার কাছে নতিস্বীকার করতে হয়। তাই যে মানুষ ভোট দিল তাকে তাচ্ছিল্য করেই অক্লেশে দলবদলও করা যায়।“
রাজনীতির চালচিত্রের বদল প্রসঙ্গে বরিষ্ঠ সাংবাদিক পুলকেশ ঘোষ এই প্রতিবেদককে জানালেন, “খেলে ফেরার পথে একদিন দেওয়ালে লেখা একটা ছড়ায় চোখ আটকে গিয়েছিল। ‘বাজারেতে বেগুন কিনে হলাম প্রফুল্ল/ বাড়িতে এসে কেটে দেখি কানা অতুল্য’। বাড়িতে মুখেও বোধহয় একমনে সেটাই আউড়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ গালে এসে পড়ল সপাটে একটা চড়। ছিটকে পড়লাম। দেখি, বাবা গজরাচ্ছেন। ছি ছি, ছোট থেকেই এসব খারাপ কথা! বাড়ির নাম ডোবাবে এই কুলাঙ্গার।
কে প্রফুল্ল, কেই বা অতুল্য জানার বয়স হয়নি তখন। অনেক পরে এই দুজনের সান্নিধ্য পেয়ে যখন পিতৃপরিচয় দিয়েছি, তখন তাঁদের চোখমুখের অভিব্যক্তি থেকে বুঝেছি রাজনীতির মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হয়।“
পুলকেশবাবুর কথায়, “আমার বাড়ি আদ্যন্ত রাজনৈতিক বাড়ি। বাবা বিজয়কৃষ্ণ ঘোষ ছিলেন ব্রিটিশ জেলাশাসক বার্জ হত্যা মামলার অন্যতম আসামী। স্বাধীন দেশে একনিষ্ঠ গান্ধীবাদী এই মানুষটিকে আজীবন এক ঘণ্টার জন্যও খদ্দর ছাড়া অন্য কিছু পরানো যায়নি। কথা আর আচরণে ফারাক হওয়া কিছুতেই চলবে না।
বাবা ছিলেন মেদিনীপুর জেলা ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। প্রফুল্ল সেন যখন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি, বাবা তখন জেলার সম্পাদক। আমাদের বাড়িতে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, মায়া রায় থেকে তাবড় নেতারা আসতেন। আমি রোজ বাবার সঙ্গে শহরের মাণিকপুরে কংগ্রেস ভবনে যেতাম। একতলায় খেলে বেড়াতাম। ওই ভবনে একতলায় দলের নিজস্ব প্রেস ছিল। সাপ্তাহিক কাগজ ফেলতো। নাম- মেদিনীপুর। সেখান থেকেই শেখা- রাজনীতি একটা আদর্শ, যা সারাজীবন ধরে আচরণ করতে হয়। সে সময় নির্বাচন এলেই বাড়িতে উৎসব। কয়েকশ কাপ চা হতো রোজ। সবাই পুরনো খবরের কাগজে লাল ও নীল বড়ি গোলা কালিতে পোস্টার লেখা হতো। অল্প কিছু পোস্টার ওই প্রেসে ছাপানো হতো। নতুন কালির সেই গন্ধ আজো পাই। আসলে বাবাকে তো কখনও ভবন বদল করতে দেখিনি। তাই ওটাই ছিল পরিবার। এখনকার রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে নিতে তাই বড় অসুবিধা হয়।“
বামেরা দাবি করে, রাজনীতির অধঃপতন ত্বরান্বিত হয়েছে দক্ষিণপন্থীদের জন্য। মালিনী ভট্টাচার্য অবশ্য এই প্রতিবেদককে বলেন, “আমি মনে করি না বামপন্থী দলে থাকাটাই এই অধঃপতনের বিরুদ্ধে অমোঘ রক্ষাকবচ। মানুষকে তার মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে ব্যবস্থাটাকে পাল্টানোই আমার উদ্দেশ্য হলে আমাকে প্রতি মূহূর্তে নিজের সঙ্গে এই লড়াইটা লড়তে হবে। ভাবতে হবে এর কাছে আমি আত্মসমর্পণ করব না। যাঁরা বামপন্থী আছেন এবং বামপন্থী থাকছেন এই লড়াই করেই তাঁদের বেঁচে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু স্যাঙাতি পুঁজিবাদের ফ্যাসিবাদী বিবর্তনের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের লড়াইটা তো একক লড়াই হতে পারে না। অন্যদের একত্র করেই তা হতে পারে। দলবদল করানোর জন্য আমি অন্যের নিন্দা করলাম, কিন্তু নিজে একই কাজ করে সেটাকে বিরাট উদারতার লক্ষণ বলে প্রচার করলাম এই অসততা ফ্যাসিবাদকেই শক্তি জোগাবে। তার সঙ্গে আপস প্রকৃত বামপন্থীরা কখনো করতে পারবে না।“
বিশিষ্ট নাট্যকার, ১৯৮০ সালে সঙ্গীত নাটক একাদেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত (সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার) রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত অবশ্য মনে করেন না নীতিহীনতা থেকে বামপন্থীরা মুক্ত। তাঁর কথায়, “ওপরে দেখে ওরকম মনে হতে পারে। ভিতরে অনেকটাই এক। আর রাজনীতিতে সুবিধাবাদ আগেও ছিল।“
গত শতকে পাঁচের দশকের শেষদিকে বেশ কিছুকাল বাম ছাত্র সংগঠনের কর্মকর্তা ছিলেন রুদ্রপ্রসাদবাবু। এই প্রতিবেদককে বললেন, “তখনও ক্ষমতায় থাকার প্রবণতা দেখেছি। এর জন্য ‘দাদা’-দের ধরতে হত। ক্ষমতায় যিনি আসতেন, নিজের মত বদল করতেন। উনিশ বিশ। নীতিহীনতাও আজকের নতুন ব্যাপার নয়। ব্রেখটের ‘লাইফ অফ গ্যালেলিও’-র একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ছে। একদিন গ্যালেলিওকে তাঁর পরিচিত একজন বললেন হল্যান্ডে একটা জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে যেটায় দূরের জিনিস কাছে দেখা যায়। জিনিসটার বর্ণনা শুনে গালিলিও ওরকম একটা যন্ত্র আবিস্কার করলেন। ঘরোয়া এক অনুষ্ঠানে বাচ্চা ডিউককে সেটি উপহার দিলেন। বললেন, খ্রিষ্টিয় নীতি মেনে ১৭ বছর ধরে গবেষণা করে এটা আবিস্কার করেছি। যাঁর বর্ণনা শুনে গালিলিও ওটি তৈরি করেছেন, একটু দূরে মিটিমিটি হাসছিল। তাঁর হাত ধরে গালিলিও বললেন, ‘আমি কিন্তু ওটায় কিছু বদলও করেছি।’ তাই নীতিহীনতা কি, কতটা এসব খুব গোলমেলে ব্যাপার।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি হয়েও ভারতের এবং এ রাজ্যের রাজনৈতিক হালচালের ওপর বরাবরই নজর অলোক সরকারের। ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-কে জানালেন, “আমি ১৯৭৯- ১৯৯৮ পর্যন্ত নিউইয়র্কে ছিলাম। আমি যখন ওখানে যাই তখন জিমি কার্টার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত রেগান পর পর দু’বার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯২ জর্জ বুশ (সিনিয়র) প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তারপর ১৯৯২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বিল ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সুতরাং, জিমি কার্টারকে বাদ দিয়ে আমি পাঁচটি প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশন দেখেছি। আমি ওখানে কোনও দিন কাউকে নোংরা রাজনীতি করতে দেখিনি। সত্যি কথা বলতে গেলে ওখানকার মানুষরা এখানকার মানুষদের চেয়ে রাজনৈতিক ভাবে অনেক বেশি শিক্ষিত এবং সচেতন। ওরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে খুব বেশি সতর্ক। ওখানে মানুষকে বোকা বানিয়ে ভোটে জেতা যায়না, জিতলেও তাকে টেনে নামাতে ওদের সময় লাগে না।“
অলোকবাবুর মতে, “আমেরিকানরা নিজেদের চরিত্র নিয়ে মাথা ঘামায় না, কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের চরিত্র সম্বন্ধে অতি মাত্রায় সজাগ। ১৯৮৮ সালের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। গ্যারি হার্ট ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। হঠাৎ খবর বেরলো যে উনি কোন একসময়ে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে একটি কল গার্লের সেবা নিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আগুন জ্বলে উঠলো, ভোটাররা ওনাকে নমিনেশন তুলে নিতে বাধ্য করলেন। একেই বলে হিউম্যান রাইটস। আমি আমার কয়েকজন আমেরিকান বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা নিজেরা যে শুদ্ধতা নিয়ে মাথা ঘামাও না, তাহলে গ্যারি হার্টের বেলায় এরকম করলে কেন? উত্তর পেলাম, আমরা সাধারণ নাগরিক, আমরা যা খুশি করতে পারি, কিন্তু আমাদের নেতা কখনও চরিত্রহীন হতে পারেন না। আমি অবাক হয়েছিলাম। রাজা রামের কথা মনে পড়েছিল, উনি বলেছিলেন, আমার রাজত্বে আমি ছাড়া সবাই স্বাধীন। একেই বলে সভ্যতা, একেই বলে রাজনীতি। এছাড়া আমেরিকায় ভোটের আগে পার্টি কনভেনশন ও দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে ডিবেট হতে দেখেছি। কোন ঝগড়া নয়, গালাগালি নয়, একসাথে চিৎকার নয়। সভ্যভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপায় বলছেন, সাংবাদিক ও বিশিষ্টজনেরা প্রশ্ন করছেন, ওনারা শান্তভাবে উত্তর দিচ্ছেন। রাস্তায়, বাড়ির দেওয়ালে কোন ব্যানার কোনদিন দেখিনি। সভ্যদেশে নির্বাচন কিভাবে হয় সেটা জানতে বুঝতে গেলে আমেরিকায় গিয়ে ওখানকার নির্বাচন দেখতে হবে।“
সত্যিই ’পলিটিক্স ইজ দ্য লাস্ট রিসর্ট ফর দ্য স্কাউন্ড্রেলস’, কিনা তা বিচার করবে মহাকাল। তবে সমালোচকের মুখে ছাই দিয়ে রাজনীতি এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে নিজের পথে, নিজের গতিতেই। তার মধ্যে নীতি থাকুক বা না থাকুক।
অশোক সেনগুপ্ত
http://bengali.hindusthansamachar.in/NewsDetail?q=c0b2753394b70c2857cbb3538feee99f