‘ওদের মিথ্যা কথার ফানুস,ফাঁসলো দেখে হাসছে মানুষ’।’
ঐতিহাসিক’ মে দিবস নিয়ে লিখতে বসে প্রথমেই মধু গোস্বামীর লেখা ছড়ার এই লাইনটি মনে পড়ছে।এক সময় বামপন্থীরা বিভিন্ন সভা-সমিতিতে সুর করে এই ছড়াটি গাইতো।বামপন্থীদের দুর্দশা দেখে এখন মনে হয় যে ওদের গাওয়া গানের ধ্বন্নি আজ যেন প্রতিধ্বনি হয়ে ধেয়ে যাচ্ছে ওদের দিকেই।বিশ্বজোড়া কমিউনিষ্ঠ সাম্রাজ্যের ধ্বংস স্তুপ থেকে উঠে আসছে প্রকৃত ইতিহস।
মে দিবস,মহান অক্টোবর বিপ্লবের মতো ওদের দুনিয়া কাঁপানো কর্মসূচী গুলি যে পরিকল্পিত মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়, প্রকাশিত হচ্ছে সেই সত্যও। মান্যতা পাচ্ছে সেই চিরন্তন সত্য, কিছু মানুষকে কিছুদিনের জন্য বোকা বানানো গেলেও সমস্ত মানুষকে দীর্ঘদিন বোকা বানিয়ে রাখা যায় না।
১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা উপযুক্ত মজুরি আর দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন সেটিকে স্মরণ করেই মে দিবস পালিত হয়।ইতিহাস বলছে প্রতিবাদীদের উপর নিয়ন্ত্রন না থাকার জন্য পুলিশের সাথে সংঘর্ষে আন্দোলনটি সমাপ্ত হয় এবং শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে সম্পুর্ন ব্যর্থ একটি আন্দোলনে পরিণত হয়। ইতিহাস বলছে সরকার আট ঘন্টা কাজের দাবি আগেই মেনে নিয়েছিল এবং ইউ এস কংগ্রেস ১৮৬৮ সালে এই বিষয়ে একটি প্রস্তাবও পাশ করে। ১ মে তারিখের ধর্মঘট ছিল শান্তিপূর্ন।
এই ধর্মঘটে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না।মে দিবস স্মরণ করতে গিয়ে যে হিংসাত্বক ঘটনার উল্লেখ করা হয় সেটি ঘটেছিল ৩ ও ৪ মে এবং ১ মে-এর আন্দোলনের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। দুটি বিবদমান শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে অনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলস্বরুপ এই হিংসাত্বক ঘটনা ঘটে ছিল।৩রা মে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী একটি দুর্বল কমিউনিষ্ট গোষ্ঠী ধর্মঘট ডেকে ছিল এবং পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে যাতে চার জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। পরের দিন অর্থাৎ ৪ঠা মে এই ঘটনার প্রতিবাদে হে মার্কেটে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয় । প্রচন্ড বৃষ্টি জন্য প্রতিবাদ সভাটি বাতিল হলেও কিছু ঐ গোষ্ঠীর কিছু মানুষ সেখানে থেকে যায় এবং কর্তব্যরত পুলিশের উপর বোমা নিক্ষেপ করে ।স্বাভাবিক ভাবেই পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। এই ঘটনায় ৪ জন শ্রমিক ও ৭ জন পুলিশ কর্মীর মৃত্যু হয়।এই ঘটনার জেরে চার জনের ফাঁসি ও অনেক ট্রেড ইউনিয়ন নেতার জেল হয়।
এই ঘটনার ফলস্বরুপ যুক্তরাষ্ট্রের দ্রুত বিকাশশীল ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ইতিহাস হে মার্কেটের হিংসাত্বক ঘটনাকে শ্রমিক আন্দোলন হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড ইউনিয়ন গুলি প্রত্যেক সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করে।এক সময় মে দিবস শিশু দিবস হিসেবেও পালিত হতে শুরু করে।১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কমিউনিষ্ট আন্ত্রর্জাতিক ১ মে শ্রমিক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় ।কিন্তু কমিউনিষ্ট দুনিয়াতেই মে দিবস একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে উঠে এবং অবশেষে ১৯০৪ সালে এই দিনটি কে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত পরিত্যাক্ত হয়।রাশিয়াতেই এই দিনটি রাজনৈতিক ভাবে বিভিন্ন দাবি আদায় দিবস হিসেবে উদাযাপিত হতে থাকে ।ফ্যাসিষ্ট হিটলারের আত্মপ্রকাশের পর সমস্ত পৃথিবী ব্যাপি কমিউনিষ্টরা ১৯২৯ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ১ মে’অ্যান্টি ফ্যাসিষ্ট ডে’ পাালন করতে থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী একনায়ক হিটলারের সাথে যোসেফ স্টালিনের জোট তৈরী হয।
স্বাভাবিক ভাবেই কমিউনিষ্টদের পক্ষে আর ১ মে তে হিটলার বিরোধী ‘অ্যান্টি ফ্যাসিষ্ট ডে’ পালন করা করা সম্ভব হচ্ছিল না। মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন স্টালিন এবং ১ মে আবার শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনের ফতোয়া জারি করলেন ।তখন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। শুধু কমিউনিষ্টরাই নয় আইএনটিইউসির মতো কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠন সহ ভারতের বিভিন্ন দলের শ্রমিক সংগঠন প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত না হয়ে ভ্রান্ত প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে ১ মে শ্রমিক দিবস পালন করে আসছে।কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমিক সংগঠন ভারতীয় শ্রমিক সংগঠন গুলির মতো বিভ্রান্ত হয় নি।ফলে বিশ্বের অনেক দেশেই ১ মে দিনটিকে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করে না।
অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ডের মতো উল্লেখ যোগ্য দেশ ছাড়াও বাংলাদেশ , জামাইকা কাজাকিস্থান,ট্রিনিদাদের মতো ছোট ছোট দেশও ১ মে শ্রমিক দিবস পালন করে না।যেমন বাংলাদেশে ‘গারমেন্ট শ্রমিক সংহতি’ নামে একটি সংগঠন ঐ দেশের রাণা প্লাজা বিল্ডিং দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণ করতে প্রতিবছর ২৪ এপ্রিল শ্রমিক নিরাপত্তা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে।
কমিউনিষ্টদের অপপ্রচারে পা না দিয়ে ভারতের সবচেয়ে বড় শ্রমিক সংগঠন ভারতীয় মজদুর সংঘও বিশ্বকর্মা জয়ন্তীতে জাতীয় শ্রমিক দিবস পালন করে থাকে। ভারতের অনেক রাজ্য সরকার বিশ্বকর্মা জয়ন্তীকে সরকারি ভাবে শ্রমিক দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে।ভারতীয় দর্শনে কর্মকে যজ্ঞ হিসেবে দেখা হয়। বিশ্বকর্মা শ্রমের মর্য়দার প্রতীক এবং প্রাচীন কাল থেকে ভারতবর্ষে এই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয়েছে।
ভারতের ইতিহাসের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে যারা ইতিহাস গড়েছেন তার সবাই এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের নিমার্তা হিসেবে বিশ্বকর্মার প্রতি সমর্পনের ভাব নিয়ে কাজ শুরু করতেন। ঋকবেদে উল্লেখ রয়েছে এই বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি যজ্ঞে বিশ্বকর্মা নিজেকে হবি হিসেবে সমর্পন করেছেন।সে জন্যই তিনি দেবতার স্তরে উন্নীত হয়েছেন।তিনি দেবলোকের সবচেয়ে বড় আর্কিটেক্ট হিসেবে পরিচিত।এমন বিশ্বাসও আছে যে বিশ্বকর্মা কোন একজন নিদিষ্ট ব্যাক্তি নন।যে সমস্ত রবণীয় কর্মদক্ষ মানুষ নিজেদের দক্ষতা উজার করে সমাজকে সেবা করে গেছেন তাদেরকে বিশ্বকর্মা নামে অভিহিত করা হয়।পুরাণে উল্লেখ রয়েছে বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র,শিবের ত্রিশুল, ইন্দ্রের রথ,পান্ডবদের জন্য হস্তিনাপুর নগরী,শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরী,রাবনের লঙ্কা, পুস্পক বিমান এই গুলি সবই বিশ্বকর্মার সৃষ্টি। বাস্তুু শাস্ত্র সম্মত নির্মান শাস্ত্র এবং সমস্ত শিল্প কলা বিশ্বকর্মার সৃষ্টি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।তিনিই ছিলেন বিশ্বের প্রথম শ্রমিক এবং শ্রমাচার্য।ভারতবর্ষে এমন অনেক সম্প্রদায় আছে যারা নিজেদের বিশ্বকর্মার উত্তরসূরী বলে মনে করে।ভারতীয় সংস্কৃতিতে তিনি সমস্ত শ্রমজীবি মানুষের আদর্শ স্বরূপ।বিশ্বর্কমার আসুরিক প্রকৃতির ও লোভী পুত্র বৃত্র ছিলেন হিরণ্যকশিপুর সেনাধ্যক্ষ। এই আসুরিক প্রকৃতির পুত্রকে বধ করার জন্য বিশ্বকর্মার নিজেই অস্ত্র তৈরী করে ছিলেন।পুরাণে উল্লেখ রয়েছে যে বিশ্বকর্মা ও দধীচি মুনির সর্বোচ্চ ত্যাগের ফলেই বৃত্রাসুর নিহত হয়েছিল। বিশ্বকর্মার অপর পুত্র নল ছিলেন রামভক্ত। রামায়ণে উল্লেখ আছে নলের তত্বাবধানেই লঙ্কায় যাওয়ার জন্য রামসেতূু নির্মিত হয়েছিল ।আধুনিক শ্রম জগতে বিশ্বকর্মা ভাবনাত্মক পরিবর্তনের প্রতীক। ভারতীয় পরস্পরায় পারিবারিক সম্পর্কের রসায়নের উপর ভিত্তি করে শিল্প গড়ে উঠে।
কর্মকে যজ্ঞ হিসেবে দেখা হয়।ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ শিল্প পরিচালনার ক্ষেত্রে এই পারিবার রসায়ন কে মডেল হিসেবে গ্রহন করেছে এবং এই ধারণা থেকেই ‘শিল্প পরিবার’ শ্লোগানের জন্ম হয়েছে। পশ্চিমি সংস্কৃতিতে শিল্প গড়ে উঠে মালিক শ্রমিক সম্পর্কের ভিত্তিতে ।কমিউনিষ্ট ভাবধারায় শিল্পের সাথে যুক্ত মানুষদের সম্পর্কের রসায়ন তৈরী হয় শ্রেণি শত্রু, শ্রেণি সংগ্রাম তত্ত্ব দিয়ে।ফলে মে দিবসের ভাবনা থেকে উঠে আসা ‘ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও’,’মানছি না মানবো না’ স্লোগান বছরের পর বছর ধরে দেশে দেশে বহু শিল্পের ধ্বংসের কারণ হয়ে শ্রমিক শ্রেনির সর্বনাশ করেছে।বিশ্বকর্মার সমতুল্য মহান কর্মবীরদের জীবন বিশ্লেষন করে তৈরী হওয়া ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পৃক্ত ‘ত্যাগ-তপস্যা-বলিদান’,’কাজই পূজা’, ইত্যাদি শ্লোগান এখন শিল্প জগতের পরিবেশ পাল্টে দিচ্ছে।
ভারতীয় মজদুর সংঘ সহ বিভিন্নজাতীয়তাবাদী শ্রমিক সংগঠন গুলি ১৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বকর্মা পূজোর দিনটিকে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করে।বিশ্বব্যাপি কমিউনিষ্ট সাম্রাজ্যের পতনের সাথে সাথে বিশ্বব্যাপি চালানো ওদের নানা পরিকল্পিত মিথ্যাচার ,ধ্বংসাত্মক কর্মসূচীর মূখোশ উন্মোচিত হচ্ছে। ফলে কমছে মে দিবস নিয়ে উন্মাদনাও।