এ বছরের জয়পুরে অনুষ্ঠিত সাহিত্য উৎসবে অংশগ্রহণ (JLF) করাকালীন আমার সঙ্গে এক উৎসুক তরুণীর দেখা হয়। মেয়েটি আমাকে জানাল, দেখুন, এরকম উৎসবে আলোচনার জন্য বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিন্তু বামপন্থী চিন্তাধারার প্রভাব সব সময়ই পরিলক্ষিত হয়। অনুষ্ঠানে বক্তা বেছে নেওয়ার বিষয়েও বামপন্থী মনোভাবাপন্নরাই প্রাধান্য পান। এই সূত্রে সে যে টিম-এর অধীনে সাহিত্য উৎসব পরিচালনার কাজে অংশ নিচ্ছিল তিনি যে একজন স্বঘোষিত বামপন্থী কার্যকর্তা সে কথাও সে আলাদা করে আমাকে জানায়। এই বাম নেতা তাকে জানিয়েছিল যে বিখ্যাত গীতিকার প্রসূন যোশীকে সকলে চাইলেও এবারে তাঁকে উৎসবে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। কেননা কিছুকাল ধরেই তিনি দক্ষিণপন্থী হয়ে উঠেছেন। প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে জনপ্রিয় ‘মণিকর্ণিকা’ ছবিতে তাঁর গান লেখার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন তিনি। আমরা দেখেছি বামপন্থীরা সাহিত্যকে বিপ্লব সংঘটিত করার মাধ্যম হিসেবে গণ্য করে। সরকারি নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহিত্য তাদের কাছে একটি অস্ত্র।
অবশ্যই সংগঠকদের হাতে অনুষ্ঠানের অংশগ্রহণকারী নির্বাচন করার স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে। ঠিক দু’বছর আগে দত্তাত্রেয় হোসবালে ও আমাকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হলে সে আমন্ত্রণ ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য শোরগোল উঠলেও কর্তৃপক্ষ তা ফেরায়নি। আমাদের জয়পুর সাহিত্য উৎসবে বক্তব্য রাখার আমন্ত্রণ বহাল ছিল। এই বছর তারা রমেন পতংগেকে উৎসবে যোগদানের নিমন্ত্রণ পাঠায়।
আমার মতে এটি অত্যন্ত সদর্থক পদক্ষেপ। বাস্তবে এ বছর তারা প্রসূন যোশীকেও আমন্ত্রণ সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেছিল যদিও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি যেতে পারেননি। বামপন্থী কর্মীদের কাজকর্ম নিয়েই মেয়েটি তার পর্যবেক্ষণের কথা আমাকে জানিয়েছিল।
এখন সময় এসেছে বামপন্থীদের ভণ্ডামির কথা সঠিকভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরার। একদিকে তারা নিজেরাই বাকস্বাধীনতা রক্ষার স্বঘোষিত যোদ্ধা। তাদের বক্তব্যের যে-কোনও যুক্তিপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত বিরোধিতাকেও তারা নিজেদের মতের স্বাধীনতার ওপর আঘাত বলে মনে করে। একই সঙ্গে অন্য কোনও দৃষ্টিকোণ যা তাদের মনোমতো নয়, শুরুতেই জোর করে তার কণ্ঠরোধ করে দিতে তারা দ্বিধা করে না।
তাই দু’ বছর আগে সংগঠকরা যখন আমাদের মতো দু’জন আর এস এস মতাবলম্বী বক্তাদের সেই প্রথমবার সম্মেলনে অংশ নিতে ডাকেন তখন স্বাভাবিক কারণেই বামপন্থীরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। প্রবীণ সি পি এম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি সাহিত্য উৎসবই বয়কট করেন। আর এস এস একটি তৃণমূল স্তরের সংগঠন যা শাসকশ্রেণীর সব ধরনের বিরোধিতা সহ্য করেও প্রসারিত হয়ে চলেছে। এর কারণ ভারতের মানুষের সমর্থন রয়েছে এই সংগঠনের পেছেনে। এই সূত্রে সঙ্ঘের পিছনে দৃঢ় ও সংকল্পবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানোর জন্য ভারতের সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ ধন্যবাদ প্রাপ্য। আর ঠিক এই কারণেই সময়ের সঙ্গে মানুষের ওপর এই সংগঠনের প্রভাব বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে বামপন্থীরা অত্যন্ত নজরকাড়াভাবে নিয়মিত জনগণের ওপর তাদের প্রভাব হারাচ্ছে। হারাচ্ছে সমর্থন। পরিণতিতে বামপন্থীদের রাজনৈতিক প্রাধান্য আজ কেবলমাত্র দক্ষিণের একটি রাজ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। গোঁড়া বামপন্থীদের সম্পর্কে আমার বক্তব্যের অনুমোদন পাওয়া যায় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক বিবেক অগ্নিহোত্রীর অভিজ্ঞতায়। তিনি সেই অনুভব তার ‘Urban Naxals’ গ্রন্থে অকপটে লিখেছেন। ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ও তার সঙ্গীসাথীরা বামপন্থী মহিলা প্রতিবাদীদের হাতে কিভাবে নিগৃহীত হয়েছিলেন তার বিস্তৃত বিবরণ সেখানে রয়েছে। বামপন্থী কর্মীরা তার ‘Buddha in a traffic jam’ চলচ্চিত্রটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে কী তুমুল বাধার সৃষ্টি করেছিল তাও জানা যায় বইটি থেকে। অগ্নিহোত্রী জানিয়েছিলেন তিনি শুধুমাত্র তার ছবিটি একবার দেখাতে চান, এক্ষেত্রে যার পচ্ছন্দ হবে না তিনি দেখবেন না। তারা উত্তর দিয়েছিল, না, কোনও অবস্থাতেই তিনি ছবি দেখাতে পারবেন।
এবারে প্রথমে বলা জয়পুর সাহিত্যে উৎসবে কর্মকর্তা প্রসূন যোশীর মণিমর্ণিকা ছবির জন্য লেখা গানের প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। গানটির লিরিক ছিল এরকম, ‘ম্যায় রহুঁ না রহুঁ ভারত রহেগা’ (আমি থাকি না থাকি এই ভারতদেশ থাকবে)। যে কোনও মানুষ একটু ভাবলে স্তম্ভিত হয়ে যাবেন এমন একটি স্নিগ্ধ করুণ শব্দের পঙক্তি সম্পর্কে কারো আপত্তি করার কি কিছু আদৌ থাকতে পারে? ঠিক সেমেটিক (semitic religion যথা JEW ইত্যাদি) ধর্মাবলম্বীদের মতো বামপন্থীরাও সত্যের নিজেদের তৈরি একটি মাত্র অর্থে আস্থাবান। অন্য কোনও ব্যাখ্যা তারা টিকতে দিতে রাজি নন। যদি কেউ তাদের সঙ্গে সহমত না হন সেক্ষেত্রে তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। এমনকি বহু ক্ষেত্রে তার বাঁচার অধিকারও আর থাকে না। এই বামপন্থী মতবাদই বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসের বেশ কিছু জঘন্যতম অপরাধের জন্য দায়ী। আমাদের এই ভারতেও কেরল ও পশ্চিমবঙ্গ যে দুটি জায়গায় বামপন্থীদের গড় ছিল সেখানেও নিয়ম করে রাজনৈতিক খুন করাই ছিল এঁদের কাজ। বিরোধীদের এই ধরনের অসহিষ্ণুতা চিরাচরিত ভারতের অনুভব ও হিন্দুধর্মের বিরোধী। মানুষের চরিত্রে আধ্যাত্মিক পরিবর্তন আনাই চিরন্তন ভারতীয় সমাজের চিন্তাবিন্দু। সকলের মধ্যেই আত্মিক উন্নয়নের মাধ্যমে জ্ঞান এবং একাত্মতার (inclusiveness) তৈরি হয়েছে। ভারতীয় দর্শনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবেই জড়িয়ে আছে নিজের মত ও চিন্তা প্রকাশের আবশ্যিক শর্ত। হিন্দুধর্মের এই মিলন ভাবনাই অনাদি কাল থেকে বিচিত্র সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার মানুষকে ভারতে শান্তিতে একত্রে বাস করার মন্ত্র দিয়েছে। এই প্রসঙ্গে আমার স্বামী বিবেকানন্দের একটি গল্প মনে পড়ে গেল। ভারত ও হিন্দু ধর্মের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের কথা পাশ্চাত্যবাসীকে জানানোর পর তিনি তখন ফেরার জন্য তৈরি হচ্ছেন। লন্ডন ছেড়ে দেশে ফিরবেন। সালটি ছিল ১৮৯৭। এই সময় তার এক ইংরেজ বন্ধু তাকে প্রশ্ন করল “আচ্ছা স্বামীজী, দীর্ঘ চার বছরের বিলাস, বৈভব, শক্তি ও গরিমাময় পাশ্চাত্যে কাটানোর পর আপনি আপনার মাতৃভূমিকে কী চোখে দেখবেন? স্বামীজী উত্তর দিয়েছিলেন, “দেখ, যখন আমি আমার ভারত ছেড়ে এসেছিলাম তখন তো আমি তাকে অবশ্যই ভালবাসতাম। কিন্তু এই দীর্ঘ প্রবাসের পর ভারতের প্রতিটি ধূলিকণা আমার কাছে পবিত্র হয়ে উঠেছে। সেখানকার বাতাসও আজ আমার কাছে পবিত্র। সেই সমগ্র ভারতভূমি আজ আমার কাছে তীর্থক্ষেত্রের মতো পবিত্র হয়ে উঠেছে।
এরপর দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা শেষে যখন তার জাহাজ ভারতের তীরভূমির নিকটবর্তী হচ্ছিল তখন স্বামীজী আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি জাহাজের ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে হাতদুটি দিয়ে শরীরকে আবেষ্টিত করে আর্দ্র চোখে তটরেখার দিকে অপলকে চেয়েছিলেন। তার কাছে ভারতমাতার মুর্তি যেন চাক্ষুষ প্রতিভাত হয়ে উঠছিল। যেই মাত্র তার জাহাজ নোঙর ফেলল স্বামীজী দ্রুত জাহাজ থেকে নেমে হাঁটু গেড়ে বসে ভারতের মাটি স্পর্শ করে প্রণাম করলেন এবং চরম প্রশান্তির সঙ্গে উচ্চারণ করলেন “আমার যাবতীয় দুর্ভাবনা ও আশঙ্কার অবসান হলো। এই মাত্র আমি আমার ভারতমাতার কোলে এসে পৌঁছলাম।”
এই অতীত পরম্পরা থেকে আমরা আজ কী করে এখানে এসে পৌছলাম যেখানে এই ভারতে জন্ম নিয়ে, এই মানবতার মধ্যে দিয়ে শরীর পুষ্ট করে, আলো বাতাস জলে বড়ো হয়ে উঠে, এখানকার করদাতাদের টাকায় শিক্ষাগ্রহণ করে আমরা আওয়াজ তুলছি ‘ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে’? যে সমস্ত রাজনৈতিক দল ক্ষুদ্র কায়েমি স্বার্থের কারণে এই মানসিকতাকে অন্তরে লালন করে বা নিজেদের অন্তঃসারশূন্য ধ্যানধারণাকে বামপন্থী গোষ্ঠীকে ধার দেয়–তাদের ভাবার সময় এসেছে। সময় এসেছে তাদের আদর্শগত জোচ্চুরিকে পুনর্বিবেচনার মুখে ফেলার। যদি তারা তা না করে ভারতের দেশপ্রেমিক নাগরিকরা তাদের কিন্তু ‘সবক’ শেখাবেই।

ড. মনমোহন বৈদ্য

(লেখক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সহ সরকাৰ্যবাহ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.