ইসরায়েল ও ভারতের মৈত্রী ক্রমশঃ এক উল্লেখযোগ্য মাত্রা নিচ্ছে। এই দুই দেশ একে অপরের পরিপূরক হওয়ার দিকেই এগোচ্ছে।
ইসরায়েলে দেশটার প্রথম ডিজিটাল ব্যাঙ্ক তৈরী হল। আর এটা তৈরী করেছে ভারতের Tata Consultancy Services (TCS). গুজরাটের আমূল কোম্পানি তার গবাদি পশুদের স্বাস্থ্য নিয়ে সমস্যায় পড়লে তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল কিবুটজ বেইরোট ইতজাক। তাদের সাহায্যের ফলে দুধের ফলনও অনেক পরিমানে বেড়ে যায়। অন্যদিকে এই কিবুটজের তরুণ ক্রিকেটাররা ভারতের থেকেই ক্রিকেটের ট্রেনিং পায়।
বৈদ্যুতিক ব্যাটারি তৈরীর ইসরায়েলী স্টার্ট-আপ ফিনার্জি ভারতকে হালকা এবং নিষ্পত্তিযোগ্য ব্যাটারি তৈরি করার জন্য প্রচুর পরিমাণে অ্যালুমিনিয়ামের মজুদ করতে সাহায্য করছে৷ উত্তরাখণ্ডের ধীরেন্দ্র কুমার
ইসরায়েলের রাজধানীতে কৃষি গবেষণা সংস্থা (এআরও) তে টমেটোর একটি তাপ-সহনশীল ট্রান্সজেনিক জাত উদ্ভাবন করেছেন। শুধু ধীরেন্দ্রকুমারই নন‚ ইসরায়েলের এই কৃষি ইনস্টিটিউটের পোস্ট-ডক্টরাল গবেষকদের ৮০ শতাংশই ভারতীয়।
ভারত এবং ইসরায়েল তাদের আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের ৩০ বছর উদযাপন করার সময় – রাষ্ট্রদূত নাওর গিলন ২৯ শে জানুয়ারী হিন্দিতে একটি বার্তা দিয়েছিলেন যেখানে তিনি উভয়ের মানুষের মধ্যে “প্যায়ার এবং গেহরি দোস্তি” (প্রেম এবং গভীর বন্ধুত্ব) সম্পর্কের কথা বলেছিলেন। জাতিদুটির মধ্যে একটি শান্ত ঐক্যমত রয়েছে। এখনই সময় উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।
ভারত, ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত I2U2 গ্রুপটিও গত বছর এই কথা বলেছিল। গত বছরের 14 জুলাই চারটি দেশ দ্বারা প্রকাশিত একটি যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে তারা “জল, জ্বালানি, পরিবহন, মহাকাশ, স্বাস্থ্য এবং খাদ্য নিরাপত্তায় যৌথ বিনিয়োগ এবং নতুন উদ্যোগ” এ সহযোগিতা করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে।
২০২১ সালে, ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন লিমিটেড (ইন্ডিয়ান অয়েল) এবং হাইব্রিড লিথিয়াম-আয়ন এবং অ্যালুমিনিয়াম-এয়ার/জিঙ্ক-এয়ার ব্যাটারি সিস্টেমে বিশেষজ্ঞ একটি ইসরায়েলি স্টার্ট-আপ
ফিনার্জি, একটি যৌথ উদ্যোগ (IOC Phinergy প্রাইভেট লিমিটেড) স্থাপন করেছে। এটি পরিবেশ বান্ধব বৈদ্যুতিক ব্যাটারি তৈরি করতে ভারতে প্রচুর অ্যালুমিনিয়াম ব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেছে। এছাড়াও ফিনার্জি আদিত্য বিড়লা গ্রুপের সাথে একটি চুক্তিও করেছে।
বাতাসের আর্দ্রতা থেকে জল উৎপাদন করার সংস্থা ওয়াটারজেন ইতিমধ্যেই আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের কাছে জেনি ইউনিট বিক্রি করেছে৷ আইটিসি, তাজ, জিএমআর এবং ম্যাক্স, এবং উচ্চ আর্দ্রতা যুক্ত শহরগুলিতে অবস্থিত ভারতীয় সংস্থাগুলির সাথে তারা আলোচনাও করছে৷ এটা টেথিসের ডেভলপারদের মতোই একটি সিস্টেম যা সৌরশক্তির সাহায্যে জলের থেকে লবন সহ সমস্ত দূষককে পরিশোধন করে দেয়। তেল আবিবের আফেকা কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং স্কুল অফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রধান ডঃ মোশে শুভা একটি ভারতীয় স্কুলে তার প্ল্যান্ট স্থাপন করতে চেয়েছেন।
এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ( যার হিব্রু অ্যাক্রোনিম মাশভ) ভারতের বিভিন্ন অংশে কৃষি, দুগ্ধ ও উদ্যানপালনের ক্ষেত্রে ৩০ টি উৎকর্ষ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। একজন সংস্থার প্রতিনিধি বলেছেন যে তাদের কাছে ভারতের গুরুত্ব বোঝা যায় এর থেকে যে‚ তাদের ছয়জন জল বিশেষজ্ঞের মধ্যে একজন অবশ্যই ভারতীয়।
মিজোরামের আকারের এই ছোট্ট দেশটিতে প্রতি বছর কমবেশি ৮০০ ভারতীয় শিক্ষার্থী যায়।
বিহারের বাবুয়ার নরসিংহ রাও নিরালা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খুব প্রাথমিক পর্যায়ে গবাদি পশুর রোগ নির্ণয় করতে সক্ষম এমন একটি
বায়ো সেন্সরের জন্য পেটেন্ট দাখিল করেছেন। পালমপুরের অনিতা কুমারী ARO, ভলকানী সেন্টারে যখন পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক হিসেবে এসেছিলেন তখন তার মেয়ে তিন বছরের শিশু ছিল। আজ তার মেয়ে তার স্বামীর সাথে হিমাচল প্রদেশে থাকে। কিন্তু অনিতা সেখানেই তার কাজ চালিয়ে যেতে আগ্রহী, কারণ সে উদ্ভিদের ছত্রাকের চিকিৎসায় প্রায় সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। তিনি পোস্ট-ডক্টরাল রিসার্চ ফেলোশিপের মাধ্যমে সেখানে গিয়েছিলেন।
ভলক্যানিক সেন্টারের মুখপত্রের মতে প্রতি বছর বেশিরভাগ প্রার্থী শিক্ষাগত যোগ্যতার বিচারে ভারত থেকেই আসে। যদিও সেখানে প্রতি মাসে ৮৫০০ শেকেল ( ভারতীয় টাকায় ২ লাখ মতো ) করে দুই বছরের জন্যে দেওয়া হয়‚ কিন্তু তবুও তাদের বেশিরভাগই অন্য জায়গা থেকে ফান্ড পেয়ে যায়। যেমন উদাহরণ দেওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের তাপ-সহনশীল ট্রান্সজেনিক টমেটো তৈরী করা পবন কুমার মিকাল লিবারহান-লাজারোভিচ ল্যাব এর থেকে ফান্ড পাচ্ছেন।
বহুদিন ধরেই ইসরায়েলি যুবকরা ভারতে যাচ্ছে সামরিক ট্রেনিং নিতে। সে দেশের স্থানীয় ভাষায় তাদের ইন্দো বলা হয়। তেল আবিবের ইজরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ-এর মার্কেটিং অ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট-ভারত-এর ডিরেক্টর রিভিটাল জেগেলস্টেইন কয়েক বছর আগে তিনি তার সেনাবাহিনীর দায়িত্ব শেষ করার পর ভারতে কয়েক মাস কাটিয়েছেন।
জেরুজালেমের জেভিপি ফাউন্ডেশন এবং মার্গালিট স্টার্টআপ সিটির প্রতিষ্ঠাতা এরেল মার্গালিট বলেছেন যে তিনি ভারতের সাথে অংশীদারিত্ব করতে আগ্রহী, কারণ তার তিন মেয়ে দেশটিকে খুব পছন্দ করে। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বন্ধুত্বের কথা তো সবারই জানা।
ইসরায়েলে বসতি স্থাপন করা ৭০‚০০০ এরও বেশি ইহুদী দুই দেশের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করছে। জেরুজালেমের ডেপুটি মেয়র ফ্লেউর হাসান-নাহৌম এর স্বামী কলকাতা নাহৌম বেকারি সাথে যুক্ত পরিবারের সদস্য। এই বেকারিটি ১৯০২ সালে একজন বাগদাদি ইহুদি নাহৌম ইজরায়েল মোর্দেকাই দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
ইসরায়েল একসময় জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং বিনোবা ভাবের দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিল। বিশেষত দ্বিতীয়জন একটি কিবুটজ পরিদর্শনে নেমেছিল, যেখানে বসবাসকারীদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ ছিলো না।
তেল আবিবের কেন্দ্রে ডিজিনগডফ ফাউন্ডেশন এর উল্টোদিকে সেলিব্রেটি শেফ রীনা পুষ্কর্ণা (৬৩) দ্বারা পরিচালিত তন্দুরি রেস্তোরাঁটি ছিল ১৯৯৩ সালে নরওয়ের সহায়তায় ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে শান্তি আলোচনার স্থান। এখানেই ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তার ভাবী স্ত্রী সারার সাথে দেখা করতেন।
ইস্রায়েলে দ্বিতীয় মেয়াদে কাজ করা রাষ্ট্রদূত সঞ্জীব সিংলাকে সাংবাদিকরা ভারত-ইসরায়েল সম্পর্ক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি ইরাকি-ইহুদি মা এবং নতুন দিল্লিতে পাঞ্জাবি বাবার ঘরে জন্মগ্রহণকারী রীনা পুষ্কর্ণার দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। সেলিব্রিটি শেফ এবং রেস্তোরাঁটি এই বছরের মর্যাদাপূর্ণ প্রবাসী ভারতীয় সম্মান পুরস্কারের ২১ জন প্রাপকের মধ্যে একজন ছিলেন, যা কিনা হল বিদেশী ভারতীয়দের দেওয়া সর্বোচ্চ সম্মান।
পুষ্কর্ণাকে তার গ্রাহকরা স্নেহের সাথে মামিজি বলে ডাকেন। তিনি ২০২৭ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বাড়িতে নরেন্দ্র মোদীর জন্য খাবারের আয়োজন করেছিলেন৷ তার রেস্তোরাঁয় প্রধানমন্ত্রী ইতজাক রবিন এবং রাষ্ট্রপতি শিমন পেরেসের ছাড়া আরো অন্যান্যদের জন্যও খাবারের আয়োজন করেছে৷ এছাড়াও যে তিনি ২০০৩ সালে ভারতে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারনের প্রতিনিধি দলের অংশ ছিলেন।
সম্প্রতি, ইসরায়েলি টিভি ও ওয়েব সিরিজগুলিও ভারতীয় দর্শকদের নজর কেড়েছে। ফাউদার নেতৃত্বে লিওর রাজ হল এমনই একটি শো। টিভি সিরিজটি তানাভ নামে একজন ভারতীয় স্পিন অফকেও অনুপ্রাণিত করেছে।
এছাড়াও ভারতের আদানি গোষ্ঠী ইজরায়েলের ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ইসরায়েলের হাইফা বন্দর অধিগ্রহণ করেছে। সেই উপলক্ষে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু একে একটি “বিশাল মাইলফলক” বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, এটি ” দুই দেশের মধ্যে সংযোগ উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করবে।”
এসবের বাইরেও বলা যায় যে‚ ইসরায়েলে সবথেকে বেশী যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল ভারতের প্রতি তাদের ভালোবাসা। ভারতের সাথে তাদের সম্পর্ক কেমন তা জিজ্ঞেস করলেই তারা একটি মাত্র শব্দের দ্বারা এর উত্তর দেবে – ‘সাবাবা’ (মহান)।
লেখক – মনরাজ গ্রেওল শর্মা
ভাবানুবাদ ও সংযোজন – সৌভিক দত্ত