Science can afford to wait but Swaraj can not।’- P.C.Roy

রসায়নের ক্লাস। ছাত্রদের সামনে এক টুকরো হাড় হাতে নিয়ে বুনসেন বার্নারে পুড়িয়ে মুখে পুরে দিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ছাত্রদের শেখালেন, এটা ক্যালসিয়াম ফসফেট। এছাড়া আর কিছুই নয়। সেটা কোন প্রাণীর হাড় তা-ও আর চেনার উপায় রইল না।

ভুবনমোহিনী দেবী ও হরিশচন্দ্র রায়ের পুত্র প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তৎকালীন যশোর জেলার (বর্তমানে খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলা) রাড়ুলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা হরিশচন্দ্র রায় ছিলেন স্থানীয় জমিদার। বনেদি পরিবারের সন্তান প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের পড়ালেখা শুরু বাবার প্রতিষ্ঠিত এমই স্কুলে। ১৮৭২ সালে তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু রক্ত আমাশায় রোগের কারণে তার পড়ালেখায় ব্যাপক বাঁধা শুরু হয়। বাধ্য হয়ে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে যান। ১৮৭৪ সালে পুনরায় কলকাতায় ফিরে অ্যালবার্ট স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই ১৮৭৮ সালে তিনি স্কুল ফাইনাল তথা প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি মেট্রোপলিটন কলেজে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন। ১৮৮১ সালে সেখান থেকে কলেজ ফাইনাল তথা এফএ পরীক্ষায় (এইচএসসি) পাশ করে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। এরপর প্রেসিডেন্সী থেকে গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান।কিন্তু এর মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটল। আচমকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের লর্ড রেক্টর স্ট্যাফোর্ড হেনরি নর্থকোট ঘোষণা করলেন, ‘সিপাহী বিদ্রোহের আগে ও পরে ভারতের অবস্থা’ শীর্ষক বিষয়ে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা হবে। রসায়নের পাঠ কিছু দিনের জন্য তুলে রেখে ইংরেজি ও ফরাসিতে লেখা বিভিন্ন বইপত্র, অর্থনৈতিক ইতিহাস প্রভৃতি পাঠ শুরু করলেন। ফলস্বরূপ, মোট সাতটি অধ্যায়ে ভাগ করা প্রবন্ধ জমা দিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। পুরস্কার না মিললেও এর মূল্যায়নে উইলিয়ম মুয়র ও অধ্যাপক ম্যাসন লিখলেন, ‘আর একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ, যেটিতে মোটো আছে।…ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এটি শ্লেষপূর্ণ আক্রমণে পূর্ণ।’ কিন্তু এই প্রবন্ধের জন্য প্রফুল্লচন্দ্র রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিএসসি পাশ করেন এবং সেখানে ডিএসসি ডিগ্রী লাভের জন্য গবেষণা শুরু করেন। দুই বছরের কঠোর সাধনায় তিনি এই গবেষণা সমাপ্ত করেন এবং পিএইচডি ও ডিএসসি ডিগ্রী লাভ করেন। এমনকি তার এই গবেষণাপত্রটি শ্রেষ্ঠ মনোনীত হওয়ায় তাঁকে “হোপ” প্রাইজে ভূষিত করা হয়। স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে অনেক ডিগ্রি অর্জন করে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন । দেশে ফিরে প্রেসিডেন্সী কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন । প্রায় ২৪ বছর তিনি এই কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন । অধ্যাপনাকালে তার প্রিয় বিষয় রসায়ন নিয়ে তিনি নিত্য নতুন অনেক গবেষণাও চালিয়ে যান । ১৮৯১ সালে অনিদ্রা রোগে আক্রান্ত হন , পূজোর  ছুটিতে তিনি দেওঘর ভ্রমণ করেন, দেশীয় গাছপালা,  ভেষজ উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করেন। ১৮৯৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে তাঁর দ্বিতীয় গবেষণাপত্রের বিষয় ছিল ঘি ও সর্ষের  তেলের ভেজাল নির্ণয় করা এবং বিভিন্ন প্রসাধনী ঔষধের কাঁচামাল প্রস্তুত করা ।এই বছরেই তার পিতা হরিশচন্দ্র মারা যান , এরপর ১৮৯৫ সালে ভারতে একটি স্কুল অফ কেমিস্ট্রি তৈরীর  মধ্য দিয়ে তিনি আধুনিক ভারতের রসায়নের জনক রূপে চিহ্নিত হন এরপর  তাঁর জীবনের মাহেন্দ্রক্ষণ ,তিনি কাজ করছিলেন ভারতের কিছু বিরল খনিজ পদার্থ নিয়ে এবং মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণির শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টাও করছিলেন। এই সময় খানিক অপ্রত্যাশিতভাবেই তৈরী করে ফেলেন মারকিউরাস নাইট্রাইট। আসলে তিনি বানাতে চেয়েছিলেন মারকিউরিক নাইট্রাইট, ক্যালোমেল বানানোর উপাদান হিসেবে। এছাড়াও বিভিন্ন ক্ষারীয় ও ক্ষারীয় মৃত্তিকা মৌল , সোনা , রুপো, তামার নাইট্রাইট তৈরী করেন তিনি।

১৮৯৬ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে এবং nature পত্রিকায়  প্রকাশিত হয়।
১৯১৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর নিয়ে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আমন্ত্রণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পালিত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন,   প্রেসিডেন্সি কলেজ তখন মাসিক পেনশন পেতে ৪৩০  টাকা এর মধ্যে ২০০টাকা রেখে বাকি পুরোটাই তিনি দান করে দিতেন, ওই ২০০ টাকায় তাঁর এবং তাঁর সাথে থাকা গবেষকদের খাওয়ার খরচ চলতো। ১৮৯৭ থেকে ১৯২৯ নাইট্রোজেন ও সালফার  আছে এমন জৈব যৌগ নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন তিনি এবং এই বিষয়ে তাঁর প্রায় ৫০ টি ঘোষণাপত্র রয়েছে । নাইট্রোজেনের অক্সি আ্যসিড ও তার নানা ধাতব যৌগ নিয়ে তাঁর গবেষণাপত্রের সংখ্যা প্রায় ৫০। প্লাটিনাম গ্রুপের ধাতুদের আচার-আচরণ নিয়েও প্রায় ২৫ টি গবেষণাপত্র রয়েছে। ১৯৩৬ সালে ৭৫ বছর বয়সে তাঁর শেষ গবেষণাপত্র থায়োক্যাম্ফর বিষয়ে প্রকাশিত হয় nature পত্রিকায়।

তাঁর উদ্যোগে তাঁর নিজস্ব গবেষণাগার থেকেই ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ কারখানা সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীকালে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তা কলকাতার মানিকতলায় ৪৫ একর জমিতে স্থানান্তরিত করা হয় । তখন এর নতুন নাম রাখা হয় ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড’ ৷ সেই সময়ে এই প্রতিষ্ঠা প্রায় ১৮০০ শ্রমিকের কর্মসংস্থান করতে পেরেছিল ।মূলধন ছিল মাত্র ৮০০ টাকা , যা তাঁর জীবদ্দশাতেই ৫০ লক্ষ টাকায় পরিণত হয়।
নিজের বাসভবনে দেশীয় ভেষজ নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে তিনি তার গবেষণাকর্ম আরম্ভ করেন । তাঁর এই গবেষণাস্থল থেকেই পরবর্তীকালে বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানার সৃষ্টি হয় যা ভারতবর্ষের শিল্পায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে । তাই বলা যায় বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্পায়নে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য ।
তিনি চরম আত্মত্যাগের জীবন যাপন করতেন। তিনি সাধারণ জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী ছিলেন। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন: “এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে সাধারণ ভারতীয় পোষাক পরিহিত ব্যক্তিটি সাধারণ শিষ্টাচার পরিধান করে সম্ভবত মহান বিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক হতে চলেছেন।” তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্সের একটি ছোট  কক্ষে থাকতেন। তাঁর আসবাবপত্রের মধ্যে ছিল একটি লোহার বিছানা, একটি ছোট টেবিল, একটি ছোট চেয়ার এবং একটি আলমারী যার মধ্যে রয়েছে বই ভর্তি , যার অধিকাংশই ইংরেজি ক্লাসিক। প্রফুল্ল চন্দ্র অবিবাহিত ছিলেন। বিস্মৃতির অতল গহবর থেকে তিনি খুঁজে বার করলেন রসায়ন শাস্ত্রে প্রাচীন ভারতের কোন রাজ্যের ইতিহাস তৈরিতে পিছিয়ে ছিল না চরক- সংহিতা ,সুশ্রুত -সংহিতা য় উল্লেখিত অস্ত্রোপচারের সূক্ষাগ্ৰ যন্ত্র, স্ক্যালপোল  আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচীন ভারতের ।  রসায়নে প্রাচীন ভারতবর্ষে কতটি এগিয়ে গিয়েছিল তা তুলে ধরতে তিনি লিখলেন দ্য হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি এ বিষয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানী মার্সিলিন বেরতেলোর সান্নিধ্য তাঁকে সত্যিই অনুপ্রাণিত করে।এই কাজের জন্য সংস্কৃত ও পালি ভাষা শিখেছিলেন তিনি।
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের স্বরচিত বইয়ের প্রথম খণ্ড, হিন্দু রসায়নের ইতিহাস, ১৯০২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। দ্বিতীয় খণ্ড ১৯০৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের জন্য অস্ত্র কেনায় বিপ্লবীদের গোপনে অর্থ সাহায্য করেছিলেন তিনি। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি ১৯ টি  দেশাত্মবোধক গানের সংকলন বের করেন নাম ছিল “উদ্দীপনা”। ১৯০৬ সালে তিনি গান্ধীজীর প্রথম জনসভার আয়োজন করেন। ১৯১৯  সালে কলকাতার টাউন হলে রাওলাট আইনের প্রতিবাদে জনসভায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অনুরোধে তিনি তাঁর ভাষণে বলেন দেশের জন্য প্রয়োজন হলে ছাত্রদের টেস্ট টিউব  ছেড়ে গবেষণার বাইরে আসতে হবে,  বিজ্ঞানের গবেষণা অপেক্ষা করতে পারে কিন্তু স্বরাজ এর জন্য সংগ্রাম অপেক্ষা করতে পারে না।

১৯০৯ সাল,  সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির “দৈনিক বেঙ্গলি”  পত্রিকায় প্রফুল্লচন্দ্রের ” বাঙালির মস্তিষ্ক ও তার অপব্যবহার” শীর্ষক প্রবন্ধ টি যখন ছেপে বেরোল বাঙালি শিক্ষিত যুবকদের মনে যেন একটা ছোটখাটো বিস্ফোরণ ঘটে যায় । বাঙালির সামাজিক অধঃপতন ও দৈনন্দিন অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো নিয়ে এত গভীর অথচ সরল চিন্তা স্বভাবতই সকলের হৃদয় স্পর্শ করে । বাঙালির অন্ন  সমস্যা তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল । ১৯১৯  সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক সভায় তিনি “অন্ন সমস্যা ও তার প্রতিকার” বক্তৃতায় বলেছিলেন যে,  “ল্যাবরেটরি ছেড়ে টেস্টটিউব ফেলে দিয়ে আমি যে আজ আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি  এ শুধু পেটের জ্বালায় । বাঙালির জঠরানল আজ প্রজ্জ্বলিত  হয়েছে কিন্তু সেই আগুন নেভানোর মত অন্ন কোথায় ?  বাঙালির সামনে আজ একটাই সমস্যা দেখতে পাচ্ছি ,জীবনধারণ সমস্যা।  আজ থেকে এই সমস্যার সমাধান নিয়ে কাজ করা হবে আমার জীবনের ব্রত।”
প্রফুল্ল চন্দ্র  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কে বলেছিলেন “গোলামখানা “আর স্নাতকদের বলেছিলেন “মার্কাধারী মূর্খ”,  বলেছিলেন” বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি ও অজ্ঞতা ঢাকার ছদ্মবেশ মাত্র ” , তাঁর সেদিনকার মন্তব্যে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি এবং জীবন-সংগ্রামে তার দাম কি ?প্রশ্ন তুলে ধরেছিলেন তিনি। তাঁর মতে যেমন করেই হোক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হতে পারলে   জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে ,এই ধরনের ভূল ধারণা  আমাদের দেশের অভিভাবকরা পোষণ করেছেন  কিন্তু আমি তা মনে করিনা , বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ঋণী নন এমন অনেককে আমি জানি যারা আত্ম চেষ্টা এবং পুরষকার  বলে জীবন সংগ্রামের শীর্ষ স্থান অধিকার করেছেন।
বিজ্ঞানীর পাশাপাশি সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে তার মুখ্য ভূমিকা ছিল। বাল্যবিবাহ ,জাতিভেদ প্রভৃতি হিন্দু সমাজের বহু কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন । তাঁর তীব্র দেশপ্রেম তাঁকে ইউরোপ থেকে দেশে ফিরিয়ে এনেছিল ।ইংরেজ গোয়েন্দা পুলিশের খাতায় তার সম্পর্কে রিপোর্ট ছিল ‘Revolutionary in the disguise of Scientist।’  মঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকায় আচার্য সম্পর্কে লেখা হয় ‘He is one of the bitterest critics of the British Govt।’
তিনি স্বদেশী আন্দোলনের প্রথম পর্যায় থেকেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। গান্ধীজীর অনাড়ম্বর পূর্ণ জীবন যাপন উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি নিজেকে কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছিলেন ।১৯২৫  সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময়  গান্ধীজি খুলনায় আসলে সাতক্ষীরা জেলার তালার সৈয়দ জালালুদ্দিন হাশেমী ও ডুমুরিয়ার মাওলানা মোহাম্মদ আলীকে সঙ্গে নিয়ে পিসি রায় গান্ধীজীকে স্টিমর ঘাটে স্বাগত জানান। ১৯২৫ সালে কোকনাদ কংগ্রেসের কনফারেন্সে সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ আলীর অনুপস্থিতে কিছু সময় সভাপতিত্ব করেন ,একই সময় পাইকগাছা উপজেলার “ভারত সেবাশ্রম” নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে নিজের এলাকার মানুষকে চরকায় সুতো কাটার মাধ্যমে স্বদেশী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন ।বিজ্ঞান কলেজের বারান্দায় স্থাপন করে তিনি নিজেও সুতো কাটতেন।

প্রফুল্ল চন্দ্র যখন চতুর্থবার ইংল্যান্ড থেকে ফিরলেন সেইসময় অধুনা বাংলাদেশের খুলনা জেলার সুন্দরবন অঞ্চলে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ দেখা গিয়েছিল। তার আত্মচরিতে প্রফুল্ল চন্দ্র লিখছেন কলকাতায় থাকাকালীন তিনি অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পারেননি কিন্তু মে মাসের ছুটিতে যখন গ্রামে এলেন তখনই দুর্ভিক্ষের আসল চেহারা দেখতে পেলেন দেখলেন শুধু খেতে না পেয়ে শয়ে শয়ে নর-নারী, শিশু মারা যাচ্ছে অথচ খুলনার ম্যাজিস্ট্রেট নির্বিকার। প্রফুল্ল চন্দ্র তখন আর্থিক সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে অর্থ সাহায্যের জন্য  দেশবাসীর কাছে আবেদন জানালেন । তাঁর ডাকে দেশবাসী সর্বান্তকরণে সাড়া দিল, বরিশাল ও ফরিদপুর জেলা থেকে দলে দলে স্বেচ্ছাসেবী তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এলেন।১৯১২ সালে পুজোর সময় তৎকালীন উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ বন্যা হলে ,রাজশাহী পাবনা ও বগুড়া জেলার বহু মানুষের ঘরবাড়ি ,গরু-বাছুর সব বন্যায় ভেসে যাওয়ার উপক্রম ।আবার দুর্গত মানুষদের সেবার জন্য আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রিলিফের ব্যবস্থা করলেন। সায়েন্স কলেজে তাঁর ঘরে বসে ছিল বেঙ্গল রিলিফ কমিটির অফিস। সবাই সেদিন দেখেছিলে ষাটোর্ধ্ব একাকী মানুষ যেন একশ জন হয়ে কাজ করছেন । ১৯২২ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর থেকে আবার শুরু হল প্রবল বৃষ্টি, আত্রাই নদী দেখতে দেখতে ফুলে-ফেঁপে উঠলো এবং কিছুদিনের মধ্যেই আবার বন্যা দেখা গেল। এইবার অবশ্য সংগঠনের কাজে প্রফুল্ল চন্দ্র পেলেন আর এক বাঙালি যুবক কে, তাঁর নাম সুভাষচন্দ্র বসু। সেবার দুজনেরই মিলিত প্রয়াসে বন্যত্রাণের  কাজ সুষ্ঠুভাবে চলেছিল ।
একদিন অফিসে গেছেন সুভাষচন্দ্র ,বললেন -” চাঁদার জন্য রাস্তায় নামলে কেমন হয় ?
-খুব ভালো হয় আমিও তোমাদের সঙ্গে থাকব।

  • কিন্তু আপনি কি অত হাঁটতে পারবেন ?
    -খুব পারবো।
    সকালের দিকে বেরোলে কষ্ট হবে না ।”

পরের দিনই মহানগরীর রাজপথে যে দৃশ্য দেখা গেল এর আগে নগরবাসী কোনদিন তা দেখেনি। কলকাতায়  শিক্ষিত যুবকরা হারমোনিয়াম নিয়ে গান করতে বেরিয়েছেন , তাঁরা গাইছেন -” ভিক্ষা দাও, ওগো পুরবাসী ।”
আচার্যদেব এর অনুরোধে কাজী নজরুল ইসলাম গানটি রচনা করেন এবং তিনিই সুর দেন, আর এই মিছিলের পুরোভাগে রয়েছেন প্রফুল্ল চন্দ্র এবং সুভাষচন্দ্র।

১৮৮৯ সালে প্রফুল্ল চন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক থাকাকালীন ল্যাবরেটরীতে অনিষ্টকর গ্যাস বেরোনোর জন্য কোন বিশেষ ব্যবস্থা ছিলনা। বায়ু চলাচলের কোন বিশেষ ব্যবস্থা ছিল না। বিশেষত বর্ষাকালে ধোঁয়া এবং গ্যাস আচ্ছন্ন হয়ে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক পরিবেশ তৈরি হত। এমনই এক সময়ে একদিন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র তৎকালীন প্রিন্সিপাল টনী সাহেবকে ল্যাবরেটরি তে ডাকলেন  এবং চারিদিকে ঘুরে বায়ুতে কয়েক মিনিট নিঃশ্বাস নিতে বললেন। প্রিন্সিপাল টনী সাহেবের ফুসফুস  স্বভাবতই দুর্বল ছিল ।তিনি সেখানে থাকার পর উত্তেজিত হয়ে বাইরে চলে গেলেন এবং শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টরকে এ বিষয়ে এক চিঠি লিখলেন , ডিরেক্টর বুঝতে পারলেন যে আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জামসহ একটি নতুন ল্যাবরেটরি তৈরি করা অত্যন্ত প্রয়োজন। তৎকালীন সরকারের শিক্ষাবিদকে সব কথা বুঝিয়ে তিনি  কলেজে ডাকলেন এবং বাংলার গভর্মেন্টের কাছেও নতুন ল্যাবরেটরির জন্য চিঠি দিলেন ।খুব শীঘ্রই গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম মঞ্জুর করলেন। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন গবেষণাগারের এক বর্ণনা পত্র আচার্যের কাছে ছিল তাছাড়াও জার্মানির কয়েকটি ল্যাবরেটরি সাহায্যে প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন এর নতুন ল্যাবরেটরি তৈরী হয় ১৯৮৪ সালে এবং ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে বিজ্ঞানাগার দেখার জন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ আসতে থাকেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তথা রবির প্রখর আলোকচ্ছটায় যখন ভারতবর্ষ উদ্ভাসিত, তখন জোছনার প্রদীপ্ত আলোর ন্যায় স্বীয় প্রতিভা, প্রজ্ঞা ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রফুল্ল চন্দ্র করেছেন বিভিন্ন দিককে আলোকিত। তিনি হয়েছেন প্রবাদপ্রতিম রসায়নবিদ, বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক, গবেষক, শিক্ষক, শিক্ষানুরাগী, বিজ্ঞানসেবী, সাহিত্যবোদ্ধা, স্বদেশী আন্দোলনকারী, ধর্ম সংস্কারক, শিল্পোদ্যোক্তা, সমবায়ী, ফলিত অর্থনীতিবিদ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মী, আর্তসেবী, মানবদরদী, ইতিহাসবিদ এবং কর্মযোগী। এতবড় একজন বিজ্ঞানী নিজেই বলেছেন ‘ও নবপধসব ধ পযবসরংঃ নু সরংঃধশব’। এদেশে শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসারের জন্য বেঙ্গল ইনিসিয়েটিভ নামক আলোচনা সভার প্রতিষ্ঠা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎ চন্দ্র প্রমুখ প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিকের যুগে বৈজ্ঞানিকদের  সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশ থাকে না। কিন্তু তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। শেক্সপিয়ারের ওপর ধারাবাহিক প্রবন্ধ এবং বই লিখেছেন। একই সঙ্গে সমবায়, কৃষি উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, রসায়ন, ইতিহাস, প্রাণীবিজ্ঞান, সমাজ সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত লিখেছেন। মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে তিনিই এতদাঞ্চলে পথপ্রদর্শক। মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে বাংলায় বই প্রকাশের জন্য ১৮৯০ সালে তিনি নেচার ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি এবং ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে পরপর ৩ বছর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞান, গবেষণা, শিল্প উদ্যোগ, ব্যবসা, সমাজ সংস্কার, দারিদ্র্য বিমোচনসহ বহু বিষয়ে তিনি প্রবন্ধ রচনা করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রসারে ভূমিকা রাখেন। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় শুরুর থেকে তিন দশকের বেশি সময় নিয়মিত প্রবন্ধ লিখেছেন। এ পত্রিকায় শেষ লেখা যখন বের হয় তখন তার বয়স ৭৫। অথচ এ বয়সে তার লেখার বিষয় ছিল ‘অন্ন সমস্যা ও গো-পালন’।

প্রয়াত শিক্ষকদের পরিবারকে সাহায্যের জন্য সমবায় মডেলে তিনি ‘টিচার্স বেনেভোলেন্ট ফান্ড’ গঠন করেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বেঙ্গল কো-অপারেটিভ অর্গানাইজেশন সোসাইটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলার দুর্গম অঞ্চলে সমবায় ব্যাংক উদ্বোধনের জন্য ৭২ বছর বয়সে সারারাত হাতির পিঠে চেপে গমন করেন। দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর কারণে দুস্থ পরিবারকে রক্ষার জন্য ইন্স্যুরেন্স প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেন আর্য বীমা কোম্পানি। ১৯৩৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ভারতীয় বীমা সম্মেলনে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। দেশীয় বীমা কোম্পানি এবং এর গ্রাহকদের সুরক্ষার জন্য বীমা আইনে এ বিষয়ে ধারা সংযোজনে ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করেন। জীবনের শেষ এক বছর খুব কষ্টে কেটেছিল তার। দিন-রাত্রির অধিকাংশ সময় শুয়েই থাকতে হতো তাঁকে। ১৯৯৪ সালের ১৬ ই  জুন তাঁর জীবনের বহুল কর্মব্যস্ততায়  চির বিশ্রাম নেমে আসে ।  তাঁর ছাত্র মেঘনাথ সাহার ভাষায় “ভারত বাস্তবিকই বৈজ্ঞানিক গবেষণার জনক কে হারালো”। এ হেন প্রফুল্ল চন্দ্র কে আমরা সত্যিই কতটা মনে রেখেছি তার আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আমাদের বর্তমান সমাজে রয়েছে। কখনো তাঁকে আমরা দেখেছি বিজ্ঞানী হিসেবে, কখনো সমাজ সংস্কারক রূপে ,কখনো অকৃত্রিম দেশ প্রেমিক হিসেবে, আবার কখনো আদর্শ শিক্ষকের প্রতি মূর্তি রূপে, আবার কখনো বা প্রাবন্ধিক হিসেবে। বলা যায়, অচলায়তনের নাগপাশ থেকে ও  স্বাবলম্বী করতে নিজেকে ও চারপাশের সবাইকে মুক্ত করে সুস্থ চেতনার উদযাপন করতে ও করাতে বাঙালীকে যিনি শিখিয়েছিলেন , তিনিই আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।
”আমি বৈজ্ঞানিকদের দলে বৈজ্ঞানিক, ব্যবসায়ী সমাজে ব্যবসায়ী, গ্রাম সেবকদের সাথে গ্রামসেবক আর অর্থনীতিবিদ মহলে অর্থনীতিবিশেষজ্ঞ।”
–আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র

।।সপ্তর্ষি।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.