টাটা তানিষ্কের বিজ্ঞাপন সাড়া ফেলে দিয়েছে গোটা দেশে, এমনকি দেশের বাইরেও। বহু অভিজ্ঞতা-ঋদ্ধ মানুষের যেমন সেটি তেমন আপত্তিকর মনে হয়নি, তেমন অসংখ্য গুণীজন বিজ্ঞাপনটির বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। বিজ্ঞাপনটিতে দেখানো হয়েছে এক মুসলমান শাশুড়ি তাঁর হিন্দু পুত্রবধূকে পরম আদরে “সাধভক্ষণ” করাচ্ছেন। মুসলিম রীতিতে এমত অনুষ্ঠানের কোনো প্রথা না থাকলেও পুত্রবধূর আনন্দার্থে সে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে—এ-ই প্রতিপাদ্য। অনেকে বলেছেন এর দ্বারা মুসলিম সমাজের দিক থেকে হিন্দুরীতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে। অতএব উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের তা দেখে ক্ষিপ্ত হওয়া অসঙ্গত। যুক্তিটি ফেলে দেওয়ার মত নয়। কিন্তু বিজ্ঞাপনটি আপাতদৃষ্টিতে এত স্মিত পরিমিত ও সুন্দর বার্তাবহ হওয়া সত্ত্বেও সেটির বিরুদ্ধে অগণিত মানুষের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাব্য কারণ কি সে সম্বন্ধে ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করতে চাই।
TanishqAd এ দেখানো হয়েছে হিন্দুরীতি ফলো করছে একটি মুসলিম পরিবার। অনুরূপভাবে বর্তমানে WhatsApp এও ঘুরছে একটি গল্প যার মূল প্রতিপাদ্য হল— মুঘল সম্রাজ্ঞী যোধাবাঈ এবং পরোক্ষে মুঘল সম্রাটও দুর্গাপুজোর পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। অনেকেরই মনে পড়বে যে এ বছর রাখীবন্ধন উৎসবের পরেও তথাকথিত এক ইতিহাসবিদ কোনো এক কাগজে লিখেছিলেন যে রক্ষাবন্ধন উৎসবও নাকি মুঘল আমলেই শুরু হয়েছিল। এই যে সনাতনী, অতি প্রাচীন রীতিনীতিগুলির সঙ্গে মাত্র ৪০০ বছর আগেকার মুঘলদের সংযুক্ত করে দেওয়ার প্রবণতা এদেশে এক শ্রেণীর লোকের মধ্যে নিরন্তর দেখতে পাওয়া যায়, সেই প্রবণতাকে ইতিবাচকভাবে বললে বলা যেতে পারে যে মুসলিমরা হিন্দু-সংস্কৃতিতে সামিল হতে চাইছেন। কিন্তু সব বিষয়েরই যেহেতু ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ব্যাখ্যাই হওয়া স্বাভাবিক, ফলে নেতিবাচকভাবে ভাবলে প্রশ্ন জাগে— হিন্দুসংস্কৃতির মধ্যে মুঘল ইমপ্ল্যান্ট করতে চেয়ে এতকালের ন্যারেটিভ-বিল্ডিং ইকোসিস্টেম কি চাতুর্যের সঙ্গে মুঘল সুপ্রিমেসিকেই ঘুরিয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাইছে? তাঁরা কি তথ্য দেওয়ার প্রয়াস করছেন যে ধর্মীয় উদারতা মুঘল তথা মুসলিমদের মধ্যেও ছিল ও আছে? সেক্ষেত্রে প্রশ্ন—ভারতের অমুসলমান জনগণের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা কি বলে? সত্যিই কি মুসলমান সম্প্রদায় সাধারণতঃ ধর্মীয়ভাবে উদার? সত্যিই কি মুসলমান ছেলে হিন্দু মেয়েকে বিবাহ করার পর সাধারণ মুসলমান শাশুড়ি তাঁর হিন্দু বধূমাতাকে ‘সাধভক্ষণ’ করিয়ে থাকেন? নাকি বিবাহের পর মেয়েটির ধর্ম, নাম, রীতিনীতি সবকিছু পরিবর্তন করে মেয়েটিকে অচিরেই হিন্দু রীতিনীতি ভুলিয়ে দেওয়ার প্রয়াস করাই সাধারণ মুসলমান সমাজের দস্তুর? কোনো হিন্দু মেয়ে কি মুসলিম পুরুষকে বিবাহ করার পর মুসলমান সমাজের মধ্যে বাস করেই তাঁর সন্তানকে হিন্দু রীতিনীতি ও আদর্শে বড় করে তোলার স্বাধীনতা সাধারণতঃ পেয়ে থাকেন? বাস্তবে সাধারণতঃ কি ঘটে থাকে সেদিকে দৃষ্টিপাত করা অপরিহার্য। বাস্তবের সঙ্গে এমন মিষ্টি, সুন্দর ন্যারেটিভগুলির মিল কতখানি? সত্যিই কি সাধারণ মুসলমান সমাজ হিন্দু সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদকে নিজেদের সংস্কৃতি বলে গণ্য করে? কেউই করেন না, তা যেমন বলছি না, তেমনই সাধারণভাবে যে তা করা হয় না, সেই কথাটি বলছি। কারণ তা সত্য। ভবিষ্যতে যে ভারতীয় মুসলমান হিন্দু সংস্কৃতিকে আবার তাদের নিজেদের আদত সংস্কৃতি বলে গণ্য করবে না, সে কথা বলতে বা ভাবতেও আমি চাই না। বরং ভারতীয় মুসলমানকে হিন্দু সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদকে পুনর্গ্রহন করতে হবে ভারতীয়ত্বের স্বার্থেই—এ কথা আমি মনে করি। তাতে মুসলমান সমাজ, অমুসলমান সমাজ এবং দেশ ও জাতি হিসেবে ভারতবর্ষ— তিনেরই মঙ্গল। কিন্তু যে প্রশ্ন থাকে তা হল, বাস্তব ও সাধারণ প্রবণতা (general trend) কিরূপ? বাস্তব সমাজচিত্র কি এমত সুন্দর, সংবেদনশীল ন্যারেটিভগুলির চেয়ে অতি মাত্রায় পৃথক? তা যদি হয়, তবে এমন ন্যারেটিভ-বিল্ডিংকে তঞ্চকতা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করা সঙ্গত। রাহুল রাজপুত কেন মারা গেল, একথা মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে হলে কত মায়ের বুকের ওপর থেকে পাথরের ভার সরাতে হয়, তার হিসাব কে রাখে? মুসলমান সমাজ যদি কট্টরতা-বর্জিতই হবে, তবে রাহুল রাজপুতকে তারা ঐভাবে পিটিয়ে মারল কেন? অনেকে হয়ত বলবেন যে সুন্দর ন্যারেটিভ-বিল্ডিং এর মধ্য দিয়েই সমাজে শুভবোধের জন্ম দেওয়া সম্ভব। এ কথা বোধ করি সর্বাঙ্গ-সত্য নয়। কারণ তা হলে রূপকথার গল্পগুলি শিশুসাহিত্য হিসেবে গণ্য হত না। বাস্তব চিত্রের সঙ্গে এমত ন্যারেটিভগুলির যখন এতখানি প্রভেদ থাকে, তখন এই জাতীয় ন্যারেটিভ রূপকথামাত্র হয়েই রয়ে যায়। সমাজ বদলের দিশা দেখাতে তা পারে না। কোনো শিশুই পরবর্তী জীবনে ছোটোবেলায় পড়া রূপকথার গল্পের আদর্শে জীবন কাটায় কি? যতক্ষণ পর্যন্ত না এইসব প্রশ্নের উত্তর মিলছে, ততক্ষণ পর্যন্ত #TanishqAd একপেশে এবং তঞ্চকতা বলে প্রতীত হওয়া সঙ্গত ও স্বাভাবিক। আদতে বিজ্ঞাপনটি মানুষের খারাপ লেগেছে একথা বোধ করি সত্য নয়। বিজ্ঞাপনের পরিমিত, স্মিত সৌন্দর্য্য তাদের মনে অপূর্ব এক আবেশ সৃষ্টি করেছে বলেই হয়ত বিজ্ঞাপনের বার্তার সঙ্গে বাস্তবচিত্রর তফাৎটি তাদের বেশি করে মনে পড়ে গিয়েছে। আর বহু শতকের জমে থাকা ক্ষোভ বেরিয়ে এসেছে লাভাস্রোতের মত। বর্তমান ভারতবর্ষে হিন্দুদের এক অংশ মনে করেন যে কোনো এককালে মুসলমান তাঁদের পূর্ব পুরুষের ওপর চড়াও হয়েছিল বলে আজ তার ‘পাল্টা দিতে’ তাঁরা পারবেন না কারণ তাঁদের গ্রুমিং ও শিক্ষা তেমন নয়। তাঁরা যুক্তি সাজান যে তাঁদের অভিভাবকরা তাঁদেরকে অসাম্প্রদায়িক বিশ্বমানবতার শিক্ষা দিয়েছেন। এই শ্রেণীর হিন্দু যে আদতে অবচেতনে ভয়ার্ত, সেই মনস্তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যে বিশদে না গিয়েও বলা যায় যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাঁদের অন্তরে পুঞ্জীভূত ভয়ও উপলব্ধির ভিসুভিয়াস হয়ে বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে বিলীন হয়ে আছে। তাঁরা সচেতনভাবে না চাইলেও সে ভিসুভিয়াস কোনো না কোনো এক দিন তার সমস্ত চিন্তন ও উপলব্ধির লাভা উদ্গীরণ করবেই। তাকে রোখার সাধ্য যে কোনো মানুষের নেই, তা তাঁরা জানেন না। তানিষ্কের বিজ্ঞাপন দেখে এই ক্ষোভের উৎসরন মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া যা কেবলমাত্র ন্যারেটিভ বিল্ডিং এর মাধ্যমে দূর হবে না। তার জন্য চাই আইনি পদক্ষেপ ও জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল ভারতীয়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের প্রসার। ভারতীয় মুসলমানকে ‘হিন্দু-মুসলমান’ (যেমন বর্ণনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর ‘পরিচয়’ প্রবন্ধগুচ্ছের অন্তর্গত ‘আত্মপরিচয়’ প্রবন্ধে) হয়ে উঠতেই হবে। এই ক্ষোভের প্রশমণ একমাত্র তবেই সম্ভব।
দেবযানী ভট্টাচার্য্য
Debjani Bhattacharyya