নুসরতের টিকা নেওয়া, যশের টিকা নেওয়া, পুরসভায় তাঁদের যাওয়া, পুত্রের বার্থ সার্টিফিকেটে শুধু মা’র নাম রাখা নিয়ে এ বি পি আনন্দের উচ্ছ্বাস, আবেগ আজ দেখছিলাম । সিঁড়ি দিয়ে যুগলের ওঠা, তারপর নামা, উচ্ছ্বাস আর থামে না এ বি পি আনন্দের । চুয়ে চুয়ে পড়া । দেখার মত, নুসরতকে নয়, এ বি পি আনন্দকে ।
খবরে কি টান পড়েছে ? সামনে পেলে জানতে চাইতাম সুমন দে’র কাছে । একজন হাই প্রোফাইল জনসমক্ষের বিয়েটা অস্বীকার করেছে বলেই কি এই উচ্ছ্বাস ? জানিনা । সত্যি জানিনা ।
আবারও বলছি লজ্জা হয় ভাবলে জীবনের তিন দশক কাজ করেছি এই প্রতিষ্ঠানে । খুব কাছ থেকে কত রথী, মহারথীকে দেখেছি । প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সত্ত্বা, আঙ্গিক কত রাতের পর রাত পরিশ্রম করে গড়ে তুলেছেন কত প্রতিভাবান লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক । একটা নাম আনন্দবাজার এভাবেই আজ রাজপ্রাসাদে রূপান্তরিত । মানুষের আস্থায়, ভালোবাসায় গড়ে ওঠা চিন্তা ভাবনার এক মহীরুহ । নিজের ছায়া দিয়ে কত কাজকে সম্পূর্ণতা দিয়েছে এক এই প্রতিষ্ঠান । আনন্দবাজার । এক নাম, আজও অদ্বিতীয়, গড়ে উঠেছে কালের নিয়মে বহু রক্তে, ঘামে, পরিশ্রমে ।
আজ তাদেরই এই দৈন্য কেন ?
ভাবি মাঝে মাঝে । এই অকাল মৃত্যুর কারণ কি ?
আমি আনন্দবাজারের আজ কেউ নই । চাকরি স্বেচ্ছায় ছেড়েছি ২০১৬ তে । পূর্ন সময়ে রাজনীতি আর সমাজসেবায় বাকিটা জীবন কাটাব এই ইচ্ছা বোধে । গড়ে তুলব নিজের, একদম নিজের বোধের কথা বলার, লেখার কোন গণ সংবাদ মাধ্যম । সেই ইচ্ছেতেই ৩০ বছরের আনন্দবাজারের সংশ্রব ত্যাগ । প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো । ১৯৮৫ থেকে ২০১৬, প্রায় ৩০ বছরের আত্মীয়তা বিয়োগ যন্ত্রণায় ভুগেছি সেই সময় বহুদিন । তারপর অভ্যস্ত হয়েছি অন্য জীবনে । অনেকটা দূরে গিয়েও আনন্দবাজার আমারই ঘর এই বোধ কিন্তু থেকে গেছে মননে, স্বপ্নে । আজও যখন রাত জাগি, পড়াশুনা আর লেখালিখি করি, ভাবি আনন্দবাজারের বিজ্ঞাপন দফতরের ডেস্কে বসেই করছি । ভোর হওয়ার আগে বাড়ি ফেরার পুল কার ধরতে হবে । এবার উঠি ।
এই বোধ আসলে এক অনাবিল আত্মীয়তার স্বরূপ আর কি ! ছেড়েও যাকে ছাড়তে পারিনি । অদৃশ্য এক সুতোর বন্ধনে যুক্ত আছি সেই এক মহীরুহে, আনন্দবাজার নামের এক প্রতিষ্ঠানে ।
সেই প্রতিষ্ঠানে এক লিফটে উঠেছি sportsorld পত্রিকার সম্পাদক মনসুর আলী খান পতৌদি র সঙ্গে । শিহরিত হয়েছি । করিডোরে কতবার পাশাপাশি হেঁটেছি, মুখোমুখি হয়েছি সুনীল, শীর্ষেন্দু, দিব্যেন্দু পালিত, নীরেন চক্রবর্তী, রমাপদ চৌধুরীর সঙ্গে । ভয়ে ভয়ে ঢুকেছি সাগরময় ঘোষের ঘরে কাজ নিয়ে । ক্যান্টিনে যে টেবিলে বসে বিকেলের চা খেয়েছি কান পেতে পাশের টেবিলে বসে গৌর কিশোর ঘোষ, অরুণ বাগচী, সুনীল বসুর রোমহর্ষক সব আলোচনা গিলেছি । সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের টেবিলে উল্টোদিকে বসে হাতের লেখা দেখেছি । সুব্রত গাঙ্গুলির স্কেচ দেখতে কাজ ফাঁকি দিয়েছি । মতি নন্দীর কথা গিলেছি । চণ্ডী লাহিড়ীর কাছে কত পুরানো কাহিনী মনের ফ্রেমে বন্দী করেছি । এম জে আকবরের হাড় ভাঙা পরিশ্রম দেখেছি । আরও কত কি, কত কি, লিখতে গেলে মন ভার হয়ে আসে ।
কত কারিগরের কত মেহনতে গড়ে ওঠা এক নাম, আনন্দবাজার । তিন দশক ধরে খুব কাছ থেকে যার লালন পালন দেখেছি অভীক সরকারের হাতে । এক তলার লাউঞ্জে অশোক সরকারের ছবির সামনে লিফটের অপেক্ষায় যখনই দেখেছি এই মানুষটিকে শ্রদ্ধায় নত হয়ে যেত মাথা । কত স্মৃতি, মন ভালো রাখা সব স্মৃতি । আত্মীয়তা তো এভাবেই গড়ে উঠেছিল একটা একটা করা অনুভূতিতে । এই আত্মীয়তা ছাড়তে চাইলেও আজ আর কিছুতেই পারিনা । তাই কষ্ট পাই, ভীষণই কষ্ট পাই, যা দেখি এখন, সেটা দেখে ।
কাদের হাতে আজ আনন্দবাজার, এ বি পি আনন্দ ? নুসরতের সন্তানের পিতৃত্ব আড়াল করা মাতৃত্বের বড়াই করা জীবনবোধ প্রচারে যাঁদের আজ এতই উদ্দীপনা ? এত উচ্ছ্বাস, সময় ব্যয় ?
ভাবি মাঝে মাঝে এই আনন্দবাজারই কি আমার ছাড়তে না পারা সেই আত্মীয় ?
জানিনা । হাঁতড়ে বেড়াই সেই উত্তর এক অজানা আকাশে । মন ভারি হয়ে আসে ভাবনার ভারে ।।
সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় (৯৮৩০৪২৬০৭৮)