শতপথ ব্রাহ্মণ অনুযায়ী এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে জলই প্রথম সৃষ্ট হয়। যখন জল বয়ে চলে, তখন অস্তিত্বময় সকল কিছুই উৎপন্ন হয়।
জল ব্যতীত জীবন সম্ভব হতে পারে , তাই জীবনের এই প্রধান রসধারা সম্বন্ধে আমাদের সকলের সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস্ একটা নির্দিষ্ট টারগেট ঠিক করা সত্ত্বেও ২৫০০ কোটি। মানুষ এখনও প্রাথমিক শৌচালয়ের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এদের অর্ধেকই আছে ভারত ও চীনে। পরিশ্রুত জল আগের থেকে বহুলাংশে মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়েছে। এ কথা ঠিক, এ ব্যাপারে মানব সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে অবশ্যই, কিন্তু তা সত্ত্বেও আজও বহু মানুষ পরিশ্রুত জলের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এর ফলে বহু দুরারোগ্য ব্যাধি দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, পেটের অসুখে অসুস্থ হয়ে বহু শিশু অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। এইসব কারণেই Global Interfaith WASH Alliance এগিয়ে এসেছে। বাংলায় বললে সারা বিশ্বের আন্তঃধর্মবিশ্বাসীদের জল, শৌচালয় ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সংগঠন বা মিত্র বন্ধন। ২০১৩ সালে নিউইয়র্ক সিটিতে WASH 207, Water, Sanitation and Hygiene। ইউনিসেফ সেপ্টেম্বর মাসে GIWA সমগ্র পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ ধর্মবিশ্বাসী প্রতিনিধিদের একত্র করেছে। একটি মহৎ উদ্দেশ্য এই প্রয়াসের পিছনে কাজ করেছে সেটি হলো সমগ্র পৃথিবীর মানুষের জন্য পরিশ্রুত জল, শৌচালয়ের সুবিধা ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত প্রকল্পগুলিকে কার্যকরী করা। মানুষকে এই বিষয়গুলির গুরুত্ব সম্বন্ধে সচেতন করতে হবে। বহু মানুষ স্বাস্থ্যসংক্রান্ত মূল বিষয়গুলি সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন নয়, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিও এই সংস্থার অন্যতম উদ্দেশ্য।
এই আন্তঃধর্ম সংগঠনে হিন্দুত্বের প্রতিনিধিত্ব করেছে‘গঙ্গা অ্যাকশন পরিবার। এই পরিবেশ-বান্ধব পরিবার প্রতিষ্ঠা করেন ঋষিকেশের পরমার্থ নিকেতন আশ্রমের প্রধান স্বামী চিদানন্দ সরস্বতী। গঙ্গা অ্যাকশন। পরিবার’গঙ্গা নদীতে যে প্রচুর পরিমাণে দূষিত বর্জ্য বয়ে চলেছে, তার পরিমাণ কমাবার চেষ্টা করে চলেছে।
স্বামী চিদানন্দজী (মুনিজী) জানিয়েছেন যে ভারতে তাদের কাজ ইতিমধ্যে আরম্ভ হয়ে গেছে। হিমালয়ের উত্তরাখণ্ডের ভয়ানক বন্যা হয়ে যাওয়ার পরে আন্তঃধর্ম মৈত্রীবন্ধন লক্ষ্য করেছিল যে বহু মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে অথবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে কেবলমাত্র পরিসুত জলের অভাবে। তাদের কর্মীরা কাজে নেমে পড়েছিল, তারা জল শোধনের ট্যাবলেট ও ফিলটার বণ্টন করেছে, মানুষকে শুদ্ধ জলপানের উপকারিতা সম্বন্ধে অবহিত করেছে। অবশ্যই পানীয়জল যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সে বিষয়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষকে সচেতন করা একান্ত প্রয়োজন। এই সচেতনতা বৃদ্ধির কাজটি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। কর্মীরা সেই কাজটিও করে চলেছে। মুনিজী আরও জানান যে তাঁর কর্মীরা বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়েও কাজ করছে, বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের হাত ধোওয়ার গুরুত্ব কতখানি, তা বোঝাচ্ছে। খাদ্য গ্রহণের আগে হাত ধুয়ে নেওয়া বহু রোগকে ঠেকাতে পারে, এটা ছোটদের বোঝানো হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পরিবেশবান্ধব শৌচালয় তৈরির কাজও তারা করে চলেছে। এই ধরনের শৌচালয়ে বিভিন্ন পরিবার এবং ভ্রমণার্থীদেরও প্রবেশাধিকারের ব্যবস্থা তারা করছে। এইভাবে আমাদের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন হবে, স্বাস্থ্য ও জীবন সুরক্ষিত থাকবে, সেই সঙ্গে নারীর মর্যাদাও অক্ষুন্ন থাকবে।
Community-Led Total Sanitation বা সমাজ পরিচালিত সম্পূর্ণ শৌচ ব্যবস্থা (CLTS) এই প্রকল্পের মূলনীতি। ২০০০ সালে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এরা প্রথম কাজ শুরু করে। এখন পঞ্চাশটি দেশে এরা কাজ করে চলেছে। প্রকৃত অগ্রগতির জন্য CLTS মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাস পরিবর্তনের উপর জোর দেয়। তারা চেষ্টা করছে যাতে গ্রামবাসীরা খেত-খামারে, মাঠে-ঘাটে প্রাতঃকৃত্য সমাপন না করে। এই কাজে যাতে সাফল্য লাভ করা যায়, সেই চেষ্টাই তাঁরা করে চলেছেন।
মুনিজী বলেছেন কীভাবে সমগ্র বিশ্বের ধর্মগুরুরা মানব সমাজে পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করে গেছেন। যুগ যুগ ধরে ধর্মবিশ্বাস থেকেই সামাজিক নিয়ম কানুনের উৎপত্তি। মুনিজী বলেছেন যে, চিরকাল মানুষ। সুখে-দুঃখে আধ্যাত্মিক গুরুর কাছে ছুটে গেছে, জীবনের পরম অর্থ খুঁজতেও তাদের কাছেই গেছে। লোকশিক্ষার কাজটি ধর্মগুরুরাই করেন, তারাই মানুষকে অনুপ্রেরণা জোগান। তাই পানীয় জলের গুরত্ব, পরিষ্কার – পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব আধ্যাত্মিক গুরুর দ্বারাই সমাজে প্রচারিত হয়। তাদের কথা মানুষ ভক্তি সহকারে শোনে এবং মেনে চলে। সে কারণেই মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য নীরোগ জীবনের জন্য পরিশুদ্ধ জলের যে অসীম প্রয়োজনীয়তা, তা এই আন্তঃধর্ম সংগঠনের প্রতিনিধিরাই মানুষকে উপলব্ধি করাচ্ছেন। চিদানন্দ সরস্বতী যাকে সকলে মুনিজী বলে জানে, তিনি এ কথাই জানিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থিত জল ক্রমশ কমে আসছে। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে, জলের অপচয় আমরা করব না। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য-সচেতনতা বৃদ্ধির কাজটিও করে যেতে হবে, যেখানে জলের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
ড. রমা বন্দ্যোপাধ্যায়
2019-09-06