প্রথম:

দক্ষিণ কলকাতায় নাকি একটা সিনেমা হল ছিল টালির নালার আশে পাশে। নামটা মনে পড়ছে না কিন্তু যে সময়ের কথা বলছি সে সময়েও নাকি টালির নালায় অল্প জোয়ার ভাঁটা খেলতো –সত্তরের শেষাশেষিই হবে। তা সেই হলে ছবি দেখার সময়ে মাঝেমাঝেই নাকি হঠাৎ করে বায়োস্কোপ বন্ধ হয়ে যেতো আর গুরুগম্ভীর গলায় এক অমোঘ কণ্ঠধ্বনি ভেসে আসতো-‘পা তুলুন-জল বাড়ছে’ সবাই হুড়মুড় করে পা টা তুলে বাবু হয়ে বসতো- আর খানিকক্ষণের মধ্যেই হলের মেঝে টালির নালার জোয়ারের জলে ভরে যেতো। বায়োস্কোপ আবার দিব্যি চলতো। বেশ খানিক পরে আবার বিরতি এবং দৈববানী- ‘পা নামান, জল সরে গেছে’। লোকে আবার দিব্যি পা নামিয়ে সৌমিত্র-অপর্ণায় মোহিত হয়ে যেতো। মাঝে মাঝে অবশ্য আর্তনাদ শোনা যেতো- হায় হায় আমার জুতো। সে বেচারা পা তোলার সময় স্বভাব্বশতঃ জুতো খুলে পা তুলেছিল, ফলে যা হবার হইয়াছে।

এই গল্পটা শুনেছি আমার শ্রদ্ধেয় গাইডের কাছে। এই কবছরে একটা কথা বুঝেছি, একবার স্কুল কলেজ থেকে বেরিয়ে আসার পর স্যরেদের সঙ্গে দেখা হওয়ার আকর্ষণটা কোন অংশে পুরোনো কফি হাউসের আড্ডার চেয়ে কম নয়। অবশ্য খালি যে মজার গল্পই হয় তা নয়, কিছু কিছু গল্প জীবনের কথাও বলে যায়। একবার স্যর বলেছিলেন, ‘শোন তুমি নতুন টিচার, একটা কথা সর্বদা মনে রাখবে- সাহায্য ভালো কিন্তু স্পুনফীডিং করবে না, সে ছাত্র যতই দুঃস্থ দুর্বল হোক না কেন।

তোমায় একটা গল্প বলি- তিন বন্ধুর কথা- প্রথম বন্ধু ধনবান এবং মেধাবীও। বাকি দুই বন্ধু ততটা মেধাবী নয় কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা তাদের অবস্থাও বেশ খারাপ। তা, দ্বিতীয় বন্ধু আবার প্রথম বন্ধুর খুবই প্রিয় – হরিহর আত্মা যাকে বলে, তৃতীয় অতটাও নয়। ফলতঃ কি হলো, আর্থিক চাপে যখন দ্বিতীয় আর তৃতীয় বন্ধুর ক্লাস বাকি পড়তে লাগল বা টিউশন নিতে পারলো না, প্রথম জন তৃতীয় জনকে কিছু নোটস দিয়ে বা দুই একটা অঙ্ক দেখিয়ে দিয়েই বন্ধুকৃত্য সম্পাদন করল। কিন্তু দ্বিতীয়জনের ক্ষেত্রে সকল অঙ্ক করে দিয়ে, সব ধরে ধরে মুখস্থ করে দিয়ে, মায় পরীক্ষা হলে খাতা দেখিয়ে- মোদ্দা কথা – বন্ধুতার কোন ফাঁক রাখল না। সময় অবশেষে একদিন এলো যেদিন তিনবন্ধুকে তিন পথে চলে যেতে হলো।

প্রথম বন্ধু নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যথা ছিল না। তৃতীয় বন্ধু কিন্তু হয়ে উঠল নাম করা টেকনো আন্ট্রাপ্রুনার, সামান্য সাহায্যকে কাজে লাগিয়ে, খেটে, প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করার যে বাস্তব শিক্ষা সে বন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছিল, সারা জীবন সেটাকে কাজে লাগিয়ে সে একের পর এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। আর অন্যদিকে হারিয়ে গেল দ্বিতীয় জন, পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করার যে সামান্য ক্ষমতাটাও ছিল, সেটাও হারিয়ে নিজের জীবনকে সে শেষ করে দিয়েছিল পঁচিশ পেরোবার আগেই।‘

গত কদিন ধরে কংগ্রেসের ইস্তাহার নিয়ে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে বিবিধ আলোচনা শোনা ইস্তক আমার বারবার স্যরের বলা এই গল্পটাই মনে আসছে। বিজেপির বাৎসরিক ছয়হাজার সাহায্যের প্রতিস্পর্ধায় কংগ্রেস তার ‘ন্যায়’ নিয়ে এসেছে। বাৎসরিক বাহাত্তর হাজারের থলি নিয়ে। আকর্ষণীয় সন্দেহ নেই- অভাবনীয় সন্দেহ নেই- কিন্তু আশার দিশারী কি? আদৌ ন্যায় কি? আমি না হয় নিন্দুকদের এই কথা উত্থাপনই করছি না যে ৬৭ বছরের ইতিহাসে যেখানে কংগ্রেসী শাসনই ৫০ বছর সেখানে কেন তাকে এই বাহাত্তর হাজারী ন্যায় নিয়ে আসতে হচ্ছে? তাহলে যে আর্থিক অসুরক্ষার অন্যায়ের দাবী করছে কংগ্রেস তার ৫০/৬৭ ভাগ দায়িত্ব (৭৫%) কংগ্রেসের। আমি প্রশ্ন করছি যে এই বাহাত্তর হাজার দান কি আদৌ ন্যায় করবে গরীবের প্রতি নাকি তাদের ঠেলে দেবে আরো অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে? দ্বিতীয় বন্ধুটার মতো?

ড:প্রতিবর্ত
সহকারী অধ্যাপক,আইআইটি

পরের অংশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.