বিগত কিছু বছর ধরে ভারতের গবেষণা সংস্থা ISRO সাফল্যের সঙ্গে মহাকাশ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। Mars Orbital Mission ছিল ISRO-এর অন্যতম সফল উ ৎক্ষেপণ। উৎক্ষেপণ হয় ৫ নভেম্বর, ২০১৩। মঙ্গল গ্রহে সাফল্যের সঙ্গে মহাকাশযানটি পৌঁছে দেওয়া ছিল বিজ্ঞানীদের কাছে বড়ো চ্যালেঞ্জ। এরপর ছোটো ছোটো উপগ্রহ পাঠিয়ে ISRO গোটা পৃথিবীর মহাকাশ গবেষণায় উল্লেখযোগ্য জায়গা করে নেয়। এরপর ISRO-র বিজ্ঞানীদের গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু হয়— চাঁদ।
কিন্তু হঠাৎ চাঁদ কেন? মহাজগতে তো আরও অনেক গ্রহ নক্ষত্র রয়েছে। তাহলে বিজ্ঞানীদের মনে কি শুধু চাঁদই জায়গা করে নিল? হ্যা সত্যি চাঁদ। চাঁদ নিয়ে মানুষের উৎসাহ উদ্দীপনা চিরন্তন। শুধুমাত্র বিজ্ঞানী বা ভারতীয়রাই নয়— চাঁদ সমগ্র বিশ্ববাসীর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তাই চঁাদ নিয়ে শুরু হয় ISRO বিজ্ঞানীদের পথচলা, গবেষণা। শুধু বাইরে থেকে চাঁদের সৌন্দর্য উপলব্ধি করা বা গবেষণা করা বিজ্ঞানীদের কাজ নয়। তাঁরা দীর্ঘ আলোচনায় স্থির করলেন চাঁদে যাবে ISRO-র ভারতের নামাঙ্কিত মহাকাশযান-চন্দ্রযান-২।
মূলত ২০০৭ সালে ১২ নভেম্বর রাশিয়ার ফেডারেল স্পেস এজেন্সি আর ভারতের গবেষণা সংস্থা ISRO চুক্তি স্বাক্ষর করে চন্দ্রযান-২ নিয়ে। চুক্তিতে স্থির হয় মহাকাশযানটি তিনটি ভাগে তৈরি হবে। ভারতের ইসরো অরবাইটার এবং রোভারের দায়িত্ব নেবে এবং রাশিয়া ল্যান্ডার তৈরির দায়িত্ব নেবে। ২০০৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতে ক্যাবিনেট বৈঠকে এই মহাকাশ গবেষণা চুক্তির সিলমোহর পড়ে। শুরু হয় চন্দ্রযান-২-এর প্রস্তুতি।
তবে চন্দ্রযান-২ কেন? চন্দ্রযান-২ হলো। ভারতের চন্দ্র অভিযানের দ্বিতীয় অধ্যায়। অর্থাৎ ২০০৮ সালে ভারতের গবেষণা সংস্থা চন্দ্রযান-১ চাঁদে পাঠায়। তখন লক্ষ্য ছিল— চাদের পৃষ্ঠে ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালশিয়াম, সিলিকন, আয়রন আছে কিনা জানা অর্থাৎখনিজ পদার্থের উপস্থিতিনির্ধারণ করাই ছিল চন্দ্রযান-১ এর মূল উদ্দেশ্য। তবে চন্দ্রযান-২ অভিযানের ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানীদের গবেষণার উদ্দেশ্য একটু আলাদা। চন্দ্রযান-২ এর মূল উদ্দেশ্য—চাদের মাটিতে জলের অস্তিত্ব খুঁজে বের করা, চাদের আবহাওয়া নির্ধারণ করা, সেই আবহাওয়া জীবনযাপনের জন্য কতটা উপযোগী এবং আদৌ চাদে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি না তার সন্ধান করা। এই উদ্দেশ্যগুলোকে সামনে রেখেই শুরু হলো চন্দ্রযান-২ এর প্রস্তুতি।
২০০৯ সালের আগস্ট মাসে চন্দ্রযান-২ এর নকসা তৈরি করা হয়। সমগ্র মহাকাশ যানটি তৈরি করতে খরচ হয় প্রায় ১৭৮ কোটি টাকা। চন্দ্রযান-২ এর মাধ্যমে চঁাদের কক্ষে স্থাপন করা হবে—জিওসিক্রোনাস স্যাটেলাইট—MK III (GSLV MK III)। এটির তিনটি অংশ রয়েছে লুনার ল্যান্ডার (বিক্রম), লুনার রোভার (প্রজ্ঞান), লুনার আরবাইটার। সমগ্র মহাকাশ যানটির ওজন প্রায় ৩৮৫০ কিলোগ্রাম। GSLV MKIII এখনও পর্যন্ত ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী Satellite বা উপগ্রহ। এটির উচ্চতা ৪৩.৪৩ মিটার।
চন্দ্রযান-২ এর অরবাইটারের ওজন প্রায় ২৩৭৬ কিলোগ্রাম। এর মধ্যে লাগানো অত্যাধুনিক ক্যামেরার মাধ্যমে চাদের পৃষ্ঠ থেকে তথ্য সংগ্রহ করবে। চাদের পৃষ্ঠের প্রায় ১০০ কিলোমিটার উচ্চতায় স্থাপন করা হবে চন্দ্রযানের অরবাইটার। চন্দ্রযানের অন্য অংশটি হলো ল্যান্ডার— যার নাম বিক্রম। এর নামকরণ করা হয়েছে-Dr. Vikram Sarabhai,-এর নামে। এর সঙ্গে তিনটি অত্যাধুনিক ক্যামেরা লাগানো 2016 High Resolution Camera, Lander Hazar Detection Avoidance Camera (LHDAC), Lander Position Detection Camera (LPDC)। চন্দ্রযানের শেষ অংশটি হলো রোভার। রোভারের ওজন মাত্র ২৭ কেজি। এটি ছটি চাকাযুক্ত করা হয়েছে— নাম প্রজ্ঞান অর্থাৎ জ্ঞান। এটি চন্দ্রযানের ল্যান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করবে। এটি প্রধানত খনিজ পদার্থের রাসায়নিক তত্ত্ব ব্যাখ্যা করবে।
চন্দ্রযান-২ গত ২২ জুলাই, ২০১৯ ভারতীয় সময় দুপুর ২টা ৪৩ মিনিটে বিজ্ঞানীদের তথা সমগ্র ভারতবাসীর আশা-প্রত্যাশা নিয়ে পৃথিবী তথা ভারতের মাটি ত্যাগ করে। সমগ্র চন্দ্রযানের অভিযানের নিয়ন্ত্রয়ণ হবে— সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার, ISRO থেকে।
আগামী ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ চন্দ্রযান-২ চাদের কক্ষে পৌঁছবে আর গবেষণা সংক্রান্ত অনেক তথ্য পৌঁছে দেবে ISRO-এর দরবারে। যার ফলে বিজ্ঞানীদের পরবর্তী গবেষণার পথ খুলে যাবে। ISRO বিশ্ববাসীর কাছে নতুন বার্তা পৌঁছে দেবে — তৈরি হবে ভারতীয় মহাকাশচর্চার নতুন ইতিহাস।
অধ্যাপিকা শর্মিষ্ঠা বসু কলকাতার বেহালা কলেজে অধ্যাপনা করেন। পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর শেষ করে মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। এবছর গত ২৭ জুন আমেরিকার বিখ্যাত মহাকাশ গবেষণা সংস্থা NASA স্যাটেলাইটের উপর একটি বক্তৃতা সভার আয়োজন করে, সেখানে তিনি গবেষণাপত্র ‘Nano Satellite নিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পান। তিনি একমাত্র ভারতীয়, যিনি NASA-তে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। ভারতের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে তিনি গর্বিত। এছাড়া গত ২০১৮ সালে অক্টোবর মাসে ভারতের মহাকাশ কেন্দ্র ISRO-তে তাঁর গবেষণাপত্র ‘Aircraft Navigaton-এর উপর বক্তৃতাবিশেষ প্রশংসা পেয়েছিল। ISRO-তে গবেষণাপত্রের উপর বক্তৃতা দেওয়ার জন্য মাইকেল মধুসূদন অ্যাকাডেমি তাঁকে আন্তর্জাতিক পুরস্কার স্বরূপ স্বর্ণপদকে ভূষিত করে।ISRO, NASA ছাড়াও মহাকাশ বিজ্ঞানের গবেষণার উপর তাঁর গবেষণা পত্র জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রকাশিত হয়েছে।
শর্মিষ্ঠা বসু
2019-08-02