চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরিসংখ্যানগুলির তুলনায় ভারতের অগ্রগতি খরগোস ও কচ্ছপের দৌড়ের মতো মনে হতে পারে। কিন্তু মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ ২০৩০ থেকেই সংখ্যাগুলির বদলে যাওয়াটা নিশ্চিত।
দীর্ঘ প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের উন্নয়নের গতি একটু শ্লথ হয়। কোনো স্বৈরতান্ত্রিক শাসককে রুখতে এই ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি। অন্যদিকে দেশের শাসক রাজনীতিকরা যখন মানুষের মঙ্গলের জন্য সঠিক লক্ষ্যে কাজ করেন তখন গণতন্ত্র সে কাজে বাধা না দিয়ে একটু অন্তরালে থেকে যায়। স্বৈরতন্ত্রগুলি গড়েই ওঠে দ্রুতগতিতে কোনো পরিবর্তন আনার তাগিদে। শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা যদি দেশহিতে সঠিক। সিদ্ধান্তগুলি নিতে পারেন সেক্ষেত্রে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাও কিন্তু জাদু দেখাতে পারে (সিঙ্গাপুর, ১৯৮০’র পরের চীন এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ)।
অন্যদিকে তাদের ভুল সিদ্ধান্ত যে দ্রুত দেশের ধ্বংসও ডেকে আনতে পারে তার প্রমাণ জিম্বাবয়ে, উগান্ডা, রাশিয়া। এই দু’ধরনের দেশকেই পর্যবেক্ষণ করা বিশ্ব বিনিয়োগ ম্যানেজার রুচির শর্মা বলছেন দীর্ঘমেয়াদে এই দু’ ধরনের ব্যবস্থাই একইরকম ফল দিতে পারে। কিন্তু তফাতটা হচ্ছে গণতান্ত্রিক দেশে উন্নয়নের ফল ও প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী এবং দৃঢ় হয় তুলনায় স্বৈরতান্ত্রিক দেশের উন্নয়নের স্থায়িত্ব অনেকটাই ভঙ্গুর। এই ৭৩তম স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের সময় আমরা বিবেচনা করতে পারি ঠিক কোন মধ্যপন্থা অবলম্বন করলে (গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর মধ্যেই) আমরা স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতির সঙ্গে খরগোসের দৌড়ে দ্রুত আমাদের কচ্ছপের ভূমিকা বসলে ফেলতে পারি। ভিন্ন পথ অবলম্বন করে চলেও ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকেও চীনের সঙ্গে আমাদের উন্নয়নের হারে বিশেষ ফারাক ছিল না।
গণতান্ত্রিক ভারত নেহরুর সমাজতান্ত্রিক মডেল অনুসরণের ফলে বৃদ্ধির হারে পিছিয়ে পড়ে। স্বৈরতান্ত্রিক মাও-জে-দঙ-এর অধীনে ও তার কিছু পরেও চীন লাগাতার ভুল সিদ্ধান্ত নিতে থাকে যেমন সাংস্কৃতিক বিপ্লব, মহা উলম্ফন, পরিবার পিছু এক শিশুনীতি প্রভৃতি। এর ফলে উল্লেখিত ৮০’র দশকের শুরুতে উভয়ের জিডিপি প্রায় একই জায়গায় ছিল।
আজকের তারিখে ফিরলে চীনের অর্থনীতির মাপ বা বিস্তার ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার সেখানে। ভারতের অবস্থান ২.৬ ট্রিলিয়নে। অর্থাৎ চীন ৫ গুণ এগিয়ে গেছে। মাথাপিছু চীনের জিডিপি’র হার ভারতের চেয়ে চারগুণ বেশি। আন্তর্জাতিক বিনিময় মূল্যের জটিল হিসেব নিকেশ নির্ভরতার কারণে ভারতের অগ্রগতিকে অযথা খাটো করে দেখা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ক্রয় ক্ষমতার সমতার (Purchasing Power Parity) ভিত্তিতে যে হিসেব এসেছে সেই অনুসারে ভারতের জিডিপি-র বিকল্প পরিমাণ হবে ১০.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। চীনের এই পদ্ধতিতে জিডিপি ২৫.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। তাহলে প্রথম হিসেব অনুযায়ী ৫ গুণ বেশি নয়। পিপিপি-র হিসেব পদ্ধতিটি কিন্তু ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক অনুমোদিত। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী চীন মোটামুটি আড়াইগুণ এগিয়ে আছে। এটিই হচ্ছে দু’ দেশের মধ্যে ১৯৮০ সালের পর অর্থনীতির গতি প্রকৃতির প্রকৃত ফারাক।
মাও-এর মৃত্যু (১৯৭৬)-এর পর চীন এমনকী মহা-খরগোসের টোটকা আবিষ্কার। করে এতটা এগিয়ে গেল আর ১৯৯১-এ সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করেও আমরা পিছিয়ে রইলাম। তফাৎ হচ্ছে ১৯৮০ সালের আগে থেকেই স্বৈরতান্ত্রিক চীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এই দুটি ক্ষেত্রেই বহুদূর এগিয়ে ছিল। ৮০ সালের আগেই চীনে শিক্ষিতের হার যেখানে ছিল ৬০ শতাংশ ভারতে তা ছিল ৪০ শতাংশ। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ও লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণেও তারা ছিল অনেক এগিয়ে। আজকের তারিখেও আমাদের এই পশ্চাৎপদতায় কোনো ইতরবিশেষ হয়নি। ইউএনডিপি (রাষ্ট্রসঙ্ঘের)-এর সাম্প্রতিক মানব সংসাধন সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে চীনের স্থান যেখানে ৮৬ ভারতের ১৩১। কিন্তু মোদী সরকারের নেওয়া স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আয়ুষ্মন ভারত, স্বচ্ছ ভারত প্রভৃতি ছাড়া উভয়দেশের বৃদ্ধির ফারাক বোঝাতে শিক্ষা ক্ষেত্রেও যে প্রকল্পগুলি জারি আছে তার ফলে আগামী ১০ বছর সময় সীমায় কে এগিয়ে থাকবে তা নিয়ে বাজি ধরলে চীনকেই এগিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু ২০৩০ থেকেই বাজি পাল্টে যাবে। শুরু হবে ভারতের খেলা।
ভারতে দারিদ্র দূরীকরণের ক্ষেত্রেও সামগ্রিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির (Gross enrolment Ratio) অর্থাৎ ভর্তি হতে পারার যোগ্যতা আছে এবং উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হয়েছে এই অনুপাতে অত্যন্ত ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। যেমন অতীতে যদি যোগ্যদের ১০ জনের মধ্যে ৩ জন ভর্তি হতো এমন ৬ জন হচ্ছে। বাস্তবে এই তাৎপর্যপূর্ণ অনুপাত ২০১০-১১ ১৯.৪ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে ২৫.২এ উন্নীত হয়েছে এবং বেড়ে চলেছে। World datalab of Brooking Institutions-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী এই বছরে ভারতে গরিবের মোট সংখ্যা ৪ কোটিতে নেমে আসবে। এর ফলে সমগ্র জনসংখ্যার নিরিখে তা মাত্র ৩ শতাংশে দাঁড়াবে। শীঘ্র প্রকাশিতব্য এনএসএস-এর পরিসংখ্যান হাতে এলেই বোঝা যাবে এই পরিসংখ্যানের যথার্থতা। চীন জমির মালিকানা ও শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে জোর জুলুম করে কাজ হাসিল করে। দেশের সামগ্রিক সঞ্চিত অর্থ (domestic savings) জোর করে কুক্ষিগত করে পরিকাঠামো উন্নয়ন ও রপ্তানিযোগ্য (পণ্য উৎপাদন) বাণিজ্যে ঢালাও লগ্নি করে। এই ধরনের বাড়াবাড়ি, জোর জবরদস্তি একই সঙ্গে ও শিশু নীতি যা ‘৭০-এর শেষ দিকে নেওয়া হয়েছিল তার পরিণতি আগামী দিনে আরও ভয়ঙ্কর হতে চলেছে। সামাজিক অস্থিরতা ছাড়াও কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত বয়সের নিয়োগযোগ্য লোকের অভাব দেখা দেবে।
ভারতে যদিও আমরা ভূমি সংস্কার ও শ্রম আইনের সংশোধন নিয়ে নিরন্তর কঠিন চেষ্টা করে চলেছি তারই মধ্যে দারিদ্রসীমায় হ্রাস ও অর্থনৈতিক বৃদ্ধির স্বাভাবিক ফলস্বরূপ আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে লাগাম পড়েছে। আমাদের দেশের অগ্রগতির ট্রাকে থাকর কারণে দেশের মানুষের কাজ করার বয়সসীমা, প্রবীণ নাগরিকদের সংখ্যা, সঞ্চয় ও বিনিয়োগের হার বাড়তেই থাকবে। আমাদের আভ্যন্তরীণ শিল্পনীতি একটু ঠিক করে নিতে পারলে বিশ্বে যে বিপুল সস্তা পুঁজি অনিয়মিত রয়েছে তা ভারতে আসতে বাধ্য।
তাহলে এই সাফল্য পেতে গেলে আমাদের কী নীতি নিতে হবে? প্রথমত, রাজ্যগুলিকে আরও অধিক ক্ষমতা প্রদান বিশেষ করে শহরগুলিকে। শহরের ব্যাপ্তির বিষয়টা ভীষণ গুরত্বপূর্ণ। শহরাঞ্চলে সুযোগ্য, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও নিবিড় শহরীকরণই উন্নয়নের চাবিকাঠি। একই সঙ্গে চাকরিরও উৎস। ২০১৮ সালের হিসেবে ভারতে ৩৩ শতাংশ শহরীকরণ হয়েছে যেখানে চীন ৫৮ শতাংশ। এর মধ্যে লক্ষণীয় হচ্ছে চীনের শহরীকরণের উৎকর্ষ। চীনের শহরীকরণ হয়েছে পূর্ব সামুদ্রিক উপকূল ধরে। যেখানে ভারতের শহরীকরণ মেট্রো শহরগুলির নানা বিক্ষিপ্ত বড়ো বড়ো অঞ্চলকে ঘিরে। শহরের যে আদি বিশেষত্ব (যেমন কোথাও হয়তো কাছাকাছি নদী রয়েছে, কোথাও একই ধরনের দ্রব্যের কারখানা) এগুলিকে বেছে নিয়ে এখানে সামাজিক, ব্যবহারিক পরিকাঠামোয় উন্নয়ন করতে পারলে বাড়তি সুবিধে পাওয়া যেতে পারে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রের সঙ্গে কম খরচের স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। এই বিষয়টা কিন্তু চীন মাও-এর আমলেও সফলভাবে করতে পেরেছিল। এর ফলে ‘দেং ঝিয়া পেঙ’-এর জমানায় সরকারি নীতিতে যখন আরও জনমুখী পরিবর্তন এল। শিক্ষাক্ষেত্র তখন শিক্ষাক্ষেত্র আগে থেকেই এগিয়ে থাকায় বিশাল উন্নতি করল। তৃতীয়ত, কর ব্যবস্থায় সংশোধন এনে পুঁজির বাড়তি বিনিয়োগের রাস্তা সহজ ও আকর্ষণীয় করা দরকার। পুঁজি এলেই কর্মী তৈরি হবে।
তবে, এই ব্যবস্থাগুলি কার্যকর করলেই রাতারাতি যে আমরা চীনকে ধরে ফেলব এমনটা নয়। জিডিপি বৃদ্ধি লাফিয়ে বেড়ে যাবে সেটা আশা করাও ভুল। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকে যে কোনো বাড়তি বৃদ্ধিই আমাদের ক্রম উন্নতির পথে নিয়ে যাবে। সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো সংঘাতের পরিস্থিতির সৃষ্টি না করেও এটা করা সম্ভব। ২০২৪ সালের মধ্যে ভারতের অর্থনীতির বহর ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছবার যে পরিকল্পনায় প্রধানমন্ত্রী সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ চেয়েছেন তা হয়তো পূরণ হতেও পারে, নাও হতে পারে। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি ২০৩০-এর গোড়ায় দেশের অর্থনীতি ১০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছুঁয়ে ফেলবেই। আমি নিঃসংশয়।
আর জগন্নাথন
(লেখক স্বরাজ্য পত্রিকার সম্পাদক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.