পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ভারত সরকার লকডাউনের পরামর্শ দিয়েছিলেন গত ২২ মার্চ। করোনাভাইরাসের প্রকোপ রোধে আর কোন উপায় ছিল না। কলকাতা সহ রাজ্যের ২৩টি শহরে লকডাউন ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। রাজ্যের বিশেষ কয়েকটি এলাকা বাদ দিলে সর্বত্র মানুষ সরকারী নির্দেশ মেনে চলছেন। পুলিশ প্রশাসন, হাসপাতালের সর্বস্তরের কর্মী, পৌর এলাকার সাফাই কর্মী সকলেই প্রশংসনীয় ভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করছেন। এখন মূল সমস্যাটা হল এই মানুষদের সুরক্ষার সামগ্রী যোগান দেওয়া। সল্টলেক থেকে বারুইপুর, কোচবিহার থেকে ঝাড়গ্রাম সর্বত্র কর্মীদের হাহাকার পোশাক নেই, স্যানিটাইজার নেই, মাস্ক-এর যোগান নেই, হ্যান্ড গ্লাভস পাওয়া যাচ্ছে না। এর সব কিছুর উৎপাদন ও সরবরাহ রাজ্যের মধ্যেই সম্ভব। কিন্তু হচ্ছে না। পুলিশের কনস্টেবল থেকে আধিকারিক, সাফাই কর্মী থেকে সুপারভাইজার সকলেই ভয়ে গুটিয়ে আছেন। এই ব্যবস্থা নবান্নে বসেই যত্ন নিয়ে করা সম্ভব। তবে তাতে টিভির পর্দায় ছবি দেখা যাবে না।
টিভির পর্দায় ছবি দেখা যাবে এলাকায় এলাকায় জনসম্পর্ক করলে। মুদি দোকান, সবজির দোকানের সামনে একটা বড় বৃত্তের মধ্যে ছোট ছোট বৃত্ত এঁকে মানুষকে হাতে কলমে বোঝালে অশিক্ষিত সবজি বিক্রেতা, অনভিজ্ঞ ক্রেতা, তারা কি আর নিজেরা ঐরকম সমকেন্দ্রিক বৃত্ত আঁকতে পারে? টিভিতে সেটা দেখাবে, তাঁর থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে সকলে গোলের ভেতর গোল আঁকবে। ভাল কথা, কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার হচ্ছে না। ১৪৪ ধারা কাদের কাদের উপর প্রযোজ্য নয়। এ রাজ্যে তো যুবরাজের কনভয়ে কম করে এগারোটা গাড়ি থাকে। এগারোটা গাড়িতে কম করে চার জন করে থাকবেন, মানে চার এগারো চুয়াল্লিশ জন, একশো চুয়াল্লিশ ধারার সেখানেই দফারফা। এরপর দিদিকে বাজারের মধ্যে পেয়ে জনা পঞ্চাশেক ভক্ত সমর্থক না হামলে পড়লে লোকে কী বলবে? প্রশ্ন হল এই ছাড় কতজনের আছে? রাজ্যের সব মন্ত্রী, যুবরাজ, মেয়র পৌর পিতামাতা সকলেরই হয়তো। প্রধান বিরোধী দলের শীর্ষনেতাদের? বামফ্রন্টের জনপ্রিয় নেতাদের জানা নেই। তবে দেশের মধ্যে এটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সত্যি বাংলার গর্ব করার মতো বিষয়!
সারাদিন টিভিতে এলে অনেক অসত্য কথা ফাঁকে ফোঁকরে বলে দেওয়া যায়। যেটা কেবল অসত্যই নয় আজকের পরিস্থিতিতে নিষ্ঠুরও বটে। কোভিড-১৯ কেবল ভারতবর্ষেই নয় পৃথিবীর জন্যই নতুন। তাই এই ভাইরাস চিহ্নিত করার ‘কিট’ আগে থেকে বহু কোম্পানি বানাবে না, সেটাই স্বাভাবিক। ভারতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের নিয়ামক সংস্থা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিকেল রিসার্চ (Indian Council for Medical Research) (ICMR) পুনের এন আই ভি-র মাধ্যমে এই টেস্টিং কিট বানাবার ব্যবস্থা করেছিল। এখন অবশ্য যে কোন সরকারি বেসরকারি কোম্পানি ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ভাইরোলজির অনুমোদন নিয়ে এই পরীক্ষা সামগ্রী বানাতে পারে। সারা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও এই সামগ্রী এসেছে, অবশ্যই অনেক অনেক পরিমাণে আসেনি। কিন্তু এর সাফল্যের জন্য ICMR কোভিড-১৯ টেস্টিং স্ট্রাটেজি দিয়েছিল। বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিকে দিন আলাদা রাখা থেকে নমুনা সংগ্রহ, আক্রান্ত রুগীর সরকারি ট্র্যাকিং আইডি এবং ICMR-NIV-এর কাছে পাঠানো পর্যন্ত। এরাজ্যে কাজ আইনে হয় না, ক্ষমতাবানের পদলেহনে হয়। সরকারি আমলা প্রভাব খাটিয়ে লন্ডন ফেরত ছেলেকে নিয়ে গোটা নগরে কোভিড-১৯ ছড়ালেন। এদিকে ডাক্তারবাবুদের, নার্সদের, ল্যাব সহায়কদের প্রয়োজনীয় অ্যাপ্রন, মাস্ক আর গ্লাভস জুটলো না। সত্যিই বাংলার গর্ব!
অথচ কলকাতা (Kolkata) শহরের মধ্যেই এমন কিছু জায়গার নাম উঠে আসছে, যেখানে লকডাউনের তৃতীয় দিনেও শত শত লোক বাজারে, চায়ের দোকানের সামনে অবাধে ঘুরছে। রাজাবাজার, খিদিরপুরের (Khidirpur) একাধিক ছবি, ভিডিও মানুষকে রীতিমতো আতঙ্কিত করছে। কর্তব্যরত পুলিশকে ঘিরে ধরে মারা হচ্ছে। বারুইপুর থানার মল্লিকপুরেও লকডাউনের সময় জমায়েত যাতে না হয় তা বলতে গিয়েছিলেন বিডিও অফিসের কর্মীরা। তাদের বেধড়ক মারধরের পরে মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। সেখানে গিয়ে কিন্তু কেউ বড় গোলের মাঝখানে ছোট গোল আঁকতে যাননি। এই যে তঞ্চকতা এটা বাঙালির মধ্যে ছিল না। বিধানচন্দ্র রায় (Bidhan Chandra Roy) পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, কেবল বাংলার গর্ব ছিলেন না। ডা. বিধান চন্দ্র রায় (Dr. Bidhan Chandra Roy) ভারতের গর্ব হয়ে উঠেছিলেন।
ধর্মবিশ্বাস একটি গণতান্ত্রিক দেশে ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু সারা পৃথিবীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে করোনা প্রকোপের লকডাউনের নির্দেশ অমান্য করে প্রকাশ্য বক্তব্য রেখেছেন একজন মাত্র ধর্মীয় নেতা সেটা পশ্চিমবঙ্গেই সম্ভব কারণ গতকয়েক বছরে এ রাজ্য জেহাদি মৌলবাদের জান্নাতে পরিণত হয়েছে। তাই যিনি বলেছেন তিনি জানেন যে পুলিশ তাঁর কেশাগ্রও ছুঁতে পারবে না। প্রশ্ন হল বাংলার আসল গর্ব কে?
আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পটি বিশুদ্ধ রাজনৈতিক কারণে এ রাজ্যে রূপায়িত হতে দেয়া হয়নি। আজ আয়ুষ্মান ভারতের সহায়তা থাকলে গ্রামের গরিব মানুষদের এবং শহরের বস্তিবাসীর প্রভূত উপকার হতো। করোনা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার মোট ১লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এই দুঃসময়ে যেন প্রান্তিক মানুষটিও না খেতে পেয়ে কষ্ট না পান তার জন্য যথাসাধ্য প্রচেষ্টা “প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনাতে” প্রতিটি প্রান্তিক কৃষক ২০০০ টাকা করে এবছর এপ্রিল মাসে পাবেন। এই যোজনাতেও গরিব নিম্নবিত্তদের জন্য রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারের দাম সম্পূর্ণ মকুব করা হয়েছে। যে সব বেসরকারি সংস্থায় ১০০ জনের কম কর্মী চাকরি করেন তাদের প্রতিটি কর্মচারীকে সাহায্য দেওয়া হবে। বয়স্ক বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের আগামী তিনমাস ১০০০ টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে। প্রধামন্ত্রী গরিব অন্ন যোজনাতে খাদ্যশস্য, প্রধানত ডাল প্রতিটি পরিবারে মাসে এক কেজি করে দেওয়া হবে। ডাল প্রোটিনের যোগান দেবে। পরিবার পিছু ৫ কেজি চাল বা ৫ কেজি গম দেওয়া হবে। মুগ, ছোলা, অড়হর ইত্যাদি ডালের যোগান বাড়ানো হবে এর জন্য। এইসব যোজনাতে মোট ৮০ কোটি নিম্নবিত্ত ভারতবাসী উপকৃত হবেন। যারা এই লকডাউনের (Lockdown) সময় করোনা মোকাবিলার জন্য সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে কাজ করছেন, সেইসব যোদ্ধাদের জন্য এক অভিনব বীমা প্রকল্প এনেছে সরকার। ডাক্তারবাবু, নার্স, সাফাইকর্মী, পুলিশ প্রশাসনের কর্মীদের মতো সকলের জন্য ৫০ লক্ষ টাকার বীমার ব্যবস্থা করেছেন কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু কেন্দ্রের অর্থ এলেই এ রাজ্যে গরিব মানুষেরা পান না। বিগত কয়েকবছর বাংলার আরো একটি গর্বের বিষয় হয়েছে “কাটমানি”। মিড ডে মিল থেকে অন্ত্যোদয় যোজনার চাল সব জায়গায় গরিব নিরন্ন মানুষের পাওনা থেকে কাটমানি খেয়েছেন রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দলের নেতা কর্মীদের কাটমানি ফেরত দিতে বলেছিলেন। অনেকে ভালো ছেলে, লক্ষ্মী মেয়ের মতো অল্প বিস্তর ফেরতও দিয়েছিলেন।
এই বিপদের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ অর্থ সরবরাহ হতে পারতো, “জন ধন যোজনার” ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। সেক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিরোধিতার জন্য এ রাজ্যে গরিব মানুষদের জন ধন যোজনা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হয়নি। অন্য রাজ্যে সহজে সরাসরি টাকা চলে যাবে। মহিলাদের জন্য জন ধন অ্যাকাউন্টে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। সারা দেশে ৩.৫ কোটি নথিভুক্ত নির্মাণ কর্মীদের জন্য ৩১ হাজার কোটি টাকা রাজ্যগুলিকে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে কেন্দ্র থেকে। কিন্তু এই গর্বের বাংলায় কটা টাকা গরিব মানুষরা পাবেন সেটাই ভাবনার।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর ভালখাবার কবিতায় বলেছিলেন, বলা ভারী শক্ত সবচেয়ে ভালো খেতে গরিবের রক্ত। গরিবের টাকাই চুরি হয়েছে সারদা চিট ফান্ডে। কাটমানির সিংহভাগটাই না খেতে পাওয়া মানুষের মুখের গ্রাস। সারা ভারতে এই গরিব শোষণে এ রাজ্য একেবারে উপরের দিকে। এই বাংলা ভগিনী নিবেদিতা (Sister Nivedita), ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ (Bharat Sevashram Sangha), রামকৃষ্ণ মিশনের (Ramakrishna Mission) সেবা কাজের পুণ্যভূমি। তারা বাংলার গর্ব। আর ওই কাটমানির চক্র বাংলার লজ্জা!
সত্যান্বেষী