সেদিন জ্ঞানদার সঙ্গে বাজারে দেখা। বর্ষার বাজারে জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী, জ্ঞানদাকে একটু বাজিয়ে দেখব ভাবছিলাম। আসলে জ্ঞানদা ওনার প্রকৃত নাম নয়। তার আসল নাম যে কী, তাই সবাই ভুলে গেছে। পথে ঘাটে, ট্রামে-বাসে, রকে আড্ডায় স্বল্পকেশ, বছর পঞ্চাশের জ্ঞানদা আসলে অফুরন্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার। সিঙ্গাপুর ভ্রমণ থেকে সিঙ্গাপুরী কলা, ম্যাঞ্চে স্টার ইউনাইটেডের ফুটবল থেকে ন্যাশনাল ইউনিটি সবকিছুই জ্ঞানদার একেবারে যাকে বলে নখদর্পণে। তা সেদিন রবিবার সকালের বাজারে জ্ঞানদাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। গলাটা একটু কেশে সাফ করে জিজ্ঞেস করলুম—কী জ্ঞানদা বাজারদর কী বুঝছো? এখানে বলে রাখি, গত পাঁচ বছরে এই ধরনের অর্থনীতি ঘেঁষা প্রশ্নে জ্ঞানদার উত্তর বেশ পাল্টে যাচ্ছিল।
বছর পাঁচেক আগে হলে সেনমশায়ের অর্থনীতির প্রবল ভক্ত জ্ঞানদা ওয়েলফেয়ার ইকোনমিক্স, সোশ্যাল চয়েস থিয়োরি এসব বোঝাতো।
একবার তো সোশ্যাল চয়েস থিয়োরি অনুযায়ী আমায় উচ্ছে না খেয়ে করলা খেতে বলেছিল। দোষের মধ্যে আমার পদবি কর, আর আমি কী একটা বিষয়ে টাটা, বিড়লাদের সমর্থন করেছিলাম, তাতে জ্ঞানদা বলেছিল তুই বড়োলোকদের চামচা, তোর পদবী কর, টাটা বিড়লাদের সঙ্গে একাসনে বসে তুই করলা হয়ে গেছিস। সোশ্যাল চয়েস। অনুযায়ী কমিউনিস্ট ক্ষুদ্রাকৃতি উচ্ছেকে বাদ দিয়ে তুই পুঁজিপতি করলাই খাবি। তো এহেন। জ্ঞানদা গত পাঁচ-ছ’বছরে অর্থনীতি সংক্রান্ত প্রশ্ন এলেই গোরুর রচনায় চলে যাচ্ছিল। যেমন একদিন জিগ্যেস করলুম আচ্ছা জ্ঞানদা শুনছি একটা সংবাদপত্রে নাকি নিরন্তর লোক ছাঁটাই চলছে, সহ-সম্পাদক থেকে রক্ষী পর্যন্ত?
বাজার করতে এসে আনন্দে তিনি বলে ফেললেন তা হবে না, নোটবন্দিতে কেমন জব্দ হয়েছে— পরক্ষণেই সামনে নিয়ে বললে মোদী সরকার অর্থনীতি ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ব্যর্থ, এর জন্য দায়ী গেরয়াপন্থীদের অসহিষ্ণুতা, অশিক্ষিতামো ইত্যাদি। মানে সমস্ত অর্থনৈতিক থিয়োরি’ শেষ পর্যন্ত তাঁর কাছে অসহিষ্ণুতা, গৈরিকীকরণ, ‘অশিক্ষিত’-এর বেশি আর এগোছিল না।
সেনমশাই যখন বলল — বিজেপি হারলে খুব খুশি হবো, কিন্তু ওরাই জিতবে ভেবে দুঃখ হয়। আমি ভয়ে ভয়ে জ্ঞানদাকে বললুম এটা কী অগণতান্ত্রিক হয়ে গেল না জ্ঞানদা? জ্ঞানদা সটান বললে, দেখলি তুই দিন কে দিন কেমন অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছিস? তা হবিই তো! একে গেরুয়াপন্থী, তারপর অশিক্ষিত। তা সেদিনও বাজারদরের প্রশ্ন করে ভয়ে ভয়ে আছি, আবার তো সেই। অশিক্ষিত, গৈরিকীকরণ, অসহিষ্ণুতা এসবই শুনব। তা তেমনটাই শুনলাম বটে তবে একটু অন্যভাবে, বল দেখি অশিক্ষিত কাকে বলে?’ ভাবলাম সার্টিফিকেট দিয়ে কী শিক্ষিত যাচাই করা যায় গো বলে আমিই একটু না হয় জ্ঞান দেব! তার আগেই ঘনাদা কাম টেনিদার ঢঙে জ্ঞানদা বলে চলল, বাছাধন মনে রাখিস সেনমশাইকে মানলেই শিক্ষিত, না মানলেই অশিক্ষিত।
জিজ্ঞেস করি তা সেনমশাই যদি বলে রাম বাঙ্গলার সংস্কৃতি নয়, মারার জন্য নাকি ‘জয় শ্রীরাম’ ব্যবহৃত হয় তখন পাল্টা যুক্তি দেবনা? জ্ঞানদা ধমকে উঠে বলল রাখ তোর যুক্তি। জেনে রাখ যুক্তিবাদীরা যুক্তি শোনে না, ‘সহিষ্ণু’রা প্রয়োজনে অসহিষ্ণু হয়ে যায়, আমরা কমিউনিস্টরা ভগবানে বিশ্বাস না করলেও ভক্তের তো ভগবান থাকতেই হয়, আমাদের মতো ভক্তের ভগবান তো একজনই রে, তিনি সেনমশাই।
বারবার সেনমশাই, সেমশাই করাতে মিষ্টির খিদেটা কেমন চাগাড় দিয়ে উঠছিল, এবার বুঝতে পেরে বললাম- ও, তুমি অম… জ্ঞানদা ধমকে উঠে বললেন, তুই মর্তেই পড়ে থাক, আমরা এখন অমর্তে। মাথাটা কেমন ভো ভো করছিল। সামলে নিয়ে বললুম কিন্তু জ্ঞানদা এতকাল যে শুনছিলুম এই গেরুয়াপন্থীরা নাকি অসুহিষ্ণু, অশিক্ষিত, এরা মোদীর ভক্ত; এখন তোমরা কেন সেনমশাইয়ের ভক্ত হচ্ছ, অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছো, আচরণেও তো অশিক্ষিতামো ফুটে উঠছে।
জ্ঞানদা কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, শোন তোকে চুপি চুপি বলি, শিক্ষা হচ্ছে একটা ‘বুর্জোয়া’ কনসেপ্ট। জে এন ইউতে আমরা জঙ্গি তৈরি করি দেশবাসীকে অশিক্ষিত বলার জন্য। নইলে কেউ মানবে কেন? অন্যকে অসহিষ্ণু না বললে নিজেদের অসহিষ্ণুতা ঢাকবো কী করে? হিন্দু ধর্মকে আঘাত না করলে সেকুলার ভারত তৈরি হবে। কী করে ? বাঙ্গালিকে আরবীয় সংস্কৃতির ঘোল না খাওয়ালে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করব কী করে? বেশি রাম নাম নিলে যদি সেকুলারিজমের ভূত পালায় বিদেশি লগ্নি ভোগ করব কী করে?
আমি হাঁ করে শুনছিলাম। জ্ঞানদা গলাটা খাদে নামিয়ে বলল— দেখিসনি আমাদের দেবতার মুখোশটা খুলে যেতেই রাজ্য বিজেপি সভাপতির এক নকশালি আই এ এস ‘নেমশেক’ কেমন ঘৃণা ছড়াচ্ছে, প্রতীচীর দধীচি পরিস্থিতি সামলাতে এগিয়ে আসতে বাজারওয়ালারা কেমন ফেসবুকে ‘আজ্ঞা অইসচি কত্তা’ বলে সাড়া দিচ্ছে, কবিকন্যার কলম গেছে থেমে, নকশালি এডিটরের গেঞ্জি গেছে ঘেমে। না থাক, আজ আর বাজার করা হলো না। আনন্দে উল্টে-পাল্টে দেখি গে, রগড়টা— গৌতম আর ঘোষজা আবার কী দিলেন! জ্বলুনি বাড়ল নাকি হে?বিশ্বামিত্র-র কলম
2019-07-12