এ এক অভূতপূর্ব সংকট । পৃথিবীর তাবড় ভৌতিক সম্পদশালী দেশগুলোও দিশাহারা । তুলনায় এখনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে লড়ে যাচ্ছে তথাকথিত উন্নয়নশীল দেশ ভারত (India) । কিন্তু এই লড়াই এতো জটিল ও বিচিত্রমুখি যে শুধুমাত্র রাষ্ট্রেরকাঠামো দিয়ে সম্পূর্ণ বিজয় সম্ভব নয় , সমাজকে আগ্রহ , সামর্থ্য ও অর্থ দিয়ে এই লড়াইয়ে সামিল হতে হবে। শুধু – সরকার কি করলো – এই কৈফিয়ত দাবী না করে আমি বা আমরা কি করছি – সেই প্রশ্নও নিজেদের করতে হবে।
করোনা (Corona) সংক্রমণ প্রতিরোধের অন্যতম প্রধান উপায় ‘লক-ডাউন’ (Lock-down) । ভারতবর্ষের মতো এই বিশাল ও মিশ্র জনগোষ্ঠীর দেশে যে ‘লক-ডাউন’ (Lock-down) হতে পারে তা প্রথমে ভাবাই যায়নি , কিন্তু দীর্ঘ কয়েক সপ্তাহে দেশের মানুষ প্রমাণ করেছে মুখ বুজে কষ্ট সহ্য করেও তারা এই লড়াইএ সামিল হতে চায় । ‘লক-ডাউন’ (Lock-down) – এর ফলে মানুষের যে কি সমস্যা হতে পারে তা বোঝাতে খুব বড় পণ্ডিত হতে হয় না । কিন্তু এই পাহাড় প্রমাণ সমস্যা সমাধানের উপায় সবাই মিলে খুঁজতে হবে। এটা দুর্ভাগ্য যে মুষ্টিমেয় হলেও সমাজের এক শ্রেণীর তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত মানুষ দিনের পর দিন শুধু বলেই চলেছেন – ‘ গরীবের কি হবে ?’ অবশ্যই অন্য সবার থেকে তুলনামুলকভাবে যারা আর্থিক দুর্বল তাদের দুর্ভোগটা একটু বেশিই হবে । কিন্তু এই ‘লক-ডাউন’ (Lock-down) তো তাদের বাঞ্ছানর জন্যেও । তিন সপ্তাহ আগে যখন ‘লক-ডাউন’ (Lock-down) ঘোষণা করা হয়েছিলো তখন ওই ‘আলোকপ্রাপ্ত’ মানুষদের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন – এমন হবেনা তো – করোনার থেকে বেশী মানুষ অনাহারে মারা গেল ! সৌভাগ্যবশত এই লেখার সময় পর্যন্ত একজনও মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গেছেন এমন খবর আসেনি। কারণ শুধু সরকারী ব্যবস্থার মুখাপেক্ষী না হয়ে গোটা সমাজ ঝাঁপিয়ে পড়েছে । অবশ্যই সরকার যথেষ্ট সাহায্য করেছেন কিন্তু দেশ জুড়ে ছোট বড় অসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি চাল , ডাল, খাবার নিয়ে অভাবী মানুষের কাছে পৌঁছে গেছেন তাতে সরকারী ব্যবস্থার ঘাটতিটুকু ঢাকা পড়ে গেছে। তথাকথিত এলিট এন জি ও যারা লোক ক্ষেপানোর ইস্যু পেলে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাদের ততটা দেখা না গেলেও অন্যরা সীমিত সামর্থ্য নিয়ে হাত লাগিয়েছেন। সবাই প্রচার চাননি , ছবি তোলেননি।
দিল্লীর (Delhi) ঘটনার কথা জানা আছে – কিভাবে হটাৎ হাজার হাজার শ্রমিক বাড়ি যাবো বলে আন্তঃরাজ্য বাসস্ট্যান্ডএ ভিড় করেছিলো এবং কয়েকশো কিলোমিটার দূরে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করেছিলো ।অনেকেই প্রমাদ গনেছিলেন ভয়ঙ্কর কিছুর । এরা অসহায় ছিল , আতঙ্কিত ছিল কিন্তু কোন বাস বা ট্রেন জ্বালায়নি , কোন সরকারী অফিস ভাঙচুর করেননি কিমবা পুলিস কে মারধোর করেননি।পরবর্তী সময়ে দেখা গেলো রাস্তার দুধারে এদের জন্য শয়ে শয়ে সাধারন মানুষ জল, খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যতটা ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার আশঙ্কা ছিল ততটা কিছুই ঘটেনি । কারণ গরিব হলেও তারা অনুভূতিহীন নন আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাকী সমাজ ও সরকার এগিয়ে এসেছিলো । সরকার আবার একপ্রস্থ ‘লক-ডাউন’ ঘোষণা করেছেন। বলাই বাহুল্য এর ফলে সামগ্রিক কষ্ট , অসুবিধা , অনিশ্চয়তা ও হতাশা বাড়বে । শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে । ছোট ব্যবসায়ী , শ্রমিক , বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের জীবন দুঃসহ হয়ে উঠবে । শিশুরাও অসহায় মনঃকষ্টের স্বীকার হবে । কিন্তু উপায় কি ? বিকল্প কি ? আগে তো বাঁচতে হবে। এই মুহূর্তে নিজে বাঁচা এবং অন্যকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করাটাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত । অন্যসব পরে দেখা যাবে। চিকিৎসা , খাদ্য সরবরাহের সরবরাহ ও বণ্টন ব্যবস্থা , আইন শৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি কাজ সরকারকে করতেই হবে । বাকী সমাজকে যা করতে হবে তা হোল – সমাজে সম্প্রীতি বজায় রাখা , সামর্থ্য অনুযায়ী পাশের জন কে সাহায্য করা , ‘লক-ডাউন’ কার্যকরী করতে প্রশাসনকে সাহায্য করা এবং দেশ বিরোধী ও সমাজ বিরোধী শক্তি যাতে পরিস্থিতির সুযোগ না নেয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকা । ভবিষ্যৎ কতটা ভয়ঙ্কর ? পরিস্থিতি যত খারাপ হবে ভবিষ্যৎ আরও ভয়ঙ্কর হবে । ব্যাঙ্কের সুদ কমতে পারে , যারা চাকরি করেন তাঁদের বেতন কমতে পারে , বহু মানুষ কাজ হারাতে পারেন , অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে পারেন । আবার হয়তো ততটা কিছু হল না , হয়তো দেশের সরকার অনেকটায় সামলে নিল। সুতরাং যারা ভবিষ্যৎ কত ভয়ঙ্কর হতে পারে সেই অঙ্ক কষতে মাথার চুল ছিঁড়ছেন তাদের বলুন – আগে বর্তমান পরে ভবিষ্যৎ । অনাগত ভবিষ্যতের ভয় দেখিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লোক খ্যাপানোর কাজটিও সুকৌশলে শুরু হয়ে গেছে । সেক্ষেত্রেও আমাদের একই মনোভাব হোক – বর্তমানের মতো ভবিষ্যতেও আমরা রাষ্ট্রের সিধান্তের পাশে থাকবো , নিজের থেকে কিছু ত্যাগ স্বীকার করে অন্যকে আবার জীবনের মুল ধারায় ফিরে আসতে সাহায্য করবো । কষ্টতো হবেই কিন্তু সবাই ভাগ করে নিলে সেই কষ্টের ভার অনেকটাই লাঘব হবে । আমরাই রাষ্ট্র – রাষ্ট্র মানে শুধুমাত্র একটি সরকারী কাথাম নয়। এধরণের জাতীয় বিপর্যয়ের সময় শুধুমাত্র সরকারী কাঠামোকে দোষারোপ করলে দেশ বাঁচবে না , দেশের মানুষ বাঁচবে না ।
- সোমেশ্বর বড়াল