কি অসাধারণ একটি লেখা, আরও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো কি অসম্ভব ন্যারেটিভ নির্মাণ ৩৪ বছরের কালিমা কে মুক্ত করতে! হয়তো আমাকে চেনে যারা তারা খুব ভালোই জানে আমি ঠিক আনন্দ বাজারে প্রকাশিত লেখাটির মতোই এভাবে বাসে ট্রেনে রাস্তায় বাজারে খেলার মাঠে মানুষের সাথে মিশি, তাদের কথা শুনি আর সেগুলোই লিখে ফেলি… আর এই লেখাটিতে লক্ষ্যণীয় কোথাও কিন্তু লেখা নেই “দুঃখী” কে কেন হকারির জীবন বেছে নিতে হলো? যতদূর পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা বা জেনেছি এই অভিশপ্ত অভিশাপের শিকার হয়েছিলেন সেই দুর্ভাগা রাই যারা গঙ্গা অববাহিকার দুপাড়ে গড়ে ওঠা ৫৫০০০ বন্ধ কলকারখানার সুখী শ্রমিক ছিলেন, যাদের ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরোতো না, যাদের ছেলেমেয়েরা ইস্কুলে যেতো… যাদের ঘরে চোখ ধাঁধানো না হলেও একটা সুস্থ সামাজিক পরিবেশ বেঁচে ছিলো… জানি এ বিষয়ে যদি কোনো লেখা আ.বা.প কে দিই তাহলে ওরা ডাস্টবিনে ফেলে দিতে দুবার ভাববে না, কারণ বাঙালির গরীবি বিক্রি করেই আজ ওদের শতবার্ষিকী অতিক্রান্ত হয়েছে…যাই হোক লেখাটি পড়ুন ????

সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় একবার আমাকে বলেছিলেন,
“লোকাল ট্রেনে বসে খবরকাগজ-বইপত্র পড়বি না। কান খাড়া করে মানুষের কথা শুনবি।”
যতটা পারি উপদেশ মেনেছি, মণিমাণিক্যও পেয়েছি।

বেশ কিছুদিন লোকালে যাতায়াত করতে হয়েছিল। এক চাটনিবিক্রেতা দু’চারটে মজার কথা বলে, তার পর চাটনির প্যাকেট বার করতেন। ওঁর চাটনির নাম ছিল, ‘সুখময় চাটনি’।
এক বার চাটনির প্যাকেটগুলো বের করে বললেন, “স্ত্রী-পরস্ত্রী সই পাতাবে, বউ-শাশুড়িতে ভাব হবে, দুই জা মিলে ম্যাটিনি শোয়ে সিনেমা যাবে – নিয়ে যান বাড়িতে, শুধু উপহার দিন। মেয়েকে মোবাইল ফোন কিনে দিতে পারছেন না? মেয়ের অভিমান? মান ভাঙাতে সুখময় চাটনি।”

ঝুটো গয়না, ঝুঁটি চুল আর ঝিলিক শাড়ি পরা কয়েক জন মহিলা বসেছিলেন।
হকারটি বললেন, “ম্যাডামগণ, বিয়েবাড়ি যাচ্ছেন! নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করে এই সুখময় চাটনি উপহার দিয়ে ওদের জীবনে ছড়িয়ে দিন টক-ঝাল-মিষ্টি সুখময় গুঁড়ো।”
এক জন বয়সীনি বলে ফেললেন, “যাঃ! তাই আবার হয় নাকি?”
হকারটি বললেন, “কেন হয় না? পুরোহিত দর্পণ বা ভারতের সংবিধান – কোথাও তো লেখা নেই বিয়েতে চাটনির প্যাকেট উপহার দেওয়া চলে না।”

রসিক হকারটির সঙ্গে আলাপ করেছিলাম।
বললেন – “বাবা নাম রেখেছিলেন দুখী কিন্তু এই নাম আমি মানতে পারিনি। দুনিয়ায় কী রগড়! রগড় চিপে আনন্দ বার করে নিতে হয়। মারপিট, চুরি, দু’নম্বরি যেমন আছে, ভালোও আছে।
এই তো চালউলি সন্ধ্যা, ট্রেনে পড়ে থাকা একটা বাচ্চাকে ঘরে নিয়ে গেল।
এটুকু বুঝেছি দাদা, জীবনের গায়ে একটু আনন্দের চাটমশলা ছড়িয়ে নিতে হয়। বিতাং করে বলতে পারব নাকো, পড়ালেখা তো করিনি বেশি, তবে দাদা ছেলেটাকে পড়ালেখা করাচ্ছি আর ছেলেটার নাম রেখেছি সুখময়। ছেলেটার নামেই এই চাটনির গুঁড়ো, বিটনুন-আমচুর-গোলমরিচ-মৌরি-আমলকী-যষ্টিমধু-তালমিছরি…”

দুখী একদিন বললেন – “আজ একটা সুখের খবর দেবো। আমার ছেলেটা ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ দিয়েছে। এই সুখের দিনে সুখময় চাটনি ফ্রি, তবে প্যাকেটগুলি ছোট। আমার সুখে আপনারাও ছোট করে ভাগ বসান।”

তারপর হঠাৎ করেই ওই হকারটিকে ট্রেনের কামরায় আর দেখতে পেতাম না। লোকালে নিয়মিত যাতায়াতের প্রয়োজনটাও ফুরোল। তবে মাঝেমধ্যে তো উঠতেই হয়।
সে দিন কানে এল – “কেউ কথা রাখেনি…তেত্রিশ বছর কাটল…কেউ কথা রাখেনি…মহাশয়গণ, এটা তেত্রিশ নয়, চৌত্রিশ করে নিন। এখন চৌত্রিশ বছরটাই বাজারে খাচ্ছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেঁচে থাকলে ওটাকে চৌত্রিশ করে দেবার জন্য ওঁর উপর চাপ আসত। মহাশয়গণ, কেউ কথা না রাখলেও আমি কথা রেখেছি। প্রতি রবিবারের মতোই আপনাদের শরীরে ও মনে একটু রসের জোগান দিতে আমি এসে গেছি…”

ছেলেটাকে দেখি। কম বয়স, চোখে চশমা, বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। কাঁধে ব্যাগ। কী বেচবে ও?
ছেলেটা বলছে – “জীবনে কী পাব না, কী হবে সে ভাবনা? সামনে যা পাচ্ছেন সেটা নিয়ে নিন। আমার কাছে আজ যেটা পাচ্ছেন, আগামী রোববারের আগে পাবেন না। এক প্যাকেট হাসি নিয়ে যান। আনন্দ করুন। দুঃখ-গ্লানি হেসে উড়িয়ে দিন। আপনি যদি বাঙালি হিন্দু হন ছেলের নাম দিন শ্রী হাসিনাথ। মুসলমান হলে হাসব বলে আসলাম কিংবা হেসে খানখান। এক চিনা সুখী লোকের নাম হল কচি হাসি চুংমুং। জাপানি সুখী লোকের নাম কাকা হাসে কাকি হাসে। শ্রীলঙ্কার? মুখ তুলে হাসি তুঙ্গে। নেপালি – হাসুন বাহাদুর। নাইজেরিয়া থেকে এখন ফুটবল খেলোয়াড় আসে। নাইজেরিয়ার লাফিং ক্লাবের সভাপতির নাম কী জানেন? ওমা ওমা হাসিলো। এক সুখী রাশিয়ানের নাম শুনবেন? হাসবো না বলিস কী! কোরিয়ান হাসিখুশি লোকের নাম চোখ বুজে সে কী হাসি! কেনিয়ার সুখী লোকের নাম মুচুকি হাসিবো।

ট্রেন জুড়ে তখন হাসির হিল্লোল।
চোখের তলায় কালি-পড়া প্রৌঢ়টির দিকে লতপত শার্টের হাতা ঝোলা হাত-কাটা মানুষ হাসি ছুড়ে দিচ্ছে, গলায় লোহার চাবি বাঁধা কাছা পরা সদ্য পিতৃহীন ছেলেটিও হাসছে। আমার পাশে বসা সহযাত্রীটি আমায় বললেন, আগের এক রোববার এই ছেলেটির মুখে শুনেছেন, ‘কলকাতার কোন ট্রাফিক সিগনালে কোন রবীন্দ্রসংগীত উপযুক্ত – যেমন ধাপার মাঠে ‘মধুগন্ধে-ভরা’, কিংবা হাওয়া অফিসের সামনে ‘যা হবার তা হবে’।

ছেলেটি বলল, “মাননীয়গণ, এই খুশির প্রদীপে ইন্ধন দরকার, তাই না? যেমন গাড়ির ডিজেল, ধূপের ধুনো। সেই সুখের গুঁড়োর নাম হল – সুখময় চাটনি। সামান্য আলুসিদ্ধতে সুখবৃষ্টির মতো ছড়িয়ে দিন, কিংবা মুড়িতে- দেখবেন আনন্দ কী ভাবে ধরা দেয়। এতে আছে বিটনুন, আমচুর, গোলমরিচ…”

আমি তক্ষুনি কিনলাম এবং বললাম, “সাত-আট বছর আগে এক জন হকার ছিল, নাম তার দুখী, সেও…… কথা শেষ হওয়ার আগেই ছেলেটি বলল, “বাবা ক্যান্সারে। মায়ের টাকা সারদায়। টেট পাশ করেও চাকরি হয়নি। টিউশনি করি, আর রোববারে হকারি। আমিই সুখময়। আনন্দ আর হাসি নিয়ে যা বলি – সব বানানো।

তথ‍্যসূত্র: আ.বা.পত্রিকা
লেখক:স্বপ্নময় চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.