রাজনৈতিক চাপে কি বিচারের পরিবেশ কি বিঘ্নিত হচ্ছে, প্রশ্ন নানা মহলে

কলকাতা, ২৩ জুন (হি স)। অল্প সময়ের ব্যবধানে সুপ্রিম কোর্টের দুই বাঙালি বিচারপতি মামলা থেকে সরে দাঁড়ালেন। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে নানা মহলে। সাংসদ তথা বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, “বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিচারপতিরা সামাজিক সম্মানের কথা ভেবে বিতর্কে যেতে চাইছেন না। এই ঘটনা দেশের গণতন্ত্র এবং আইনজগতের পক্ষে একটা অশুভ সঙ্কেত।

আদালত অবমাননার অভিযোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গে নতুন নয়। বাম আমলে নন্দীগ্রাম-বিষয়ক হাইকোর্টের রায়ের সমালোচনা করায় সিপিএমের শীর্ষ কিছু নেতার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। এর আগে সিপিএমের বরিষ্ঠ নেতা বিমান বসুর কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অমিতাভ লালা সম্পর্কে একটি মন্তব্যে জল ঘোলা হয়। সেটিতেও আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। রাজ্যে তৃণমূল আসার পর সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়কে রাজ্যের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান করা হয়। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে শাসক দল অসন্তুষ্ট হওয়ায় তাঁকে সরানোর চেষ্টা হয় বলে অভিযোগ। এক ইন্টার্ণ তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেন। অশোকবাবু তা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। এ নিয়ে ‘ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ ওঠে।

যৌন হেনস্থাকাণ্ডে ২০১৩-তে অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি হয়। এর এক্তিয়ার নিয়ে সে বছর ২৪ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পি সদাশিবমকে চিঠি লিখে প্রশ্ন তোলেন অশোকবাবু। চিঠির প্রতিলিপি পাঠান রাষ্ট্রপতির কাছেও। অশোকবাবু যুক্তি ছিল, একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনওরকম ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও এক্তিয়ার যে আদালতের নেই, তা সুপ্রিম কোর্ট নিজেই বলেছে৷ অথচ এই বিষয়ে কমিটি গড়ে তদন্ত করে রিপোর্টও প্রকাশ করা হয়েছে। অশোকবাবুর দাবি, বিচারপতি থাকাকালীন কর্তব্যের খাতিরেই একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মামলায় রায় দিতে হয়েছে তাঁকে, যা বহু ক্ষেত্রেই শাসকদের বিপক্ষে গিয়েছে। তাই প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই তাঁকে এ ভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, টুজি কেলেঙ্কারির একাধিক মামলায় বেঞ্চে ছিলেন তিনি। ১২২টি স্পেকট্রাম লাইসেন্স বাতিল করা-সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ রায়ও দিয়েছেন তিনি৷ এই ঘটনার মাধ্যমে তাঁর ভাবমূর্তি নষ্ট করার চক্রান্ত সেই কারণেই কি না তা নিয়েও পরোক্ষভাবে প্রশ্ন তোলেন অশোকবাবু।

সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের যে দুই বাঙালি বিচারপতি মামলা থেকে সরে দাঁড়ালেন, সেই দুই মামলার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক আছে। এ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া চাইলে অশোকবাবু এই প্রতিবেদককে বলেন, “ওঁরা মামলা থেকে সরে যাওয়া নিয়ে তো কোনও কারণ দেখাননি। তাই আমি কোনও মন্তব্য করব না।“

কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবী সুস্মিতা সাহারায় এই প্রতিবেদককে বলেন, “মামলা থেকে থুই বিচারপতির সরে দাঁড়ানো তাঁদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। সেই এক্তিয়ার তাঁদের আছে। মামলার রায়ে যে কোনও এক পক্ষ খুশি হত। অপর পক্ষ অখুশি হত। আমার মনে হয় এই পরিস্থিতি বিড়ম্বনা মনে হতে পারে ভেবে ওঁরা সরে দাঁড়িয়েছেন।“

বিকাশ ভট্টাচার্য অবশ্য অভিযোগ করেন, “পশ্চিমবঙ্গে বিচারব্যবস্থার ওপর একটা মনস্তাত্বিক চাপ তৈরি করা হচ্ছে। সম্প্রতি চার নেতা-মন্ত্রীকে সিবিআইয়ের গ্রেফতারের দিন কী হয়েছিল সবাই দেখেছেন।“ কিন্তু বাম আমলেও তো রাজ্যের শাসক নেতাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক চাপসৃষ্টির নির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছিল? ‘অল ইন্ডিয়া লইয়ার্স ইউনিয়ন’-এর সর্বভারতীয় সভাপতি তথা ত্রিপুরার প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল বিকাশবাবুর জবাব, “বিচারব্যবস্থার ওপর চাপ তৈরির অভিযোগ বামেদের ওপর ছিল না। বিচারপতি অমিতাভ লালা রাস্তায় মিছিল করা যাবে না বলে নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিমান বসু তার প্রেক্ষিতে বলেন, ‘এবার যদি কেউ বলে লালা তুই বাংলা ছেড়ে পালা’। তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে আমরা মামলায় জিতি। নন্দীগ্রাম-কান্ডে হাইকোর্টের রায়ের সমালোচনা করায় সিপিএমের শীর্ষ কিছু নেতার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। ওটা হাই কোর্টেই আমরা খারিজ করে দিতে পেরেছিলাম।“

অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ ওঠার পরই বিভিন্ন মহল থেকে তাঁর অপসারণের দাবি ওঠে। অশোকবাবুর সমালোচনা করে তাঁর ইস্তফা চায় রাজ্য সরকারও। তবুও ইস্তফা না দেওয়ার বিষয়েই অনড় ছিলেন তিনি।
শেষ পর্যন্ত রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তুলে দেন পদত্যাগপত্র। সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেন, আমি আমার ছাত্রীর বিরুদ্ধে কখনও মানহানির মামলা করব না। তার থেকে বরং জেলে যাব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধারাবাহিকতা কখনওই পছন্দ করতেন না। আমার ঘটনাটা একমাত্র ঘটনা। বাকিরা আমার মতো ভুক্তভোগী হবেন না আশা করি। আমি ওই ইন্টার্নকে আমার শুভকামনা জানাই। নিজের পেশায় সে সাফল্য অর্জন করুক তাই চাই। পদত্যাগের ইচ্ছা আমার ছিল না। পদত্যাগের অর্থ এই নয় যে আমি আমার দোষ শিকার করছি। কখনওই চাইবো না আমার পদত্যাগ আমার দোষের স্বীকারোক্তি বলে ধরা হোক। কুৎসিত স্লোগান, কুশপুতুল জ্বালিয়ে আমার উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই সব কারণেই আমি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি।

বিকাশবাবু এই প্রতিবেদককে বলেন, “বিচারপতিরা স্বাভাবিকভাবেই অবসরের পর শান্তিপূর্ণ জীবন চান।
অতি সম্প্রতি শুনানীর আগেই কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি কৌশিক চন্দ্রর নিরপেক্ষতা নিয়ে রাজ্যের শাসক দল যে পদক্ষেপ করেছে, সেটাও ঠিক নয়। এ রকম ঘটনা ঘটতে থাকলে তা দেশের গণতন্ত্র এবং আইনজগতের পক্ষে একটা অশুভ সঙ্কেত হবে।

অশোক সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.