গত প্রায় ৬ বছর যাবৎ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে নিরলস প্রচার করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বার বার গিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামিক দেশগুলিতেও। বলেছেন সন্ত্রাসবাদ সভ্যতা বিরোধী এবং সন্ত্রাস গোটা পৃথিবীর সামনেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী তাঁর অনলস প্রচারে মোদী প্রায় কখনই সন্ত্রাসবাদের পিছনে রাডিকাল ইসলামের ভূমিকার কথা সরাসরি উল্লেখ করেন নি। কিন্তু স্পষ্ট করে না বললেও সন্ত্রাস বলতে যে মোদী ইসলামী সন্ত্রাসই ইঙ্গিত করেছেন, এবং সেই অপরাধটির বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য অনবরত প্রয়াস চালিয়ে গিয়েছেন, তা বুঝতে কারুরই অসুবিধা হয় নি। কিন্তু মোদী কখনও সন্ত্রাসের পিছনে রাডিকাল ইসলামের ভূমিকার কথা সরাসরি না বললেও সম্প্রতি টেক্সাসের হিউস্টনে আয়োজিত HowdyModi’র মঞ্চে ইউ এস প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিন্তু সন্ত্রাস বলতে তাঁর নিজস্ব স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আক্রমণ করলেন সরাসরি রাডিকাল ইসলামী সন্ত্রাসকেই এবং স্পষ্টতঃ বললেন যে ইসলামী সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে ভারতের পাশে সর্বাঙ্গীনভাবে থাকবে আমেরিকা। হিউস্টনের মঞ্চে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, বলা যায়, প্রায় সাবধানবাণীই উচ্চারণ করলেন রাডিকাল ইসলামী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। সম্মুখে উপস্থিত সকল সম্মানীয় অতিথিবৃন্দ উঠে দাঁড়িয়ে অফুরন্ত করতালিতে অভিনন্দন জানালেন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে। উঠে দাঁড়ালেন নরেন্দ্র মোদীও। বুঝিয়ে দিলেন ইউ এস প্রেসিডেন্টের এ হেন ঘোষণা তাঁর মনের মত। হিউস্টনের বিশাল স্টেডিয়াম তখন করতালিমুখর হয়ে উঠেছে। সেই স্বতঃস্ফূর্ত করতালিগর্জন থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল রাডিকাল ইসলামী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ চায় আমেরিকাও।
ইউ এস প্রেসিডেন্টের এমত ঘোষণা বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী অনলসভাবে সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন গত প্রায় ৬ বছর ধরে। এবার যদি আমেরিকাও এই প্রয়াসে ভারতের হাত শক্ত করে, তবে বিশ্ব রাজনীতির নাড়ির গতি পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত। সন্ত্রাস ইসলাম ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে অনেকে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইসলামী দেশগুলিকেও স্পষ্টভাবে হয় সন্ত্রাসের পক্ষে নয়ত বিপক্ষে দাঁড়াতে হবে যা কিনা সন্ত্রাসবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বজুড়ে এক মেরুকরণের রাজনীতির জন্ম দেবে বলেই মনে করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী দেশগুলিকেও স্পষ্টভাবে জানাতে হবে তাদের সন্ত্রাসবিষয়ক রাজনৈতিক অবস্থান। যদি কোনো দেশ এর পরেও সন্ত্রাসের পথে চলতে চায়, তবে তাকে হয়ত একাই চলতে হবে সেই পথে এবং মুখোমুখি হতে হতে পারে একা চলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপদেরও।
সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে ও সাযুজ্য বজায় রাখতে ইসলাম যদি সংস্কারের পথে হাঁটার সাহস দেখাতে পারে তবে আধুনিক পৃথিবীর পক্ষে তা হবে অত্যন্ত শুভ। সেক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের সন্ত্রাসের পথ ও বিধর্মীদের প্রতি তাদের আগ্রাসী ও অসহিষ্ণু মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কান্ট্রিজের কর্তব্য হওয়া উচিত কিভাবে ইসলামের এমন সংস্কার সাধন করা যায় যা সমগ্র পৃথিবীর পক্ষে মঙ্গলজনক, তা স্থির করা। এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে সন্ত্রাসের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত যে কোনো ব্যক্তিকে ইসলামী সমাজ থেকে বিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে তাঁদের। কিন্তু সেক্ষেত্রে ইসলামী সমাজটিই হয়ত হয়ে পড়বে বেশ খানিকটা ছোট। অথবা বিশ্বস্তরে সন্ত্রাসবিরোধী চাপের মুখে ইসলামকে দুইটি বিচারধারায় বিভক্ত হতে হবে, সন্ত্রাসপন্থী ও সন্ত্রাসবিরোধী।
বিধর্মীদের প্রতি ইসলামী আগ্রাসনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ প্রস্তুত করছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। দুইটি ইসলামী দেশেই সংখ্যালঘুরা বাঁচে প্রাণ, মান ও সংস্কৃতি বিপন্ন হওয়ার নিরন্তর ঝুঁকির মুখে। অমুসলমান নারীরা ধর্ষিত হয়, অপহৃত হয়, খুন হয় নয়ত বিবাহ করতে বাধ্য হয় ওদেশের কোনো মুসলমান পুরুষকে তার সন্তান জন্ম দিয়ে সে দেশে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির যন্ত্রে পরিণত হওয়ার জন্য। এই ধর্ম-সাংস্কৃতিক বিপদের কথাই কিছুদিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে জানিয়েছিলেন প্রিয়া সাহা, বাংলাদেশের একজন মাইনরিটি, একজন হিন্দু বাঙালী ভদ্রমহিলা।
কিন্তু এতদসত্ত্বেও, পৃথিবীতে অসংখ্য মুসলমান এমন আছেন যাঁরা সন্ত্রাসবাদ সমর্থনও করেন না, সন্ত্রাসে অংশগ্রহণও করেন না। তাঁরা পৃথিবীর যে কোনো অন্য ধর্মের মানুষের মতই শান্তিপ্রিয়। নির্বাচন করার সুযোগ পেলে তাঁরা হয়ত নিশ্চিতভাবেই ইসলামের সন্ত্রাসবিরোধী শাখাকেই স্বেচ্ছায় নির্বাচন করবেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কি তাঁদেরকে অনায়াসে বিশ্বাস করা অমুসলমানদের পক্ষে সহজ হবে? অধিকাংশ মুসলমানই নিশ্চিতভাবেই সন্ত্রাসী নন বা সন্ত্রাসপন্থীও নন। কিন্তু তা সত্ত্বেও গত প্রায় ১৩০০ বছর ধরে ইসলামের আগ্রাসনের ইতিহাস সন্ত্রাসপন্থী, সন্ত্রাসবিরোধী নির্বিশেষে সমস্ত মুসলমানের জন্যই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সম্ভবতঃ এই কারণেই ইউ এস প্রেসিডেন্ট রাডিকাল ইসলামী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা বলায় ‘দ্য ওয়ার’ নামক পত্রিকার সাংবাদিক আরফা খানুম বিতর্কিত টুইট করেছেন যে মোদী ও ট্রাম্প উভয়ের সমর্থকরাই মুসলিমদের ঘৃণা করেন। তাঁর এমন টুইটের জবাবে অবশ্য বহু মানুষ পাল্টা টুইট করে তার প্রতিবাদও করেছেন। তাঁরা বলতে চেয়েছেন যে রাডিকাল ইসলামী সন্ত্রাসের বিরোধিতা করার অর্থ ইসলামের বিরুদ্ধতা করা নয়। আরফা খানুমের দিক থেকে ইসলাম আর রাডিকাল ইসলামী সন্ত্রাসকে এক করে দেখানোর প্রয়াসের তাঁরা নিন্দা করেছেন। কিন্তু বাস্তবে আরফা খানুমের টুইটবার্তার পিছনে ওঁর আশঙ্কাটি হয়ত অমূলক নয়, কারণ সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী মুসলিমরাও যে নীরবে সন্ত্রাসপন্থী মুসলমানদের পাশে দাঁড়াবেন না তার নিশ্চয়তা পাওয়া সম্ভব নয় বলেই বিরোধিতা রাডিকাল ইসলামী সন্ত্রাসের হলেও তার আঁচ সাধারণ নির্দোষ মুসলিমদের ওপরেও আসতে পারে। মানুষ তাঁদের নির্দ্বিধায় বিশ্বাসই বা করবেন কেমন করে? গত প্রায় ১৩০০ বছরে ইসলামের ইতিহাস ঈর্ষা, কাফের-হত্যা, ধ্বংস, লুঠ, ধর্ষণ ও জমিদখলের জন্য অবিমৃশ্যকারীর মত অনবরত সন্তান উৎপাদনের ইতিহাস। অমুসলমান বিধর্মীদের প্রতি আগ্রাসন ও নিষ্ঠুরতার কাহিনী ইসলামী ইতিহাসের পাতায় পাতায় বিধৃত। এ সত্য কঠোর ও তিক্ত হলেও সত্য। সত্য-উপস্থাপন অপ্রিয় হলে উপস্থাপকের প্রতি ক্রুদ্ধ যদি বা হওয়া যায়, অপ্রিয় সত্যটিকে অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করা কদাপি যায় না।
হিউস্টনের মঞ্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও ইউ এস প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপস্থিতিতে বর্তমান পৃথিবীতে যে রাজনৈতিক রসায়নের সূচনা হল, তাতে ইসলামের ইতিহাসই সাধারণ সমস্ত মুসলমানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। ইসলামের আগ্রাসী ট্রাডিশনই অমুসলমানদের বাধা দেবে এমনকি সন্ত্রাসবিরোধী মুসলিমদেরকেও নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারা থেকে।