চিকিৎসকদের ওপর হামলা কোনোভাবেই অভিপ্রেত নয়

সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর মধ্যে সম্ভবত সর্বাপেক্ষা চমকপ্রদ ঘটনা হলো চিকিৎসকদের ধর্মঘট যা কিনা কলকাতার নীলরতন সরকার হসপিটাল থেকে আরম্ভ হয়ে সর্বভারতীয় রূপ নেয়। সমগ্র ভারতে যেভাবে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল, তা এক কথায় অভূতপূর্ব। এ আই আই এম এস-এর চিকিৎসকরা মাথায় হেলমেট পরে রুগি দেখা শুরু করলেন কলকাতার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়।
হাসপাতালে চিকিৎসকদের উপর হামলার ঘটনা নতুন নয়, রোগীর মৃত্যুর পর চিকিৎসকদের আক্রমণ করা হয়েছে, হাসপাতালে ভাঙচুর হয়েছে, অশান্তি হয়েছে। অনেকবার। কিন্তু এবার ট্রাকবোঝাই হয়ে ২০০ জন জেহাদি দুষ্কৃতী যেভাবে হঠাৎ হাসপাতালে চড়াও হয় ও তাণ্ডব শুরু করে, তা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। পরিবহ মুখোপাধ্যায় নামে এক জুনিয়র ডাক্তারের মাথায় এমন ভাবে আঘাত করা হয় যে সে কোমায় চলে যায়। এর পরেই চিকিৎসকরা কর্মবিরতি শুরু করেন। এনআরএস হাসপাতাল থেকে শুরু করে অন্যান্য সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরাও আন্দোলনে যোগ দেন। জুনিয়র চিকিৎসকরাও প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলেন। বিভিন্ন হাসপাতালে তারা গণ-ইস্তফা দেন। খুব অল্পের। মধ্যেই এই আন্দোলন একটি জাতীয় আন্দোলনের চেহারা নেয়। সাধারণ মানুষের হয়রানি হয়, তবে হাসপাতালগুলিতে জরুরি বিভাগ খোলা রাখা হয়েছিল। বহু চিকিৎসককে হাসপাতালের বাইরে রোগী দেখতে দেখা যায়।
যেহেতু এবার ট্রাকবোঝাই সমাজবিরোধীরা এসে তাণ্ডব চালায় এবং পুলিশকে জানিয়েও কোনও ফল হয়নি, পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে, একজন জুনিয়র চিকিৎসকের প্রাণ সংশয় হয়। সে কারণেই এবার পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে দাঁড়ায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, চিকিৎসকরা ভগবান নন, তাঁদের উপর হামলা করা কোনো মতেই সমর্থনযোগ্য কাজ নয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যদি চাইতেন, খুব তাড়াতাড়িই সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু ইগো- সর্বস্ব মুখ্যমন্ত্রী আন্দোলনকারী চিকিৎসকদেরই নানা ধরনের ধমকানি দিলেন আন্দোলন বন্ধ করার জন্য। কিন্তু গোড়ায় গলদ থেকে গেল। কথা হচ্ছে রোগীর পরিবারের লোকজন কি করে জানলেন যে ভুল চিকিৎসার জন্য একজন অশীতিপর বৃদ্ধ মানুষের জীবনহানি হলো? তারা কি নিজেরা চিকিৎসক? অথবা কোনও প্রকার ইনভেস্টিগেশনের পরে তারা এই সিদ্ধান্তে এসেছে?
বেশ কিছুদিন পরে মুখ্যমন্ত্রী জুনিয়র ডাক্তারদের নবান্নে ডেকে দেখা করলেন, তাদের বক্তব্য শুনলেন। সব টিভি চ্যানেলকে ঢুকতে দিলেন না। তাঁর পছন্দের দুটি মাত্র চ্যানেলকে অনুমতি দিলেন লাইফ কভারেজের জন্য।
শেষ পর্যন্ত জুনিয়র ডাক্তারদের লক্ষ্মীছেলে বলে অভিহিত করে মাথায় হাত বুলিয়ে ছিলেন। ধর্মঘট স্থগিত হলো।
ট্রাক বোঝাই হয়ে যে সমাজবিরোধীরা এসে তাণ্ডব চালিয়েছিল, জুনিয়র ডাক্তাররা তাদের গ্রেপ্তারের দাবি তুলেছিলেন কিনা, জানা যায়নি। যারা একজন ডাক্তারকে মারাত্মক আঘাত করে কোমায় পাঠিয়ে দিল, তাদের শাস্তির দাবি করেছিলেন কি তারা? মিডিয়া মারফত জানা গেল না ওইদিন যারা গুন্ডামি করে চলে গেল বিনা বাধায়, তাদের কী শাস্তি হলো, তাদের প্রতি কোনও অ্যাকশন সরকারের তরফে নেওয়া হলো কিনা। ডাক্তাররাই গুন্ডাদের শাস্তির দাবি করেছিলেন কিনা, তাও জানা গেল না।
এ ব্যাপারে যদি ডাক্তাররা, মিডিয়া, সাধারণ মানুষ চুপ থাকে, তাহলে ওই সমাজ-বিরোধীদের প্রশ্রয় দেওয়া হবে এবং ওই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানো আটকানো যাবেনা। আমজনতার হাতে ক্ষমতা নেই, কিন্তু ডাক্তাররা এই দাবিটা মুখ্যমন্ত্রীরর । কাছে তুললেন না কেন? মিডিয়া এই বিষয়টা নিয়ে সোচ্চার হলো না কেন?
ন্যাশনাল টিভি চ্যানেলগুলি পশ্চিমবঙ্গে ঘটে চলা অন্যায় অবিচারগুলি সদাসর্বদাই তুলে ধরে, সমালোচনা করে, যেটা আমরা বাংলা টিভি চ্যানেলগুলিতে পাইনা, দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। কিন্তু এই ব্যাপারে ন্যাশনাল চ্যানেলগুলিরও কোনও উচ্চবাচ্য দেখা গেল না। জানি না ওই দুষ্কৃতীদের কোনও শাস্তি আদৌ হবে কিনা, না হলে তা হবে আমাদের জন্য অতিশয় দুর্ভাগ্যজনক।
ড. রমা বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.