বহাল তবিয়তে কান্তি গাঙ্গুলি, মুক্ত স্বপন চক্রবর্ত্তী, বেকসুর রবিন দেব আর এমএলএ সুজন চক্রবর্তী – খুন হয়ে যাওয়া আনন্দমার্গী সাধুদের প্রতি অবিচার এর ইতিহাস

১৯৮২ সালের ৩০শে এপ্রিল৷ সাবেক কলকাতা তখন সদ্য ঘুম থেকে উঠে বেরিয়েছে বাজারের থলে হাতে৷ নিয়মমাফিক প্রাত্যহিক ঢঙেই শুরু আরেক সকাল৷

শুধু জানা ছিল না, বিজন সেতু-বন্ডেল গেটে ওঁত পেতে বসে আছে হায়নার দল৷ সকাল সাতটা থেকে আটটা, মাত্র ঘন্টা খানেকের অপারেশন – খুন হয়ে গেলেন ১৭ জন আনন্দমার্গী সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী৷

কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিলজলা আশ্রম যাওয়ার পথে এই আনন্দমার্গীদের এক এক করে ট্যাক্সি থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে শাবলে মাথা থেঁতো করে, ছোরা দিয়ে চোখ উপড়ে ফেলে, গায়ে পেট্রোল আর অ্যাসিড ঢেলে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল৷ আহত হয়েছিলেন বহু

প্রত্যক্ষ্যদশীরা তো বটেই, চমকে উঠেছিল সারা বিশ্ব – কল্লোলিনী তিলোত্তমার এ কোন রূপ?

ভারতের বুকে এত বড় পরিকল্পিত নৃশংস গনহত্যার উদাহরন বিরল।

এই হত্যাকান্ডে আজ অবধি একজনেরও সাজা হয়নি, বিচারবিভাগীয় কমিশন হয় কোন রিপোর্ট দেয়নি অথবা রিপোর্ট চেপে রাখা হয়েছে। মমতা ব্যানার্জি ঘটা করে বিচারপতি লালা’র নেতৃত্বে যে কমিশন গঠন করেছিলেন -সেই কমিশন কার ইঙ্গিতে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছে সে কেবল উনিই জানেন।

চাইলে খুব সাধারণ ভাবে গুলি করে বা বোমা মেরেও খুন করা যেত আনন্দমার্গীদের কিন্তু বাম সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসের বাতাবরণ সৃষ্টি করা৷ সেই কারণেই ১৭ জন আনন্দমার্গীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ব্লু–প্রিণ্ঢ তৈরীর কাজ শুরু হয়

১৯৮২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারীর পর থেকে আনন্দমার্গীদের নিশ্চিহ্ণ করার চূড়ান্ত রূপরেখা বাস্তবায়িত করেন কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন দেবরা, এমনটি অভিযোগ৷ আনন্দমার্গীদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করতে নেমেছিলেন সিপিএমের নেতারা৷

মিটিং মিছিল শুরু করে আনন্দমার্গীদের ছেলেধরা প্রমাণ করার মরিয়া চেষ্টা চলেছিল৷ ১৯৮২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী পিকনিক পার্কে একটি কনভেনশন ডাকা হয়৷ সেই কনভেনশনে উপস্থিত থাকা বাম নেতারা জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন আনন্দমার্গীদের বিরুদ্ধে৷

সত্যসাধন চক্রবর্তী, কান্তি গাঙ্গুলী (তৎকালীন কমিশনার যাদবপুর পুরসভা ও প্রাক্তন মন্ত্রী), সুজন চক্রবর্তী , সন্তোষ মিত্র , ক্ষুদিরাম ভট্টাচার্য, গঙ্গাধর নস্কর, রবীন দেব , বিজনবিহারী পুরকায়স্থ, অধ্যাপক নির্মাল্য বাগচী, অধ্যাপক অবন্তীকুমার সান্যাল, অধ্যাপক রথীন্দ্র নারায়ণ বসু, রজত বন্দ্যোপাধ্যায়, মিহির চট্টোপাধ্যায় (নাট্যকার), আশুতোষ সেন (অ্যাড্ভোকেট), কবি অরুণ মিত্র, বাদল দাশগুপ্ত, সুনীল চক্রবর্ত্তী (চেয়ারম্যান যাদবপুরপুরসভা), বীরেন ঘোষ (ভাইস চেয়ারম্যান, যাদবপুর পুরসভা) প্রশান্ত দাশগুপ্ত (কমিশনার যাদবপুর পুরসভা), প্রণব সেন (কমিশনার যাদবপুর পুরসভা), অধ্যাপক রবি রায় সেইদিনের কনভেনশনে উপস্থিত ছিলেন৷

ঘটনার ঠিক একদিন আগে হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত ছক নিয়ে ২৯ এপ্রিল কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের পৌরোহিত্যে সন্তোষপুর লোকাল কমিটির সেক্রেটারি স্বপন চক্রবর্ত্তী ওরফে বাবলু, রামনাথ সিং, অর্জুন মুখোপাধ্যায়, গোপাল রায়, নির্মল হালদার সহ সিপিএমের বেশ কিছু কুখ্যাত কর্মীদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়৷ সেই মিটিংয়েই আনন্দমার্গীদের নিধনযজ্ঞের পরিকল্পনা পুরোপুরি তৈরি হয়ে যায়

ছক মেনে প্রথমে এলাকায় আনন্দমার্গীদের বিরুদ্ধে বারবার মিছিল করা শুরু হয়৷ পরিকল্পনা করা হয় যে, সিপিএমের ‘হার্মাদ’ বাহিনী তিন ভাগে ভাগ হয়ে তিন জায়গায় আনন্দমার্গীদের জন্যে অপেক্ষা করবে৷ বিজন সেতু, বালিগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন ও বালিগঞ্জ রেলওয়ের জিনিসপত্র রাখার জায়গায় তারা আনন্দমার্গীদের জন্যে অপেক্ষা করবে

তিনটি দলের নেতৃত্ব দেবে বাবলু, রামনাথ সিং ও নির্মল হালদার ও কুখ্যাত বাহিনী৷ যখনই আনন্দমার্গীরা তিলজলার আশ্রমের দিকে যাবে তখন তাদের পিটিয়ে ও জ্বালিয়ে খুন করা হবে৷ সেই জন্যে তিনটি দলের কাছে আগে থেকেই প্রচুর পরিমাণে জ্বালানিও মজুত রাখা হয়েছিল৷

১৯৮২ সালের ৩০সে এপ্রিলের সকালে সন্ন্যাসীরা বিজন সেতুর ওপরে আসতেই সিপিএম নেতা–কর্মীদের একটি দল তাঁদের ঘিরে ফেলে লাঠি, রড দিয়ে হামলা চালায়। কার্যত চক্রব্যুহে আটকে পড়া সন্ন্যাসীরা সিপিএমের ওই উন্মত্ত দলের কাছে কাকুতি মিনতি করতে থাকেন৷

আক্রান্ত এক সন্ন্যাসী পরে বলেছিলেন : “বিজন সেতু শেষ হওয়ার আগে আগে দেখা ‌যায়, বেশ কিছু যুবক রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে। আমি প্রথম ট্যাক্সিটাতেই ছিলাম। হর্ন দেওয়া সত্ত্বেও ওরা সরছিল না। আচমকাই কয়েক জন চিৎকার করে উঠল— ছেলেধরা, তোমরা ছেলেধরা! তার পর ‘হোও হোও’ করে শব্দ উঠল গোটা ভিড়টা। ওরা ট্যাক্সিগুলোর উপর ‌হামলে পড়ল। আমরা কাচগুলো তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু কাচের গায়ে দুমদাম করে ধাক্কা মারছে ওরা। আর গালাগালির বন্যা। এত ক্ষণ ওদের হাতে কোনও অস্ত্র দেখা ‌যায়নি, এ বার দেখলাম ভোজবাজির মতো হাতে হাতে চলে এসেছে শাবল-ডান্ডা। গদাম গদাম করে ট্যাক্সির গায়ে পড়ছে সেগুলো।”

খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখা গেল, তখন পুরো সেতু জুড়ে থিকথিকে পুলিশ। পর পর ভাঙাচোরা, তোবড়ানো ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। হাওয়া ভারী হয়ে আছে পেট্রোলের গন্ধে। পুলিশের ঘেরাটোপে সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীরা।

আনন্দমার্গীদের সারিতে ছিলেন ট্যাক্সিগুলির চালকরাও। তাঁদেরই এক জন বললেন, ‘চার দিক থেকে ঘিরে নিল ওরা। শাবল দিয়ে পিটিয়ে ট্যাক্সির লক ভেঙে ফেলল। দরজা খুলে বার করতে চেষ্টা করছে আমাদের। নোংরা নোংরা কথা বলছে। হঠাৎ দেখলাম ভিড়টা ‌যাদের কথায় নাচছে, সেই নেতাদের এক জন চিৎকার করে আমাদের ট্যাক্সি থেকে নামতে বলল।

‌যদি না নামি, তা হলে ট্যাক্সিগুলোতে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিল।

আমরা সবাই ভয়ে ভয়ে নেমে এলাম। এবার ও বলল, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পড়তে। তা-ই করলাম। ওদের হাতে-হাতে এগিয়ে এল কতগুলো বড় বড় প্লাস্টিকের ড্রাম। ওদের কথাবার্তা থেকে বুঝলাম ড্রামগুলোতে অ্যাসিড আর পেট্রোল আছে।’ এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসী বললেন, ‘পুরো ব্যাপারটাই আগে থেকে ছক কষা। বুঝতে পারছিলাম গুটিকয় লোক আমাদের ছেলেধরা বলে রটিয়ে লোক জড়ো করেছে। আমরা জানি, এর পিছনে রয়েছে ওই জমিটা…(কথায় জোরে ব্রেক কষলেন বৃদ্ধ)।

সাধারণত যাঁরা গন্ডগোল দেখলেই পাশ কাটিয়ে যান, তাঁরাই এ দিন নামেন রক্ষকের ভূমিকায়। কিছু পথচারী, কিছু স্থানীয় লোকজন, দোকানদার এগিয়ে আসেন। তাঁদের মধ্যে থেকে গুঞ্জন ওঠে, কী প্রমাণ আছে ওরা ছেলেধরা? এতগুলো মানুষকে এ ভাবে সবার সামনে মেরে ফেলতে চাইছে?

ক্রমে ‌যারা ভিড়ের নেতৃত্ব দিচ্ছিল, তাদের উদ্দেশে ভেসে আসতে থাকে: তোমরা কে বলো তো? তোমরা তো এখানকার কেউ নও? তোমাদের কে বলেছে এরা সব ছেলেধরা? আর এখানে কারও ছেলেমেয়ে তো চুরি ‌যায়নি! কেউ কেউ এগিয়ে এসে বলেন, ছেলেধরা হলে পুলিশে দাও, এ ভাবে খুন করার অধিকার তোমাদের কে দিল?

কিন্তু মৃত্যু নেশায় বুঁদ সশস্ত্র বাহিনীর প্রথমে রড ও লাঠির ঘায়ে অচেতন করে দেয় অবধূতদের৷

এমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য এলাকায় জমায়েত করে থাকা সিপিএমের ক্যাডাররাও বিজন সেতুর (Bijan bridge) ওপর ভিড় বাড়িয়ে সেই নৃশংসতাকে কয়েকগুণ বাড়াতে হাত লাগান৷

এরপর অচেতন অথচ জীবিত অবধূতদের একের পর এক গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় সিপিএমের কমরেডরা৷ পরে ওই হার্মাদদের দল একের পর এক অর্ধদগ্ধ সন্ন্যাসীদের দেহ বালিগঞ্জ স্টেশনের রেল লাইনে ফেলে দিয়ে ‘হায়েনার হাসি হেসেছিলেন’৷

এই যে জঘন্যতম গণহত্যা যা জাতি হিসাবে বাংগালীর লজ্জা তা যথারীতি আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছেন। সামান্যতম বিবেকদংশন অবশিষ্ট থাকলে তেনারা সিপিএমের নকল ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা’র মুখোশ অনেকদিন আগে খুলে দিতেন

এক প্রৌঢ় দোকানদার বললেন, ‘ওদের আটঘাট বেঁধে ড্রাম, লাঠিসোটা নিয়ে হাজির হওয়াতেই বুঝতে পারি, এটা প্ল্যান করা। ছেলেধরার বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ নয়

আসলে পার্টি পলিটিক্স খুব সাংঘাতিক জিনিস, বুঝলেন না?

আমরা চিৎকার করে বলি, পুলিশে খবর দাও, কিন্তু মানুষ মারতে দেব না। কয়েক জন আমাদের দিকে তেড়ে আসে, তখন আমিও রাস্তা থেকে একটা ইট তুলে তেড়ে যাই। আমার ছেলেও ‘হ্যা-ই’ বলে দৌড়ে যায়। দেখাদেখি আরও ক’জন বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়।

এর পর আস্তে আস্তে ডান্ডাধারীদের ধমকধামক কমে আসতে থাকে। ভিড়ও বাড়তে থাকে। বহু লোক দাঁড়িয়ে যায়, কী হচ্ছে দেখবে বলে। আনন্দমার্গীদের হুমকি দিতে দিতে আক্রমণকারীরা পিছু হটে যায়। কয়েকটা গাড়ি বোধহয় ওদেরই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। সেগুলোয় উঠে চম্পট দেয়। আধ ঘণ্টা পরে, পুলিশ আসে।’

আনন্দবাজার লিখছে : ঘটনায় শাসক দলের হাত আছে, এমন কথা হাওয়ায় উড়ছে। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর মন্তব্য জানতে চাইলে উনি বলেন, ‘মে দিবসের প্রস্তুতিতে আছি। গুজবে কান দিই না।’

ঋণ: ঋতম বাংলা / আনন্দবাজার আর্কাইভস

লিখলেন – প্রীতম চট্টোপাধ্যায় (Pritam Chatterjee)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.