ইতিহাস! তুমিও কি ফাঁসুড়ে শিবু ডোমের মতো নেশায় আজও বেহুঁশ? শিবু ডোম কিন্তু আজ আর বেহুঁশ নয়, আজ সে স্পষ্ট করে দিয়েছে সবকিছু। কিন্তু তোমার কী হবে ইতিহাস!
শৈলেশ দে’র উদ্যোগে ১৯৬৯ সালের এক শনিবারে কলকাতার লেক গার্ডেন্সের এক বাড়িতে কয়েকজন পদস্থ ব্যক্তির সহযোগিতায় সেখানে এনে হাজির করা হয়েছিল ফাঁসুড়ে শিবলাল ডোমকে। শিবলাল ডোমের বাড়ি ছিল মজঃফরপুর জেলার বেরিচাপরা গ্রামে। তার মামা বাঁকা ডোমের কাছে সে শিখেছিল ফাঁসি-দেওয়ার পদ্ধতি। শিবুর ছেলে নাটা মল্লিক তো ধনঞ্জয় চ্যাটার্জিকে ফাঁসি দিয়ে মিডিয়ার দৌলতে একসময় রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। মাস্টারদা এবং তারকেশ্বর দস্তিদার-সহ বহু বিপ্লবীর ফাঁসির কারিগর ছিল শিবুডোম। একজন মুন্সেফের উপস্থিতিতে টেপ রেকর্ড চালিয়ে শিবুডোমের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল শৈলেশ দে’র সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে।
বিশ্বের ইতিহাসে কেউ কোনওদিন জেলকোড লঙ্ঘন করে রাতদুপুরে ফাঁসি দেওয়ার প্রহসন ঘটানোর কথা শুনেছে কি? বরাবর ফাঁসি দেওয়া হয় ভোররাত্রে। তাজ্জব কাণ্ড! সেদিন ওখানে ফাঁসি দেওয়া হলে রাতদুপুরে। শিবুডোম সেদিন সবকিছু দেখেছিল, কারণ সেদিন হ্যান্ডেলে হ্যাঁচকা টান মেরে ছিল শিবুডোমই। একই দিনে, একই সঙ্গে, একই ফাঁসির মঞ্চে প্রাণহীন যে দুটি মৃতদেহ ঝুলে ছিল, তাঁরা হলেন মাস্টারদা সূর্য সেন ও সহকারী নেতা তারকেশ্বর দস্তিদার। আইনে আছে গলায় দড়ি পরাবার আগে হাত দুটো পিছমোড়া করে বেঁধে দিতে হবে। কিন্তু ইংরেজ সরকারের কোনও আইন মাস্টারদা এবং তারকেশ্বর দস্তিদার মানেন না। তাই তারা হাত বাঁধতেও দেবেন না। সাহেবদের হুকুমে গোর্খা সৈন্যরা তাদের দুজনকে মারতে লাগল, কিন্তু তাদের হাত বাঁধতে পারল না। তাঁদের মুখে শুধু-বন্দে মাতরম্। সারা রাত ধরে গোটা জেলখানার বন্দি স্বদেশিরা গেয়েছিল— বন্দে মাতরম্। কনডেমড রুমে নিয়ে গিয়ে চলেছিল পাশবিক অত্যাচার, দাঁত ভেঙে, চোখ উপড়ে দুই মৃতদেহকে আনা হয়েছিল আবার সেই ফাঁসির মঞ্চে। বেহুঁশ দুই দেহের হাত বেঁধে, কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে, দড়ির ফাঁস পরিয়ে, হাতল ধরে জোর হ্যাঁচকা টান—ব্যস, শরীর দুটো অদৃশ্য হয়ে নীচে চলে গেল। এরপর এক প্রহসন থেকে আর এক প্রহসনে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। সেদিনের ব্রিটিশ সরকার। গোপনে ব্রিটিশ রণতরী এইচ এম এস এফিংগামে চাপিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে গিয়ে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের শবদেহ দু’টির বুকে পাথর চাপিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছিল। বঙ্গোপসাগরের জলে…।
১২ জানুয়ারি ১৯৩৪ মাস্টারদা সূর্য সেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি হয়েছিল। লোকচক্ষুর অন্তরালে কোর্ট বসিয়ে অতি সাবধানে বিচারের প্রহসন শেষ করা হয়েছিল। ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের ১২১নং ধারায় তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হলো, তা কোনও মামুলি খুনের নয়, অভিযোগ আরও গুরুতর; বলা হলো— “Waging, or attempting to wage war, of abetting waging of war, against the government of India.” —আর অভিযুক্ত দু’জনের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং কল্পনা দত্ত-র বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রইল। দুই মৃতদেহকে ফাঁসির মঞ্চে এনে ঘটানো হলো ফাঁসির প্রহসন মূলক নাটক।
মিথ্যা ইতিহাসের সামিয়ানার তলে স্বাধীনতা দিবসের দিন, গণতন্ত্র দিবসের দিন ঘটা করে বাজানো হয় মুক্তির মন্দির সোপান তলে…।
অপেক্ষা…শুধু অপেক্ষা। দেশের তরণদের জেগে ওঠার অপেক্ষা। জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠার অপেক্ষা। রাষ্ট্ররক্ষার দায়িত্ব নেবার অপেক্ষা। অপেক্ষা সত্যের লক্ষ্যে ইতিহাসকে গড়ে তোলার…। নতুন করে শোনার অপেক্ষা—‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে।’
অমিত ঘোষ দস্তিদার