বিরাম নাই, তাঁহার বিরাম নাই। শ্রান্তিহীন তাঁহার রথের গতি। রথচক্রের ঘর্ঘরধ্বনিও তাই হইয়া চলিতেছে অবিরাম। তবে সে ধ্বনি কানে সহসা ধরা দিতে চাহে না। অধরা থাকাই যেন তাঁহার খেলা। তাই কান পাতিতে জানিতে হয়। যোগী কান পাতিয়া ইহার নাম দিয়াছেন ‘অনাহত শব্দ’ । ‘কবির্মনীষী’ কান পাতিয়া নাম দিয়াছেন ‘প্রণবনাদ প্রচণ্ড’ , আর প্রেমিক ? – আর প্রেমিক কান পাতিয়া ‘পান করিয়াছেন’ ব্রজবিপিনবিহারী মুরলীর স্বর।

তথাপি ইহা সত্য যে, সকলেরই ইহা সাধ্যায়ত্ত নহে। শুনিবার একটা যোগ্যতা চাই। তাই তো তাঁহার রথকে তাঁহার সূক্ষ্মরূপটি ছাড়িয়া এত স্থূলরূপে সাধারণের নয়নগোচর হইতে হয়। তখন জনতা তাহাদের মাঝে জগতের নাথকে পাইয়া আনন্দে মাতিয়া ওঠে। তাঁহার রথের রশি স্পর্শ করিয়া, তাঁহার ‘চকা নয়ন’ – এ নয়ন রাখিয়া প্রেমে হৃদয়কে আর্দ্র করে।

যে-রূপটি লইয়া তিনি জগৎ সমক্ষে আসেন সেই রূপটিও বড় অভিনব ! রসিকপ্রবর শ্রীজগন্নাথের উপযুক্ত রূপই বটে ! এই চরাচরে পরিব্যাপ্ত যাঁহার সহস্র বাহু, সহস্র চরণ, সহস্র চক্ষু, সহস্র শির-মুখ ও কর্ণ দেখিয়া শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ‘সর্বতঃ পাণিপাদং তৎ সর্বতোঽক্ষিশিরোমুখম্। / সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি।।’ বলিয়া স্তব করিয়াছেন, অর্জুন সর্বতোপ্রসারী যাঁহাকে প্রণাম করিতে যাইয়া দিশাহীন হইয়া ‘নমঃ পুরস্তাৎ অথ পৃষ্ঠতস্তে নমোঽস্ত্ত তে সর্বত এব সর্ব’ মন্ত্রে বন্দনা করিয়াছে – তাঁহার ইহা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট রূপ আর কী হইতে পারে ! কিন্তু দর্শনেরও যে একটা রীতি আছে তাহাও বোধ করি মর্ত্যমানুষ জানে না। শুধু দর্শন বলিব কেন ? এজগতে সবকিছুরই একটি রীতি রহিয়াছে, যে-রীতিতে চলিলে আচরণ হয় নিত্য কল্যাণবর্ষী। তাই ভক্তবেশে আসিয়া তিনিই সকল কিছু শিখাইয়া যান যুগে যুগে।

নীলাচলের সহিত দুই মহাপ্রভুর কথা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়াইয়া  আছে। একজন শ্রীজগন্নাথ – স্থির দারুব্রহ্ম ; অপরজন শ্রীচৈতন্য – জঙ্গম নারায়ণ। আমরা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শ্রীজগন্নাথদর্শন প্রসঙ্গে আসিব। সাধারণত স্নানযাত্রার পর পনেরো দিন শ্রীজগন্নাথের দর্শন বন্ধ থাকে। আবার প্রতিদিন অন্তত একবার তাঁহাকে দর্শন না করিলে মহাপ্রভুর চলে না। তাই অনেকদিন পর রথযাত্রার পূর্বদিনে  নেত্রোৎসব উপলক্ষে দর্শন শুরু হইলে মহাপ্রভু ব্যাকুলপ্রাণে জগন্নাথকে দেখিতে আসিয়াছেন। এই দীর্ঘ বিরতির পর কিভাবে দর্শন করিতেছেন তাঁহার প্রাণারামকে ? কৃষ্ণদাস কবিরাজ মহাশয় লিপিবদ্ধ করিয়াছেন অতীব প্রেরণাপ্রদ সেই দৃশ্য –

” তৃষ্ণার্ত প্রভুর নেত্র ভ্রমরযুগল।
গাঢ়াসক্ত্যে পিয়ে কৃষ্ণের বদনকমল।।
প্রফুল্ল কমল জিনি নয়নযুগল।
নীলমণি দর্পণ কান্তি গণ্ড ঝলমল।।
বান্ধুলীর ফুল জিনি অধর সুরঙ্গ।
ঈষৎ হসিত কান্তি অমৃত-তরঙ্গ।।
শ্রীমুখ সৌন্দর্য্য মধু বাঢ়ে ক্ষণে ক্ষণে।
কোটি কোটি ভক্ত নেত্রভৃঙ্গ করে পানে।।
যত পিয়ে তত তৃষ্ণা বাঢ়ে নিরন্তর।
মুখাম্বুজ ছাড়ি নেত্র না হয় অন্তর।।”

বিষয়রসতৃষ্ণা জীবনকে শুকাইয়া দেয়। আর ভাগবতরসতৃষ্ণা জীবনপাত্রে অমৃতের তরঙ্গ তোলে। তাই বুঝি তিনি শিখাইলেন – ‘মুখাম্বুজ ছাড়ি’ যেন ‘নেত্র না হয় অন্তর’। শুধু তাহাই নহে, তাঁহার প্রাণপ্রিয় রথযাত্রার কালে শ্রীমন্দির হইতে বাহির হইয়া দিনকয়েক গুণ্ডিচাবাড়িতে অবস্থান করিবেন বলিয়া নেত্রোৎসবের পূর্বেই তিনি স্বয়ং ভক্তবৃন্দকে লইয়া তাহা পরিষ্কার করিয়াছেন। সে মার্জনা এত নিঁখুত ও সুচারু হইয়াছে যে, সে-লীলাকথা লিখিতে গিয়া আর কোন তুলনা না পাইয়া শেষে মহাপ্রভুর অন্তঃকরণের সহিত তাঁহাকে উপমিত করিয়াছেন – “শ্রীগুণ্ডিচামন্দিরমাত্মবৃ- ন্দৈঃ সম্মার্জয়ন্ ক্ষালনতঃ স গৌরঃ।
স্বচিত্তবৎ শীতলম্ উজ্জ্বলম্ চ কৃষ্ণোপবেশৌপয়িকং চকার।।” – গৌরচন্দ্র প্রিয় ভক্তগণের সহিত শ্রীগুণ্ডিচামন্দির মার্জনা করিয়া ও ধুইয়া নিজ শীতল ও উজ্জ্বল হৃদয়ের মতোই সেই মন্দির কৃষ্ণ উপবেশনের যোগ্য করিয়া তুলিয়াছিলেন।

অনুগত রাজভৃত্য তাঁহাকে বলিয়াছিলেন – আমাদের আজ্ঞা দিন, আমরাই ইহা করিয়া দিব। আপনার এই কষ্ট উঠাইবার কোন প্রয়োজন নাই – ‘তোমার যোগ্য সেবা নহে মন্দির – মার্জন’। তথাপি মহাপ্রভুর আগ্রহে তিনি শত ঘট ও সম্মার্জনী আনিয়া দিলেন। ভক্তদের সঙ্গে লইয়া মহাপ্রভু লাগিয়া পড়িলেন মন্দির মার্জনায়, দেখা গেল সকল ভক্ত অপেক্ষা তিনিই অধিক তৃণ-ধূলা-কাঁকর একত্রিত করিয়াছেন। প্রীতিযুক্ত হইলে সামান্য কর্মও শত সৌন্দর্য ছড়াইয়া দেয় – ইহা তাহারই উদাহরণ।

রাজা মহারাজের ( স্বামী ব্রহ্মানন্দ ) জীবনেও এমন একটি ঘটনার উল্লেখ আমরা পাই। তিনি তখন রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রেসিডেন্ট, কাশীতে শ্রীবিশ্বনাথ দর্শনে আসিয়াছেন। সঙ্গে সেবকরাও রহিয়াছেন। ভগবদ্ভাবে বিভোর মহারাজের রাজোচিত গতি উপস্থিত সকলের মনে সম্ভ্রম জাগাইতেছে। সহসা মহারাজ দেখিলেন, বিশ্বনাথের মন্দির-প্রাঙ্গণে একজন ঝাড়ু দিতেছেন। তিনি গিয়া সেই ব্যক্তির কাছে ঝাড়ুটি প্রার্থনা করিয়া স্বয়ং প্রাঙ্গণটি প্রেমভরে ঝাড়ু দিতে লাগিলেন। সামান্য কর্ম,অবতারের পার্ষদের হাতে পড়িয়া অসামান্য রূপ নিল। বিমুগ্ধ প্রত্যক্ষদর্শী লিখিয়াছেন – ঝাড়ু দেওয়াও যে এত সুন্দর দেখাইতে পারে তাহা পূর্বে জানা ছিল না।

এক্ষেত্রেও তাহাই ঘটিয়াছিল। চৈতন্যদেবের মনে হরিষ, চোখে জল, হস্তে সম্মার্জনী – এক অপার্থিব দৃশ্য ! তিনি শিখাইয়া দিলেন সেবা কিরূপে করিতে হয়। 

নীলাচলের সহিত দুই মহাপ্রভুর কথা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়াইয়া  আছে। একজন শ্রীজগন্নাথ – স্থির দারুব্রহ্ম ; অপরজন শ্রীচৈতন্য – জঙ্গম নারায়ণ। আমরা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শ্রীজগন্নাথদর্শন প্রসঙ্গে আসিব। সাধারণত স্নানযাত্রার পর পনেরো দিন শ্রীজগন্নাথের দর্শন বন্ধ থাকে। আবার প্রতিদিন অন্তত একবার তাঁহাকে দর্শন না করিলে মহাপ্রভুর চলে না। তাই অনেকদিন পর রথযাত্রার পূর্বদিনে  নেত্রোৎসব উপলক্ষে দর্শন শুরু হইলে মহাপ্রভু ব্যাকুলপ্রাণে জগন্নাথকে দেখিতে আসিয়াছেন। এই দীর্ঘ বিরতির পর কিভাবে দর্শন করিতেছেন তাঁহার প্রাণারামকে ? কৃষ্ণদাস কবিরাজ মহাশয় লিপিবদ্ধ করিয়াছেন অতীব প্রেরণাপ্রদ সেই দৃশ্য –

” তৃষ্ণার্ত প্রভুর নেত্র ভ্রমরযুগল।
গাঢ়াসক্ত্যে পিয়ে কৃষ্ণের বদনকমল।।
প্রফুল্ল কমল জিনি নয়নযুগল।
নীলমণি দর্পণ কান্তি গণ্ড ঝলমল।।
বান্ধুলীর ফুল জিনি অধর সুরঙ্গ।
ঈষৎ হসিত কান্তি অমৃত-তরঙ্গ।।
শ্রীমুখ সৌন্দর্য্য মধু বাঢ়ে ক্ষণে ক্ষণে।
কোটি কোটি ভক্ত নেত্রভৃঙ্গ করে পানে।।
যত পিয়ে তত তৃষ্ণা বাঢ়ে নিরন্তর।
মুখাম্বুজ ছাড়ি নেত্র না হয় অন্তর।।”

বিষয়রসতৃষ্ণা জীবনকে শুকাইয়া দেয়। আর ভাগবতরসতৃষ্ণা জীবনপাত্রে অমৃতের তরঙ্গ তোলে। তাই বুঝি তিনি শিখাইলেন – ‘মুখাম্বুজ ছাড়ি’ যেন ‘নেত্র না হয় অন্তর’। শুধু তাহাই নহে, তাঁহার প্রাণপ্রিয় রথযাত্রার কালে শ্রীমন্দির হইতে বাহির হইয়া দিনকয়েক গুণ্ডিচাবাড়িতে অবস্থান করিবেন বলিয়া নেত্রোৎসবের পূর্বেই তিনি স্বয়ং ভক্তবৃন্দকে লইয়া তাহা পরিষ্কার করিয়াছেন। সে মার্জনা এত নিঁখুত ও সুচারু হইয়াছে যে, সে-লীলাকথা লিখিতে গিয়া আর কোন তুলনা না পাইয়া শেষে মহাপ্রভুর অন্তঃকরণের সহিত তাঁহাকে উপমিত করিয়াছেন – “শ্রীগুণ্ডিচামন্দিরমাত্মবৃ- ন্দৈঃ সম্মার্জয়ন্ ক্ষালনতঃ স গৌরঃ।
স্বচিত্তবৎ শীতলম্ উজ্জ্বলম্ চ কৃষ্ণোপবেশৌপয়িকং চকার।।” – গৌরচন্দ্র প্রিয় ভক্তগণের সহিত শ্রীগুণ্ডিচামন্দির মার্জনা করিয়া ও ধুইয়া নিজ শীতল ও উজ্জ্বল হৃদয়ের মতোই সেই মন্দির কৃষ্ণ উপবেশনের যোগ্য করিয়া তুলিয়াছিলেন।

অনুগত রাজভৃত্য তাঁহাকে বলিয়াছিলেন – আমাদের আজ্ঞা দিন, আমরাই ইহা করিয়া দিব। আপনার এই কষ্ট উঠাইবার কোন প্রয়োজন নাই – ‘তোমার যোগ্য সেবা নহে মন্দির – মার্জন’। তথাপি মহাপ্রভুর আগ্রহে তিনি শত ঘট ও সম্মার্জনী আনিয়া দিলেন। ভক্তদের সঙ্গে লইয়া মহাপ্রভু লাগিয়া পড়িলেন মন্দির মার্জনায়, দেখা গেল সকল ভক্ত অপেক্ষা তিনিই অধিক তৃণ-ধূলা-কাঁকর একত্রিত করিয়াছেন। প্রীতিযুক্ত হইলে সামান্য কর্মও শত সৌন্দর্য ছড়াইয়া দেয় – ইহা তাহারই উদাহরণ।

রাজা মহারাজের ( স্বামী ব্রহ্মানন্দ ) জীবনেও এমন একটি ঘটনার উল্লেখ আমরা পাই। তিনি তখন রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রেসিডেন্ট, কাশীতে শ্রীবিশ্বনাথ দর্শনে আসিয়াছেন। সঙ্গে সেবকরাও রহিয়াছেন। ভগবদ্ভাবে বিভোর মহারাজের রাজোচিত গতি উপস্থিত সকলের মনে সম্ভ্রম জাগাইতেছে। সহসা মহারাজ দেখিলেন, বিশ্বনাথের মন্দির-প্রাঙ্গণে একজন ঝাড়ু দিতেছেন। তিনি গিয়া সেই ব্যক্তির কাছে ঝাড়ুটি প্রার্থনা করিয়া স্বয়ং প্রাঙ্গণটি প্রেমভরে ঝাড়ু দিতে লাগিলেন। সামান্য কর্ম,অবতারের পার্ষদের হাতে পড়িয়া অসামান্য রূপ নিল। বিমুগ্ধ প্রত্যক্ষদর্শী লিখিয়াছেন – ঝাড়ু দেওয়াও যে এত সুন্দর দেখাইতে পারে তাহা পূর্বে জানা ছিল না।

এক্ষেত্রেও তাহাই ঘটিয়াছিল। চৈতন্যদেবের মনে হরিষ, চোখে জল, হস্তে সম্মার্জনী – এক অপার্থিব দৃশ্য ! তিনি শিখাইয়া দিলেন সেবা কিরূপে করিতে হয়।

” ধূলিধূসর তনু দেখিতে শোভন।
কাঁহো-কাঁহো অশ্রুজলে করে সম্মার্জন।। …
তৃণ ধূলা ঝিকর সব একত্র করিয়া।
বহির্বাসে করি ফেলায় বাহিরে লৈয়া।।
এইমত ভক্তগণ করি নিজবাসে।
তৃণধূলি বাহিরে ফেলে পরম হরিষে।।…
নিজ বস্ত্রে কৈল প্রভু গৃহ সম্মার্জন।
মহাপ্রভু নিজ-বস্ত্রে মার্জিলেন সিংহাসন।।
শত ঘট জলে হৈল মন্দির-মার্জন।
মন্দির শোধিয়া কৈল যেন নিজ মন।।
নির্মল শীতল স্নিগ্ধ করিল মন্দিরে।
আপন হৃদয় যেন ধরিল বাহিরে।।”

শ্রীরামকৃষ্ণ কহিয়াছেন – দীনতাযুক্ত ভক্তি ভগবানের কাছে অতি প্রিয়। রহস্য করিয়া বলিয়াছেন, গরুর কাছে খোল মাখানো জাব যেরূপ প্রিয়, ইহা ঠিক সেইরূপ। অবশ্য কপটদীনতা যাহা ধর্মের বাজারে সর্বত্রই দেখা যায়, তাহার কথা এখানে হইতেছে না। শ্রীরামকৃষ্ণ এপ্রসঙ্গে কপট দুর্যোধনের রাজকীয় আহ্বান উপেক্ষা করিয়া শ্রীকৃষ্ণের দরিদ্র বিদুরের গৃহে শাকান্ন খাইবার কথা বলিতেন। শ্রীমা সারদাদেবীর শ্রীজগন্নাথদর্শনের কথাও এই প্রসঙ্গে উঠিয়া আসে।

শ্রীরামকৃষ্ণভক্ত বলরাম বসুর পরিবারের উড়িষ্যায় জমিদারি ছিল। শ্রীশ্রীমা যখন পুরীতে যান তখন বলরামের ভক্তিমান আত্মীয়গণ তাঁহার জগন্নাথদর্শনের ব্যবস্থা করেন। পাণ্ডা গোবিন্দ শিঙ্গারী স্বয়ং তাঁহাকে লইতে আসেন। ভক্ত পরিবার আয়োজনে কোন ত্রুটি রাখেন নাই, তাঁহার পালকির ব্যবস্থাও করিয়াছিলেন। কিন্তু মা এইভাবে দেবতার কাছে যাইতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি সব দেখিয়া পাণ্ডাকে বলিলেন : ” না, গোবিন্দ, তুমি আগে আগে পথ দেখিয়ে চলবে, আমি দীনহীন কাঙ্গালিনীর মতো তোমার পেছনে পেছনে জগন্নাথদর্শনে যাব ।” দর্শনের পূর্বে মনকে কিরূপে প্রস্তুত করিতে হয়, ইহাই যেন মা শিখাইলেন। শিখাইলেন মহাপ্রভুও। তাঁহারা দেখাইলেন, হৃদয় এমন হইলে বিগ্রহ আর দারুময় থাকে না। কাষ্ঠের আড়াল সরাইয়া জগতের চেতয়িতা বিপুল সমারোহে ভক্তের সম্মুখে দণ্ডায়মান হন। চিরকাল ভক্তের নিকট সে চোখাচোখির আকর্ষণ দুর্নিবার। মাস্টার মহাশয় নিজে পুরীধামে না যাইতে পারিলে রেলস্টেশনে যাইয়া পুরী হইতে আগত ভক্তগণের মুখপানে চাহিয়া থাকিতেন। পরমভক্ত দেখিতেন, দেবদর্শনজনিত পবিত্র ভাবের আভা তখনো তাঁহাদের চোখে-মুখে লাগিয়া আছে। ভক্তগণের নয়নে প্রতিবিম্বিত শ্রীজগন্নাথকে দর্শন করিয়া তিনি তৃপ্ত হইতেন।

রথযাত্রার দিন মহাপ্রভু রাত্রি থাকিতে থাকিতে উঠিয়া পড়িতেন। সতৃষ্ণ-নয়নে দেখিতে থাকিতেন শ্রীজগন্নাথের লীলাবিলাস । আজ পথে নামিয়াছেন তাঁহার সর্বেশ্বর – ‘মণিমা’। যাত্রাপথে তাঁহাকে আনন্দ দিবার জন্য আয়োজন করিতেন কতকিছুর ! স্থানীয় ভক্তগণ ছাড়াও সেই সময় গৌড়দেশ হইতে ভক্তগণ আসিয়া সে আনন্দে যোগ দিতেন। তিনি সেই ভক্তগণকে মাল্য-চন্দন পরাইয়া সাতটি সম্প্রদায়ে ভাগ করিয়া দিতেন। প্রতিটি সম্প্রদায়ে থাকিত একজন করিয়া মূল গায়েন – তাহাকে সহায়তা করিবার জন্য পাঁচজন করিয়া দোহার দিত। এছাড়াও প্রতি সম্প্রদায়ে থাকিত দুইজন করিয়া মৃদঙ্গবাদক এবং কোন একজন বিশিষ্ট ভক্ত শ্রীজগন্নাথকে আনন্দ দিবার জন্য নর্তকরূপে থাকিত।

” সূক্ষ্ম শ্বেত বালুপথ পুলিনের সম।
দুইদিকে টোটো (উদ্যান) সব যেন বৃন্দাবন।।
রথে চড়ি জগন্নাথ করিল গমন।
দুই পার্শ্বে দেখি চলে আনন্দিত মন।।
গৌড় সব রথ টানে করিয়া আনন্দ।
ক্ষণে শীঘ্র চলে রথ ক্ষণে চলে মন্দ।।
ক্ষণে স্থির হৈয়া রহে টানিলে না চলে।
ঈশ্বরেচ্ছায় চলে রথ না চলে কারো বলে।। …
জগন্নাথ আগে চারি সম্প্রদায় গায়।
দুই পাশে দুই, পাছে এক সম্প্রদায়।।
সাত সম্প্রদায়ে বাজে চৌদ্দ মাদল।
যার ধ্বনি শুনি বৈষ্ণব হইল পাগল।।
শ্রীবৈষ্ণব ঘটামেঘে হইল বাদল।
সংকীর্তনামৃত সহ বর্ষে নেত্র-জল।।
ত্রিভুবন ভরি উঠে সংকীর্তন-ধ্বনি।
অন্য বাদ্যাদির ধ্বনি কিছুই না শুনি।। “

আর স্বয়ং মহাপ্রভু এই সাত ‘ঠাঞি’ ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাচিয়া বেড়াইতেন। মুখে থাকিত হরিধ্বনি। কখনো বা দুইহাত তুলিয়া ‘জয় জয় জগন্নাথ’ বলিয়া হুঙ্কার দিয়া ভাবে মগ্ন হইতেন। সেই অপূর্ব “কীর্তন দেখিয়া জগন্নাথ হরষিত।কীর্তন দেখেন রথ করিয়া স্থগিত।” এইভাবে রথ ধীরে ধীরে গুণ্ডিচা মন্দির-প্রাঙ্গণে পৌঁছিলে মহাপ্রভু সকল সম্প্রদায় একত্র করিয়া কখনো কখনো উদ্দণ্ড নৃত্যে প্রবৃত্ত হইতেন। কখনো বা নৃত্যের বিরতিতে শ্রীজগন্নাথকে দণ্ডবৎ প্রণতি জানাইয়া হাতজোড় করিয়া ঊর্ধ্বমুখ হইয়া জগতের প্রভুর জয়গান করিতেন –

” জয়তি জয়তি দেবো দেবকীনন্দনোঽসৌ
জয়তি জয়তি কৃষ্ণো বৃষ্ণিবংশপ্রদীপঃ।
জয়তি জয়তি মেঘশ্যামলঃ কোমলাঙ্গো
জয়তি জয়তি পৃথ্বীভারনাশো মুকুন্দঃ।।”

– জয় হোক দেবকীনন্দনের, জয় হোক বৃষ্ণিবংশের প্রদীপের। জয় হোক মেঘশ্যামল কোমলাঙ্গের, জয় হোক মুকুন্দের, যিনি পৃথিবীর ভার লাঘবের জন্য অবতীর্ণ হইয়াছেন।

কখনো বা দীনতামাখা স্তুতি করিতেন – আমি বিপ্র নহি, নহি কোন নরপতি; নহি ব্রহ্মচারী কিংবা গৃহপতি। আমার পরিচয় বাণপ্রস্থে বা সন্ন্যাসেও নহে। আমি পূর্ণরূপে প্রকাশিত নিখিল পরমানন্দের সুধাসমুদ্রের ন্যায় গোপীজনবল্লভ শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলের দাসানুদাসের অনুদাস মাত্র –

” নাহং বিপ্রো ন চ নরপতি-
র্নাপি বৈশ্যো ন শূদ্রো
নাহং বর্ণী ন চ গৃহপতি-
র্নো বনস্থো যতির্বা।
কিন্তু প্রোদ্যন্নিখিল পরমা-
নন্দপূর্ণামৃতাব্ধে-
র্গোপীভর্ত্তুঃ পদকমলয়ো-
র্দাসদাসানুদাসঃ।।”

কখনো বা তিনি ব্রজগোপিনীর ভাবে আবিষ্ট হইয়া রথোপরি জগন্নাথরূপী শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশে কত না অনুনয় করিতে লাগিলেন ! কখনো মহাভাবের প্রাবল্যে নিজেকে আর স্থির রাখিতে না পারিয়া উদ্দণ্ড নৃত্য করিতে লাগিলেন, আর ভক্তিশাস্ত্রে বর্ণিত অষ্ট সাত্ত্বিক বিকারসমূহ তাঁহার দেবদেহকে আশ্রয় করিয়া প্রকাশিত হইয়া পড়িল !

” প্রভুর শরীর যেন শুদ্ধ হেমাচল।
ভাব-পুষ্পদ্রুম তাতে পুষ্পিত সকল।”

এই পবিত্র দৃশ্য যাহারাই দেখিল তাহাদের অন্তরে ভগবৎপ্রেম উছলিয়া উঠিল।

শ্রীভগবান যখন নূতনরূপে আসেন – তখন আসেন আরও পূর্ণতর রূপ লইয়া। তাঁহার সঙ্গে থাকে নবযুগের জন্য নবতর কোন বার্তা। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে তাঁহার পূর্ব লীলায় অনুষ্ঠিত মহাভাবের উচ্ছ্বাস, শ্রীজগন্নাথের প্রতি অতলান্ত প্রেম তো ছিলই, তদুপরি তাঁহার দৈবী জীবনে ছিল বর্তমানকালের উপযোগী সাধন-সঙ্কেত।

শ্রীরামকৃষ্ণ একবার পঞ্চবটীর নিকটে শ্রীজগন্নাথকে সহসা সম্মুখে দেখিয়া তাঁহাকে ভাবাবেশে আলিঙ্গন করিতে যান এবং পড়িয়া হাতে গুরুতর চোট পান। শ্রীরামকৃষ্ণ এই ঘটনার প্রসঙ্গে পরবর্তিকালে বলিয়াছেন :

” জগন্নাথের সঙ্গে মধুরভাবে আলিঙ্গন করতে গিয়ে হাত ভেঙে গেল। জানিয়ে দিলে – ‘তুমি শরীরধারণ করেছ – এখন নররূপের সঙ্গে সখ্য,বাৎসল্য এইসব ভাব লয়ে থাকো।’ ” শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলা ইহারই বিস্তৃত ব্যাখ্যা। যে দেহকে ভুলিয়া জগতের নাথকে তিনি আলিঙ্গন করিতে গিয়াছিলেন, সেই দেহকে ভুলিয়াই কোটি কোটি জগন্নাথের পূজায় তিনি প্রাণার্পন করিয়াছিলেন।

শ্রীজগন্নাথ শুধু মূর্তিবিশেষে সীমাবদ্ধ নাই। তিনি তাঁহার সৃষ্ট এই জগতে ওতপ্রোত হইয়া রহিয়াছেন। চন্দ্র-সূর্য, আকাশ-সমুদ্র লইয়াই তাঁহার বিরাটমূর্তি। তবে মানুষেই তাঁহার প্রকাশ অধিক। যিনি পূজার বেদীতে বসিয়া আছেন, তিনিই রহিয়াছেন রাস্তায়-মাঠে-বাজারে, শ্রমে-কর্মে-ঘর্মে। উপাসনা হউক তাঁহাদেরও। তবেই হইবে চিত্তশুদ্ধি। মন হইবে বাসনাহীন। রথস্থ জগন্নাথকে দর্শনের ফল ফলিবে তখনই, যখন দর্শন মিলিবে সর্বঘটস্থ ‘বামনদেব’-এর। তখনই কর্ণে নিত্য অনুরণন তুলিবে অনাহত রথচক্রধ্বনি। জগন্নাথের অঙ্গসুরভি মিলিবে শান্তিতে, সাম্যে ও সর্বজীবের প্রতি গভীর সহানুভূতিতে। ইহাই নবযুগবার্তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.