সকালে ভেষজ; বিকেলে বেলপানা, ঘোল, তরমুজের রস
কয়েক বছর আগে কিছুদিন ব্যাঙ্গালুরুর ভেটেরিনারি কলেজ ক্যাম্পাসে ছিলাম। রোজ সকালে একজন ঠেলাওয়ালা স্টিলের কয়েকটি জারে নানান ভেষজ বাটা-ক্বাথ ভরে আসতেন। মর্নিং ওয়াক সেরে বহু মানুষ সেখানে জমা হতেন। হাতল দেওয়া মাপনিতে নানান দ্রবণ তুলে তুলে কাগজের কাপে দিতেন তিনি। ভেষজ রসের প্রতি কাপের দাম ১০ থেকে ৩০ টাকা। জারে থাকতো নিমপাতা, থানকুনি, ত্রিফলা, তুলসী, কুলেখাড়া, ভূঁই আমলা, জামের বীজ, শুষনি শাক, কুলত্থ কলাই, নানান জিনিস। স্থানীয় মানুষ বললেন, উনার বাড়ি গিয়ে যাচাই করেছি আমরা, পরিচ্ছন্নতা দেখে এসেছি। আমরা রোজ খাই। আমিও খেতে শুরু করলাম। সাতদিন ছিলাম, অম্বল-গ্যাস, মাথাব্যাথা, কোষ্ঠকাঠিণ্য, নিদ্রাহীনতা বুঝি নি৷
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিনাল প্ল্যান্ট বিষয়ে অনেকে জানতে আসেন, কেউ ট্রেনিং নিতেও আসেন, চারার খোঁজ নিতে আসেন। আমি তাদের দেখা হলেই আবেদন করেছি, নিকটবর্তী শহরে বা গঞ্জের হাটে ভেষজ দ্রবণ নিয়ে বসা যায় কিনা। মনে হয় না কেউ করেছেন, করলে ভালো। অনেক কৃষক পরিশ্রম করতে চান না। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, “কুঁড়ে কিষাণ অমাবস্যা খোঁজে।”
এখনকার কৃষকেরা চায়, ডাবর, বৈদ্যনাথ, পতঞ্জলি, হিমালয়ান ড্রাগস প্রভৃতি ভেষজ পণ্য নির্মাতারা কৃষকের জমি থেকে ফসল কিনে নিয়ে যাবে। তা কী সবসময় হয়? তাছাড়া সত্যিই তো, এ রাজ্য ভেষজ কেনাবেচার জেলা জুড়ে বাজার গড়ে ওঠে নি তেমন। চাষীরা ভেষজ ফলাতে চান। কিন্তু বাজার নেই বলে দৌড় লাগান। করোনা পরিস্থিতিতে ভেষজের উপর নির্ভরতা ও ব্যবহার বেড়েছে। নানান পণ্যের বেচাকেনা বেড়েছে কয়েকমাসে। ভেষজ চাষ, সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ, বিপণন বাড়বে, তার সুযোগ নিতে হবে স্থানীয়ভাবে। স্বনির্ভরতার প্রচুর সুযোগ এখানে। বেঙ্গালুরুর সেই ভদ্রলোক সকালে ভেষজ রস আর বিকেলে বিক্রি করতে আসতেন ঘোল, তরমুজের রস, বেলের পানা ইত্যাদি। থাকতো বেলের মোরব্বা, আমলকীর মোরব্বা প্রভৃতি।
জৈবিক ফসলের বিপুল সুযোগ
জৈবিক চাষ করে সেই ফসল গ্রাম থেকে সরাসরি শহরের কোনো আউটলেটে বিপণন করার প্রচুর সুযোগ আছে। শহরগুলির জন্য দত্তক জৈবিক গ্রাম গ্রহণ করা দরকার। নিবন্ধীকৃত খদ্দেররা যেন সারাবছর ফসলের যোগান ঘরে বসেই পান। মাঝে কোনো মিডলম্যান নয়, উৎপাদক ও ভোক্তার সরকারি সংযোগ থাকে। সপ্তাহের দু’টি দিন গ্রাম থেকে প্যাটের ব্যাগে ভরে নানান সব্জি সম্ভার শহরে আসবে। অগ্রীম একটি বাজারের টাকা নিয়ে রাখবেন শহরের দুই এক কর্মী, যাতে বাজার ফেরত না যায়। শহরে এক বা একাধিক জায়গায় শাকসবজি, ফলমূল, মশলাপাতি, অন্যান্য পণ্য বিক্রি হবে। সবই তৈরি হবে জৈবিক পদ্ধতিতে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশক ব্যবহার না করে। এই জিনিসের দাম বাজারে বেশি। চাষী ফসলচাষ করে বেশি দাম পাবে। এই রকম ক্লাস্টার মার্কেটে মধ্যসত্ত্বভোগী না থাকলে ক্রেতার পক্ষেও খুব বেশি দাম বহন করতে হবে না। তারা নিরাপদ ফসল পাবেন, রোগ ব্যাধির প্রকোপ কমে যাবে।
এক একটি ক্লাস্টারে ২০০ টি পরিবারকে যুক্ত করতে পারলে প্রতি ক্লাস্টারে ১/২ জন কর্মীর যোগান থাকলে গ্রামের মানুষ দ্বারা শহরে পাঠানো হলে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে মাসে দশ বিশ হাজার টাকা রোজগার করতে পারবেন। সপ্তাহে দুইদিন তিনি ক্রেতার বাড়ি সব্জিফল পৌঁছে দেবেন।
একইভাবে মেডিসিনাল মিল্ক, অর্গানিক মিল্ক,মেডিসিনাল মিল্ক প্রোডাক্ট, অর্গানিক ফিস, অর্গানিক মীট, অর্গানিক চিকেন ইত্যাদির বাজার আছে। Unfelt need কে Felt need-এ পরিণত করা কেবল সময়ের এবং উদ্যোগের অপেক্ষা। মেডিসিনাল মিল্কটি কী? গ্রাম বাংলার একটি প্রবাদ হল ‘গাই গরুর মুখে দুধ’। মুখে তো আর দুধ হয় না। ভালো পুষ্টিকর খাবার গরুর মুখে তুলে দিতে হয়, তাতে দুধের উৎপাদন ও গুণমান বাড়ে। দেশী গরুকে নানান ভেষজ পাতা, ফুল, ফল নিয়মিত গোখাদ্য হিসাবে খাইয়ে তার দুধ কেবল খাদ্য থাকে না, হয়ে যায় পথ্য ও ওষুধ। এমন কৃষি বন Agroforestry তৈরি করতে হবে যাতে আমলকী হরিতকী বহেড়া, সজনে সহ নানান বৃক্ষ গুল্ম ও বীরুৎ ভেষজ লাগানো যায়। পরিমাণ মতো মেডিসিনাল ফডার/ফোরেজ গরুকে খাওয়ালে এই দুধের দাম বাজারের চাইতে দুই তিন গুণ বেশি দামে মানুষ কিনবে। কৃষক পরিবার নিজেও পুষ্টিলাভ করবে।
গ্রামে ছাগল পালন, শহরে নগরে ঝটকা মাংসের দোকান
আত্মনির্ভরতার ক্ষেত্রে ব্ল্যাকবেঙ্গল গোটের ঝটকা মাংসের চাহিদাকে পুঁজি করতে হবে। চারিদিকে হালাল মাংসের পাশে মানুষের ঝটকা মাংসের ব্যাপক চাহিদা পূরণ করতে হবে। নিকটবর্তী গ্রামগুলিকে জৈবিক পদ্ধতিতে বিশেষ ব্যবস্থায় ছাগপালন হোক। অল্পজমিকে দুই চারটি ভাগে ভাগ করে বেড়া দিয়ে স্বাভাবিক ঘাস বা পশুখাদ্য চাষ হোক। মাথায় থাকবে দ্বিবেড়া সারি Double hedge Row করে বারোমাসি কাঁঠাল গাছ বা বারোমাসি আম গাছ। তার পাতাও প্রয়োজনে খাওয়ানো যাবে। জমিতে কোনো রসায়ন ব্যবহার করা যাবে না। ছাগলকে বাইরের খাবার নয়, মিশ্র খামার করে স্বাবলম্বী হতে হবে। নিজের জমির অবশেষ, বর্জ্য একটুও ফেলা যাবে না। ছাগল ভেড়ার মাংসে রেসিডুয়াল টক্সিসিটি থাকবে না। এই মাংস বেশি করে বিকোনোর উদ্যোগ নিতে পারেন। ছাগল পালন থেকে খামারীদের লাভ বাড়ুক।
কৃষি-পরিবেশ পর্যটন গড়ে উঠুক দিকে দিকে
কর্মসংস্থানের নতুন ভাবনা হতে পারে Agro-eco tourism, যাকে ডাকতে পারি – “শিশির বিন্দু পর্যটন’ নামে, এটাই কৃষি-পরিবেশ-পর্যটন। বাংলা সাহিত্য এর উদাহরণ আছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পাই, “বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে/বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে।/দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা,/দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।/দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া,/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শীষের উপর/একটি শিশির বিন্দু।”
পশ্চিমবঙ্গে শিশির বিন্দুর সৌন্দর্য দেখবার বহু মডেল কেন্দ্র হোক। সমস্ত কৃষি জলবায়ু অঞ্চলেই এটা হতে পারে অসংখ্য। এখানে এত ভূ-প্রকৃতির বৈচিত্র্য, পাহাড়, টিলা, নদী, জলা, জঙ্গল — তা ব্যবহৃত হোক। নতুন শিক্ষানীতিতে Summer Trip, Summer Camp এর কথা বলা হয়েছে। আগামী দিনে বহু ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে যাওয়া হবে। তার পরিকাঠামো এখনই করা হোক, এইভাবে বেসরকারি সরকারি আধা সরকারিভাবে তৈরি হোক নানান জায়গায়। কৃষিভূমি, সবুজ অঞ্চল, জলাভূমির পাখি, অসংখ্য প্রজাপতি, সবুজ প্রান্তর, চারণ ভূমি, লেপাপোঁছা সাঁওতাল কুটির, ভেতরে পর্যটকদের আধুনিক ব্যবস্থা থাকবে। থাকবে Herbal Garden, Butterfly Garden, Boating facilities, শালুক পদ্মে ভরা পুকুর, পাখিরালয় Bird Watch Centre. প্রয়োজন Folk Tourism -এর বন্দোবস্ত, বনবাসী, গিরিবাসী সংস্কৃতির বাণিজ্যায়ন, নাচগান, স্থানীয় খাবার, বনবাসী শিল্প সামগ্রীর কেনাবেচা। পটচিত্র, বাঁশ বেতের কাজ, ডোকরা, মাটির পুতুল, মুখোস শিল্প।
‘সকল দেশের রানী, সে যে আমার জন্মভূমি’ — এই গানের ভূমি দেখতে, জলা-জঙ্গল দেখতে, সাজানো গোছানো পর্যটন গড়লে প্রকৃতিবিলাসী মানুষ আসবেই। তাকে কেন্দ্র করে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এলাকায় লোকশিল্প, গ্রামীণ শিল্প বিকাশ লাভ করবে। মডেল হোক এই ব্যাপারে।
ফসল প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে উঠুক
Food Processing Industry যথাসম্ভব বাড়ুক। হর্টিকালচার ডিপার্টমেন্ট থেকে অনেক ভর্তুকি পাওয়া যায়। বাড়ুক নানান ফলের আচার, চাটনী, মোরব্বা, সিরাপ, জ্যাম, জেলি, নানান সব্জির শুকনো প্যাকেট। তাতে স্থানীয় ফল সব্জি থাকা উচিত। এসব যেন জৈবিক পদ্ধতিতে চাষ হয়। স্থানীয় শিক্ষিত যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে একত্র করতে হবে। ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের কার্যকর্তারা এসব কাজ করে দেখাক। গত বছর বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশ কয়েকশো কার্যকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে এগিয়ে আসুক।
নার্সারী ব্যবসা, চারা কুশলতা ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থান করে দিতে পারে। টিস্যুকালচার ল্যাবরেটরি তৈরির জন্য সরকারি সহায়তা আছে হর্টিকালচার ডিপার্টমেন্টে। জেলা ও মহকুমা হর্টিকালচার অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। টবে রকমারি ফলের গাছ, শ্রীময়ী গাছ, মোডিসিনাল প্ল্যান্ট, মশলার গাছ, সব্জি গাছের ট্রে ভালো দরে বিকোয়। দুই স্কোয়ার ফুট মাটির ট্রেতে ঘন করে জৈবিক পদ্ধতিতে চাষ করা এক মাসের ধনেপাতা বিক্রি হয় ১০০ টাকায়।
বাগান রচনার মাধ্যমে কর্মসংস্থান
পুষ্টি বাগান তৈরির জন্য স্বসহায়ক একটি দল তৈরি করে শিখিয়ে পড়িয়ে দিলে, তারা শহর জুড়ে যাদের বাড়ির সঙ্গে এক চিলতে জমি আছে, পূর্ব নির্ধারিত টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে এদের দ্বারা সব্জি, ফল চাষ করিয়ে নিতে পারেন। মালিকেরও চাষের ঝক্কি পোহাতে হবে না, জমি একটুও খালি পরে থাকবে না, কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এদের দিয়ে শহরে নগরে ছাদ বাগান করানো যায়। ছাদে নিজের বাড়ির প্রয়োজনে অর্গানিক শাকসব্জী চাষ হোক ঠিকা শ্রমিক রেখে।
মাসিক গ্রাহক চাঁদার ভিত্তিতে নিকটস্থ গ্রামে সব্জি চাষের জমি ভাড়া নেওয়া, তাতে আপন মর্জি মতো ফসল ফলিয়ে চাষ করিয়ে বাড়িতে যোগান পাওয়া সম্ভব। ধরা যাক এক কাঠা বা ৭২০ বর্গ ফুট এলাকা মাসিক দুই হাজার টাকায় ভাড়া নিলেন কেউ। চাষী ভাড়াটের মনমতো সব্জি জৈবিক পদ্ধতিতে চাষ করবেন নিজে, ভাড়াটে নিজে দেখতেও আসতে পারেন, তার ভাড়া-জমি, নিজে হাতে ফসল তুলতে পারেন, শখ করে শ্রমও দিতে পারেন। চাষী নিজের দায়িত্বে ভাড়াটিয়ার বাড়িতে শাকসব্জি পৌঁছে দেবেন। একেবারে বিষমুক্ত খাবার।
দেশের মাটি – দেশের খাবার
চারিদিকে দেশী খাবারের দোকান হোক। ‘দেশের মাটির দেশের খাবার’। Self help group শহরের বুকে বুকে এমন খাবারের রেস্টুুরেন্ট বানাতে পারে। পাওয়া যাবে পান্তাভাতের সঙ্গে চিংড়ি মাছের ঝালচচ্চড়ি আর লঙ্কাপিয়াজ, মানকচু বাটা থেকে ধনেপাতা, খারকোল পাতা বাটা, গয়না বড়ি, মোচার ঘন্ট, পটলের দোরমা, ইলিশ ভাপা, রুই মাছের মুড়িঘন্ট, ভেটকি পাতুড়ি থাকবে। থাকবে পায়েস, পিঠেপুলি, মালপোয়া, তালের বড়া, নারকেল নাড়ু।।প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি সাপ্লাই হতে পারে। পরিচ্ছন্নতার সার্বিক বন্দোবস্ত নিয়ে করতে হবে। বিশুদ্ধ ও সাত্ত্বিক আহার, শরীর সম্মত আমিষ খাদ্য।
তাল খেজুরের নীরা, গুড়, পাটালিগুড়
শীতের মরশুমে কলকাতায় ৩০০ টাকা দিয়েও এক কেজি খাঁটি পাটালি গুড় পাওয়া যায় না। অথচ এর জন্য কী নেই? উদ্যোগ নেই। আছে শুধু ভেজাল। এই মার্কেটটা ধরতে হবে। রুখাশুখা এলাকায় রাশি রাশি খেজুর গাছ কী লাগানো যেতে পারে না? পতিত জমিতে ঘন করে, প্রয়োজনে আলের ধারে, পুকুর পাড়ে, খালের ধারে, গ্রাম্য রাস্তার ধারে ধারে খেজুর তাল লাগানো হোক যত্ন নিয়ে। তাল খেজুর গাছ ঝাড়িয়ে রস নিষ্কাশন একটা লাভজনক গ্রামীণ শিল্প। খেজুর রসের নীরা, ঝোলাগুড়, পাটালীগুড়, তা থেকে হরেকরকমের খাবার। খাঁটি হওয়া চাই, নিখাঁদ পণ্য বিপণনের জন্য সুনামের সঙ্গে কাজ করতে হবে।
গো-আধারিত কৃষি শহরেও
ভারতে গো-আধারিত জৈবিক কৃষি কাজ ফিরে আসুক। মানুষ সুস্থ হয়ে বাঁচুক। একটি প্রচল কথা হল “ধান ধন বড় ধন/আর ধন গাই/সোনারূপা কিছু কিছু /আর সব ছাই।”
‘শ্যামলী আমার গাই/তুলনা তাহার নাই।’ ছাদে কী শ্যামলী গাই-এর ঠাঁই হবে? গো আমাদের মাতা যদি, তাহলে কেনই বা তাকে মাথায় করে রাখবো না! গ্রাম ক্রমাগত হয়ে যাচ্ছে শহর, শহর হয়ে যাচ্ছে নগর। ছেয়ে যাচ্ছে ছাদ, দেখা না যায় চাঁদ। অথচ ছাদ থেকেই তো মোহময়ী চাঁদ দেখবার কথা! ছাদে কুসমোদ্যান না থাকলে সে চাঁদের নান্দনিকতা কোথায়? ছাদের ব্যবহার কই? শহরাঞ্চলে ছাদ ব্যবহার করে একটি গরু পালন করে পরিবারের চাহিদা মেটান। নিজের গাই-বলদকে বাড়ির আপন সদস্য মনে করতে হবে। তার দেখভাল হবে স্বচ্ছতাকে সর্বোচ্চ বিবেচ্য বিষয় করেই; নিষ্কলুষ গোয়াল, ছবির মতো লেপা-পোছা। গ্রাম ছেড়ে যারা শহরে এসে পাকা বাড়ি করেছেন, তাতে হাজার দেড়েক স্কোয়ার ফুট খোলা ছাদও রয়েছে অনেকের। বৃষ্টির জল যেখানে লভ্য, তাকে সংরক্ষণ করে রাখার ব্যবস্থা করাও কঠিন নয়; সেখানে গো-মাতাকে কেন ছাদের চাদরে, মাথায় করে ধরে রাখবো না? সিভিল ইঞ্জিনীয়ারকে দিয়ে বিশেষভাবে ছাদে মাটি ও জল ধরে রাখার ব্যবস্থা করে একজোড়া দুধেল গরু পালন করুন, দুধের জন্য দু এক জোড়া ছাগলও পোষা যায়; এমনকী রাখা যায় খাঁকি ক্যাম্বেল হাঁস ও ডিম দেওয়া মুরগীর খাঁচা, জিওল মাছের জলাধার খরগোশ পালনের ব্যবস্থা। এই সমূদয় কাজে যথাসম্ভব প্রকৃতির জল ব্যবহৃত হোক। বৃষ্টির জল ধরে তাকে শোধন করে কাজে লাগানো যাবে পালনশীল প্রাণীর স্নান, পরিচ্ছন্নতা ও তাদের পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে। ল্যাণ্ডস্কেপ করে ছাদে এক ফুট মাটি ফেলার জন্য নির্মাণ প্রকৌশলীর সহায়তা নেওয়া হোক, সেখানে বারোমাস ঘন করে গোখাদ্য ও ঘরোয়া সব্জি জৈব পদ্ধতিতে চাষ করে নেওয়া একেবারেই কঠিন কাজ নয়। কথায় বলে “গাই গরুর মুখে দুধ”। তাদের পরিবেশনের প্রয়োজনে ছাদেই চাষ করে নিন গোখাদ্য। গৃহস্থালি কাজের নানান বর্জ্য যেমন তরিতরকারির টাটকা খোসা, কলার খোসা, পুজোর ফুল, ভাতের ফ্যান ইত্যাদি পালিত গোরুকে খাওয়ান, প্রয়োজনে প্রতিবেশির কাছ থেকে তা চেয়েও নিন। গোবর সার যথেচ্ছ ব্যবহার করুন ছাদের চাষে, ছাদেই তৈরি হোক ভার্মি কম্পোস্ট ইউনিট, তা বেচেও অধিক লাভ পাবেন গো-পালক। যতটা সম্ভব গোবর-গোমূত্র সংগ্রহ করার ব্যবস্থা থাকবে। গোমূত্র ধরে বাঙ্গলার শহরাঞ্চলে/টবের গাছে জৈবকৃষির মূল্যবান তরল জৈব-সার হোক, তা লঘু করে গাছে সরাসরি স্প্রে করা চালু হোক। গোবর ব্যবহার হবে ছাদে আয়োজিত ভার্মিকম্পোস্ট ইউনিটে, ছাদে প্রস্তুত মশা মারার ধূপ (জড়িবুটি মিশিয়ে)। কাউ-ওয়াশ ব্যবহার হোক ছাদের কৃষিতে। মানুষকেও বৈজ্ঞানিক তথ্য সহযোগে বোঝানো হোক নর্দমায় কিছুটা গোবর-গোমূত্র প্রবাহিত হলে নর্দমার নানান রোগজীবাণু ধ্বংস হয়। তা নিয়ন্ত্রণ মাত্রায় পরিবেশ বান্ধব।
আর একটি কথা বলার ছিল তা হল, ছাদে গো-পালন করলে ব্যবস্থা রাখা উচিত Soil water recharge করার। গোয়াল ধোয়া জল, বৃষ্টির উদ্বৃত্ত জলকে বিল্ডিংয়ের সন্নিকটে বিশেষ ব্যবস্থা করে (নুড়ি পাথর, বালি রেখে একটি আয়তাকার ক্ষেত্র নির্মাণ) জল মাটিতে প্রবেশ করানোর চেষ্টা। গোবর-জল মাটিতে গেলে তা বিশুদ্ধতর হবার সম্ভাবনা।
একাজে ইচ্ছে থাকতে হবে। এটা একটা আন্দোলনের নাম হোক; “শহর মাথে গো-মাতা“। শহর/নগরকে কেবলমাত্র লৌহ-লোষ্ট্র-পাত্থর খাঞ্চা না করে খাঁচা হোক জীবনের, সবুজের। Operation Flood আসুক নেমে ছাদে। কেউ জুনোটিক রোগের দোহাই দিয়ে প্রস্তুত আন্দোলনকে ভাঙ্গতে চাইলে তাদের বরং শহর নগরের সার্বিক রোগ-প্রতিকার আর রোগ-প্রতিরোধ আন্দোলনে সামিল হতে বলুন; সবুজের আন্দোলনে ‘না’ মানেই সভ্যতার পরাজয়। জল ধরুন, জল ভরুন, চাষ করুন, চাষ করান।
(লেখক বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক)
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী (Dr. Kalyan Chakraborty)