চন্দ্রযান-২: চন্দ্রলোকে পাড়ি দিল ভারত, কতখানি লাভ হলো আমাদের?

আমাদের চাঁদকে ছোঁওয়ার ইচ্ছে বহুদিনের। কবিতায় বা সিনেমার পর্দায় চাঁদের দেশে অনেকবার পৌঁছলেও, বাস্তবের যাত্রাটা কিন্তু সবকিছুর মতোই কোনোদিনই সহজ ছিল না। সে প্রযুক্তিগত বা আর্থিক দিক থেকেই হোক কিংবা রাজনৈতিক বা সামাজিক দিক থেকে। ২০০ বছরের ইংরেজশাসনের পর দরিদ্র তৃতীয় বিশ্বের দেশ বলে পরিচিত ভারতের এই অভিযানকে, কিছু বছর আগে হলেও কিছু লোক হয়তো বামন হয়ে চাদে হাত বাড়ানোর’সঙ্গেই তুলনা করতেন। কিন্তু, সময় বদলেছে। বদলেছে আমাদের এই দেশও। সেইইংরেজদের ছাপিয়েই বিশ্বের সাত দেশের মধ্যে একজন হয়ে চাঁদকে ছোঁয়ার স্বপ্ন সত্যি করেছে আমাদের ভারতবর্ষ।
আজ আমরা সবাই বিশ্বের সামনে দেশের এই জয়কে নিয়ে যতই উল্লাস করি না কেন, ‘ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন’ (ইসরো)-র বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং নতুন সরকারের নির্ভীক দূরদর্শিতাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়।
২০০৮ সালে ‘চন্দ্রযান-১’ পৌঁছয় চাঁদের কক্ষপথে। তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল চাঁদের মেরু অঞ্চলের ছবি তোলা ও চন্দ্রপৃষ্ঠের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে সেখানে জলের সন্ধান করা। অনেক ক্ষেত্রেই সে অভিযান সফল হলেও, শেষমেশ আকস্মিক ভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় অনেক কিছুই অধরা থেকে যায়। তারপর অনেক জল গড়িয়ে গেছে। দেশের অন্দরে ঘটে গিয়েছে আমূল পরিবর্তন। বিজ্ঞানীদের তরফ থেকে বারংবার প্রচেষ্টা চালানো সত্ত্বেও, কংগ্রেস সরকার দেশের বৈজ্ঞানিক উন্নতিকর্মে সহযোগিতা করতে ব্যর্থ হয়। চাঁদও চলে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এরপর, ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন নরেন্দ্র মোদী। দেশের ভার কাঁধে নিয়েই বহুবার বিদেশ সফরে যান তিনি। দেখা করেন বিশ্বের তাবড় নেতাদের সঙ্গে। কিছুদিন পরেই দেশের দুর্নীতি রুখতে পুরানো নোট বাতিল করে নতুন নোট প্রকাশের কথা ঘোষণা করেন। তার কিছুদিন পরেই আসে জিএসটি। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য অজস্র রদবদলের পাশাপাশি কাশ্মীরে জঙ্গি সংগঠনগুলির সন্ত্রাসী ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে একটানা লড়াই চালিয়ে যাওয়া, তিন তালাক বিল পাশের মতো একটি সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ এসবই নতুন সরকারকে পুরানোর থেকে আলাদা করে তোলে।
আজকের দুনিয়ায় সাধারণ মানুষ’, ব্যস্ত মানুষ, চাকুরীজীবী বা ব্যবসায়ী, শহুরে বা গ্রামবাসী মানুষ চন্দ্রাভিযান কিংবা জঙ্গি হামলা নিয়ে যতটা চিন্তিত, তার থেকেও বেশি চিন্তিত নিজের অন্নসংস্থান নিয়ে। এই ব্যাপারটারই বরাবর সুযোগ নিয়ে এসেছে বিরোধীপক্ষ। নতুন সরকার যখন প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে পাকা রাস্তা বানাল, অলিতে গলিতে আলো লাগাল, গ্যাসের দাম, তেলের দাম কমিয়ে আনল কিংবা যখন ধনীদের একান্ত মোবাইল ফোন এল বস্তিবাসীর হাতে, সস্তা হয়ে নাগালের মধ্যে এসে গেল ইন্টারনেট পরিষেবা, তখন নাক উঁচু বুর্জোয়াদের একটু হলেও ভুরু কুঁচকেছিল বৈকি। গরিব বড়লোকের মধ্যে বিভেদটা আবছা হয়ে যাচ্ছে যে! চা-ওয়ালার ছেলে প্রধানমন্ত্রী হলে তারা আঙুল তুলে হেসেছিলেন। নোট বাতিল বা জি এস টি চালু হলে বিরোধীপক্ষ তীব্র ক্রোধে দিশেহারা হয়ে ওঠে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আঘাত বর্ষাতে থাকে নতুন সরকারের ওপর। নতুন নিয়মের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে ওঠে প্রশ্ন। টেনে আনা হয় প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরকেও।
পুলওয়ামায় সেনা জওয়ানদের ওপর নির্মম জঙ্গি হানার প্রতিবাদে পাকিস্তানের মাটিতে নেমে সরাসরি সার্জিকাল স্ট্রাইকের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। সেই অভিযান সফল হলেও বিরোধীরা নির্লজ্জর মতো প্রমাণ চেয়ে বসেন।
এরপর, গুজরাটে সারা ভারতের গর্ব সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তি স্ট্যাচু অব ইউনিটি’ যা কিনা গোটা বিশ্বে সর্বাপেক্ষা উচ্চতম মূর্তি হিসেবে পরিচিত, মহাসমারোহে তার স্থাপন হলে বিরোধীরা আবার সদলবলে সরব হন।
সংবাদমাধ্যম স্বপক্ষ ও বিরোধীপক্ষ উভয়ের তর্ক বিতর্কই প্রকাশ্যে আনে। বিরোধীপক্ষের যুক্তি ছিল, দেশের সাধারণ মানুষের কষ্টের টাকাই নতুন সরকার যথেচ্ছভাবে উড়িয়ে জনগণের মনোরঞ্জনের জন্য অলীক জগৎ তৈরির চেষ্টা করছে। তারা আশা করেছিলেন, জনগণ কোনোদিনই নিজের স্বার্থের আগে দেশের স্বার্থের কথা ভাববে না। কিন্তু ততদিনে বিপ্লব ঘটে গেছে দেশের কোনায় কোনায়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে গেছে কালীঘাটের সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়া কিংবা পাটনার সঙ্গে পর্তুগাল। ব্যক্তিস্বার্থ ঝেড়ে ফেলে প্রত্যেক ভারতবাসী যুক্ত হয়ে পড়েছে দেশের ভালো করার কাজে, দেশকে বড়ো করার কাজে।
২০১৯ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য জয়লাভ করল ভারতীয় জনতা পার্টি। আগের থেকেও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিলেন নরেন্দ্র মোদী। উত্তর থেকে দক্ষিণের মানুষ ভরসা রাখলেন গেরুয়া শক্তির ওপরেই। আর গত ২২ জুলাই অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটায় অবস্থিত সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে সারা দেশের মাথা উঁচু করে চন্দ্রলোকের উদ্দেশে পাড়ি দিল ভারতে তৈরি ‘চন্দ্রযান-২’।
শুধু তাই নয়, অন্যান্য দেশের চন্দ্র অভিযানের তুলনায় এর মোট ব্যয় অনেক কম হওয়ায় এটি আরও বড়ো কৃতিত্বের হকদার। চন্দ্রযান-২-এর মোট ব্যয় ৯৭৮ কোটি টাকা বা কমবেশি ১৪২ মিলিয়ন ডলার। মজার বিষয় হলো, হালে মুক্তি পাওয়া হলিউডি সিনেমা অ্যাভেনজার্স এন্ডগেম তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ৫০০০ কোটি টাকা বা কমবেশি ৭৫৬ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এরকম একটা মার্কিন সিনেমার বাজেটে মোটামুটি ৫টা চন্দ্র-অভিযান করার ক্ষমতা ধরে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা।
অভিযান হলো অথচ সারা ভারতবর্ষের কোথাও কেউ না খেতে পেয়ে মরল না। কারও পকেটে এতটুকুও টান পড়ল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও কংগ্রেসের ৪৯ বছরের রাজত্বকালে যা সম্ভব হলো না, তা নতুন সরকার এত কিছু সামলেও মাত্র পাঁচ বছরে কী করে করল বলুন তো?
এখন প্রশ্ন করলে উত্তর তো আসবেই। বিভিন্ন দিক থেকে আসবে। পক্ষে বা বিপক্ষে। অনেকে হয়তো তার যুক্তি খাড়া করতে গিয়ে মোটা মোটা ইতিহাস ভূগোলের নথি খুলে বসবেন। আর সেই অতীতের ঘূর্ণাবর্তে পাক খেতে খেতে হয়তো আমরা আমাদের আগামীকেই ভুলে বসব। তাই খুব বেশি তর্ক বিতর্কে না গিয়ে আসুন দেখে নিই চন্দ্রযান-২ আমাদের জন্য কী কী চমক নিয়ে অপেক্ষা করছে। মানব সভ্যতার উন্নতিকল্পেই বা কী হতে পারে তার অবদান।
• চন্দ্রযান-২ অভিযান নিয়ে যারা এখনও ততটা সন্তুষ্টনন তাদের আরও কিছু তথ্য দেওয়া যাক। বিজ্ঞানীরা শনাক্ত করেছে যে, চাঁদের যেখানে চন্দ্রযান নামবে, সেই অঞ্চলটিতে রয়েছে এক বিপুল ধাতব ভাণ্ডার। যার ভর ৪.৮ কুইন্টিলিয়ন পাউন্ড। মোটামুটি ধরতে গেলে প্রায় গোটা দুই পশ্চিমবঙ্গের সমান আয়তনের মাটির বদলে ধাতু।
• চন্দ্রযান-২ অভিযান সফল হলে,ইসরোই হবে বিশ্বের মধ্যে একমাত্র মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র যারা চাদের দক্ষিণ মেরুতে প্রথমবারের জন্য পদার্পণ করবে। ভারতের জন্য তো বটেই এমনকী, বিশ্বের প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে এটা এক বিরাট পদক্ষেপ। এতে চাদের এক অজানা দিকে আলোকপাত তো হবেই, সঙ্গে পথপ্রদর্শক হিসাবে ভারত পরবর্তীকালে অনেক কিছুর অধিকার অর্জন করতে সক্ষম হবে।
• চন্দ্রযান-২ প্রযুক্তিগত দিক থেকে একটা মাইলফলক তা বলাই বাহুল্য। এটা ইসরোর ক্ষমতা প্রদর্শনের একটা সাফল্যের মাপকাঠি যারা কিনা মহাকাশে শক্তিশালী রকেট পাঠাতে পারে, সেখানে জটিল পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারে, ভারী যন্ত্রপাতি মাধ্যাকর্ষের টান ছাড়িয়ে শূন্য মাধ্যমে চালনা করতে পারে এবং পারদর্শিতার সঙ্গে মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে সংকেত পাঠানো, রাসায়নিক পরীক্ষা, চাঁদের মানচিত্র তৈরি করা, যোগাযোগ ও সেন্সর প্রযুক্তিতে নতুন দিশা দেখাতে সক্ষম। এর ফলস্বরূপ ভারতে তৈরি প্রযুক্তি বিশ্বে আরও মর্যাদা পাবে এবং চীনা প্রযুক্তি থেকে অবশ্যই মুক্তি লাভ করবে ভারতের যান্ত্রিক বাজার।
• ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ ভারত প্রচুর ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টি- স্যাটেলাইট মিসাইলের উৎক্ষেপণ করে। চন্দ্রযান-২-এর সফল উৎক্ষেপণ ভারতের প্রতিরক্ষা ও অস্ত্রভাণ্ডারকে যে আরও মজবুত করবে তা আশা করাই যায়।
• ভারতের শিক্ষার মান বরাবরই বেশ ভালো। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আর্থিক সম্বল যেমন সাহায্য করে তেমনি জরুরি মেধা থাকাটাও। আবার অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার বিভিন্ন প্রকারভেদের মধ্যে সঠিক পথ খুঁজে নেওয়াটাও সমস্যার বিষয়। মহাকাশ বিজ্ঞান এতদিন বিদ্যার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় বিষয় ছিল না। কিন্তু, চন্দ্রযান-২ অভিযানের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা শিক্ষাক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে জনপ্রিয় করে তুললেন। এই অভিযানের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত কুমারের বাড়ি এই বঙ্গের মাটিতেই। প্রত্যন্ত গ্রামের এক কৃষক পরিবার থেকে উঠে এসে এই অসাধ্যসাধন, আগামী বাঙ্গালি প্রজন্মের কাছে এক অনন্যসাধারণ উদাহরণ হয়ে থাকবে।
• বর্তমানে বিশ্বজুড়ে উষ্ণায়ন চলছে। ভারতও তার ভয়াল প্রকোপ থেকে রেহাই পায়নি। চেন্নাই ও মহারাষ্ট্রে ভয়ানক খরার ক্ষত ও দেশের বহুলাংশে বৃষ্টির অভাব আগামীদিনে জলকষ্টের দুঃস্বপ্নের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এখন মাথায় রাখা দরকার চন্দ্রযান ২-এর চঁাদে পাড়ি দেওয়ার অন্যতম মূল উদ্দেশ্য সেখানে জলের সন্ধান করা। এই অভিযান সফল হলে ভারত বিশ্বের জলকষ্টের সমস্যা অনেকটাই মেটাতে পারবে বলে আশা করা যায়। ফলস্বরূপ, আর কোনও বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী আমাদের হতে হবে না।
• জনসংখ্যা বৃদ্ধি ভারতের বহুদিনের সমস্যা। তার সঙ্গে পাল্লা বেড়ে চলেছে বেকারত্ব। প্রত্যেক সরকারের কাছেই এটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। এতগুলো মানুষের জীবিকা নির্ধারণ ও স্বাভবিক জীবন ধারণের জন্য ক্রমাগত অর্থের সরবরাহ খুবই প্রয়োজন। তার জন্য শিল্পের হাত ধরলেই তা দেশের যুবসমাজকে শক্ত জমিতে দাঁড় করাতে পারে। এবং তা দেশের উন্নতির একমাত্র উপায়ও বটে। এই অভিযানের ফলে দেশের প্রযুক্তিতে বিদেশি কোম্পানিগুলি আরও বেশি অর্থ বিনিয়োগ করতে ভরসা পাবে। এছাড়াও বিদেশে ভারতীয়দের কাজ ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ আরও বাড়বে বলেই আশা করা যায়।
ভারত ছুঁয়ে ফেলেছে চাঁদকে। বাস্তবের চাঁদকে। অনেক বাধাটপকে, অনেক পথ পেরিয়ে আসতে হয়েছে। দেশের কোনও প্রান্তেই আজ কোনও অভুক্ত শিশু চাঁদের দিকে ঝলসানো রুটি ভেবে তাকাবে না। আজকের চাঁদ কবিতার চাদের মতোই স্নিগ্ধ। আলো ছড়িয়েছে তার দিকে দিকে। পথ হারালে আর কালো আকাশ হাতড়ে ধ্রুবতারাকে খুঁজতে হবে না। চাঁদ আছে যে। তেরঙ্গা রঙ লেগেছে তার গায়। ভয় কী!
অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.