উল্টা বুঝিলি রাম

পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ কর্তৃক প্রকাশিত “অতীত ও ঐতিহ্য” নামক ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে “ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাসের ধারা” (দ্বিতীয় পর্যায়ঃ আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০-৬০০ অব্দ) নামক অধ্যাযে “রামায়ণ কি ইতিহাস?” এই প্রসঙ্গে আলােচিত হয়েছে – “দাদু বললেন, ইংরাজিতে Roaming শব্দটার একটা মানে হলাে ঘােরা। আবার সংস্কৃতে রাম শব্দের একটা অর্থ যিনি ঘুরে বেড়ান” ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে আমার মতামত ব্যক্ত করছি।

কতগুলি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের পদার্থবােধ অর্থাৎ পদের অর্থজ্ঞান হয়। ব্যাকরণ, কোষগ্রন্থ, আপ্তবাক্য, ব্যবহার, প্রসিদ্ধপদের সন্নিধান প্রভৃতি পদার্থবােধের সহায়ক হয়। রাম পদের অর্থনির্ণয় আমরা প্রাসঙ্গিকভাবে ব্যাকরণ ও কোষগ্রন্থ পর্যালােচনার দ্বারাই করতে পারি।

ব্যাকরণ থেকে আমরা প্রকৃতি প্রত্যয় বিশ্লেষণ করে অর্থবােধ করতে পারি। এটাকে আমরা ব্যুৎপত্তিলভ্য অর্থও বলতে পারি। রম্ ধাতুর উত্তর ঘঞ প্রত্যয় করে রামশব্দটি নিষ্পন্ন হয়। ক্রীড়া আনন্দলাভ প্রভৃতি অর্থে এই ধাতুটি প্রযুক্ত হয়। ‘রমন্তে যােগিনঃ অস্মিন্’ অর্থাৎ যােগীরা যেখানে আনন্দলাভ করেন এই রূপ অর্থ রামশব্দের দ্বারা প্রতিপাদিত হয়। যােগীদের পরমানন্দপ্রদায়ক হলেন রাম – এটাই রামশব্দের ব্যুৎপত্তিলভ্য অর্থ।

কোষগ্রন্থগুলিতে সমার্থকশব্দগুলি থেকে আমরা কোনাে পদের অর্থবােধ করতে পারি। প্রাচীন সংস্কৃত কোষগ্রন্থ “শব্দকল্পদ্রুম” – এ রামশব্দের বিবিধ সমার্থকশব্দ আমরা দেখতে পাই। প্রথমেই সেখানে দেখতে পাই “পরশুরামঃ”। পরশুরাম জমদগ্নিমুনির পুত্র। যিনি ত্রেতাযুগের আদিভাগে অবতীর্ণ হয়েছেন। এবং পৃথিবীকে একবিংশতি বার ক্ষত্রিয়হীন করেছিলেন। দ্বিতীয় সমার্থক শব্দ “রাঘবঃ”। রঘুকুলজাত দশরথপুত্র রাম এখানে পরামৃষ্ট হয়েছেন। তিনি ত্রেতাযুগের অন্তিমভাগে রাবণাদিবধের জন্য অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তৃতীয়তঃ বলা হয়েছে “বলদেবঃ”। ইনি দ্বাপরযুগের শেষভাগে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এই তিনজনই বিষ্ণুর অবতার। এবং পৃথিবীতে বিভিন্নযুগে দুষ্টদমনের জন্যই অবতরিত হয়েছেন। এছাড়াও ঘােটকাদি অর্থও রামশব্দের প্রদর্শিত হয়েছে।

রামায়ণ প্রসঙ্গে রাম শব্দের “রাঘবঃ” এইরূপ পদার্থবােধ হওয়া নিতান্ত কাম্য। মহাকবি কালিদাস “রঘুবংশ” নামক কাব্যে রঘুবংশের বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন “আসমুদ্রক্ষিতীশানা আনাকরখবৰ্মনা” অর্থাৎ সমুদ্রসহ সমস্ত পৃথিবীর অধিপতি ছিলেন এই রঘুবংশীয় নৃপেরা। দশরথপুত্র রামের চরিতই রামায়ণে প্রতিফলিত হয়। রামশব্দের দ্বারা ঘােটকাদিরূপ পদার্থবােধ যেমন এখানে অপ্রাসঙ্গিক যেমন তেমনই “সংস্কৃতে রাম শব্দের একটা অর্থ যিনি ঘুরে বেড়ান” এই রূপ অর্থস্বীকারও এখানে নিতান্তভাবে ভিত্তিহীন।

এছাড়াও প্রবন্ধে এই প্রসঙ্গেই “কোনাে এক সময় একদল যাযাবর ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছিল ভারতীয় উপমহাদেশে। …..ধীরে ধীরে দক্ষিণ অংশেও ছড়িয়ে পড়েছিল তারা। মনে করা হয়, দক্ষিণ অংশে ছড়িয়ে পড়ার সেই কাহিনিই রামায়ণে পাওয়া যায়” ইত্যাদির দ্বারা রাময়ণে বর্ণিত নৃপদের যাযাবর বা বহিরাগতত্ব প্রতিপাদন করার একটা প্রচেষ্টা করা হয়েছে। আর্যদের যাযাবরত্ববাদ একটি মতবাদমাত্র। এই প্রসঙ্গে বিবিধ ভিন্নবাদও আছে। তাই আমার মনে হয় শিশুপাঠ্যগুলাে সম্পূর্ণ তথ্যভিত্তিক হওয়া আবশ্যিক। বিশেষ মতবাদপুষ্ট তথ্য না থাকাই ভাল।

অন্তিমত, ঘুরে বেড়ানাে বা যাযাবর অর্থ স্বীকার করে যদি রাম শব্দটিকে সার্থক বলা হয় তাহলেও এই ধরণের যাযাবরবৃত্তিকে অবলম্বন করে দশরথপুত্রের নামকরণের কোনাে তাৎপর্যই নেই। সব পিতা মাতাই পুত্রজন্মের পর কোনাে ভাল গুণের অধিকারী হবে ভেবেই পুত্রের তদনুযায়ী নামকরণ করেন। আর যাযাবরবৃত্তি অনুযায়ী যদি পরবর্তীকালে এই নামকরণ স্বীকার করা হয় তাহলে রামায়ণ বর্ণিত রঘুবংশীয় অন্যান্য নৃপতিদেরও তদনুরূপ নাম হওয়া বাঞ্ছিত ছিল। অতএব এই প্রসঙ্গে রামশব্দের যিনি ঘুরে বেড়ান এইরূপ অর্থ কোনাে রূপেই সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং এই অর্থ স্বীকার করে পরবর্তী উপন্যাসও ভিত্তিহীন।

সুব্রত মণ্ডল
সহায়ক অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.