সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর আগে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কেই ধারণা ছিল। নাগরিকদের যে মৌলিক কর্তব্য বলেও একটি জিনিস আছে, এ সম্পর্কে ধারণা ছিল না। এমনকী ৩ জানুয়ারী ১৯৭৭ সালের। সংবিধানের ৫১ (ক), পার্ট ফোর, (ক) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্যগুলি সংযোজিত হবার পরেও রাজনৈতিক সামাজিক ক্ষেত্রে নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্যের সম্পর্কে বিশেষ আলোচনা শোনা যায় না। তথাকথিত পণ্ডিতগণ ভারতীয় সংবিধানে ‘মৌলিক কর্তব্যগুলি’ সংযোজিত হওয়ার পরে এই ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন যে, যেহেতু ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সমাজতান্ত্রিক’ কথাটি সংযোজিত হয়েছে, সমাজতান্ত্রিক দেশে নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্যগুলিই প্রধান বিবেচ্য এবং সেই কারণেই মৌলিক কর্তব্যগুলি সমাজতন্ত্রের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
মৌলিক অধিকারগুলি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করবার আগে এবং এই কর্তব্যগুলির সংবিধানে যোগসূত্রের কারণ বিশ্লেষণের আগে আমাদের একবার দেখে নেওয়া দরকার যে, কস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির সদস্যগণ ভারতীয় সংবিধানের রূপায়ণ কীভাবে করেছিলেন। সংবিধানের প্রস্তাবনা পর্বকে বৈদিক সভ্যতার নিরিখে প্রচ্ছদে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। এইভাবে মৌলিক অধিকারগুলি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে এবং বাকি অংশগুলি ভগবান নটরাজের সঙ্গে প্রকাশ করা হয়েছিল। এর কারণটি অবশ্যই এই ছিল যে সংবিধান রচয়িতারা সংবিধান রচনার মাধ্যমে দেশ পরিচালনা ও আইনি শাসনের কথাগুলি ভাবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের সংস্কৃতি ও পরম্পরার কথাও ভেবেছেন।
বৈদিক সভ্যতায় জ্ঞানের অন্বেষণ, মুক্তি, আত্মিক সংশোধন ইত্যাদি কথা বারবার প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের দেশের মহান ঋষিরা তাদের নিজেদের জীবনে বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা, দর্শন, সাহিত্য ইত্যাদির গবেষণা করেছিলেন শ্রুতি এবং স্মৃতির সঙ্গে। তাদের গার্হস্থ্য জীবন আলোচনা করলে দেখা যায় যে তারা নিজেদের মধ্যে মৌলিক কর্তব্য সম্পাদন, দেশ, কালের প্রতি মৌলিক কর্তব্য এবং ভারতীয় সংস্কৃতি ও পরম্পরা রক্ষা করার মৌলিক কর্তব্যে সজাগ ছিলেন। সেই জন্যই সংবিধানে সংযোজিত মৌলিক কর্তব্য কথাটি হঠাৎ আকাশ থেকে ভেঙে পড়েনি বা সেটি তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গেই কেবল যুক্ত নয়, বরং সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে এবং সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সমাজ ও সভ্যতাকে ধারণ করার জন্য মৌলিক কর্তব্যগুলি একটি পরিকাঠামো হিসেবে কাজ করেছে। অথর্ব বেদ এবং বেদের অন্যান্য কর্মকাণ্ডে মৌলিক কর্তব্যগুলির কথা আলোচনা করা আছে। একইভাবে ভারতবর্ষের উপনিষদগুলি ভারতবর্ষের প্রাণশক্তি। ঈশোপনিষদের শুরু :
‘ঈশা বাস্যমিদঁ সর্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জিথা সা গৃধঃ কস্য সিদ্ধনম্।
—জগৎ ও বিশ্ব ঈশ্বর দ্বারাই পরিব্যাপ্ত। তিনিই সর্বশক্তিমান এবং পূর্ণ। তিনি আমাদের আদেশ করছেন তাকে স্মরণ করতে। আর আগে ত্যাগ এবং তারপরে ভোগ করতে। অর্থাৎঈশ্বরের পূজাস্বরূপ কেবলমাত্র মৌলিক কর্তব্য পালনের মাধ্যমেই বিষয় সমূহের যথাবিধি উপভোগ করা যায়।
কঠোপনিষদে ভারতীয় সংস্কৃতি ও পরম্পরায় পিতার প্রতি পুত্রের মৌলিক কর্তব্যের এক আদর্শ উদাহরণ হয়ে রয়েছে। মহর্ষি উদ্দালকের পুত্র নচিকেতা পিতার যজ্ঞে ব্যবহৃত দানসামগ্রী সঙ্গে পিতাকে প্রশ্ন করেছিল যে তিনি তাকে (নচিকেতাকে) কাকে দান করলেন ? অহংকার এবং ক্রোধবশত পিতা নচিকেতাকে যমরাজকে দান করায়। নচিকেতা যমালয়ে গিয়ে যমকে সন্তুষ্ট করে ৩টি বর পান। হাজার প্রলোভনের মধ্যেও অনড় থেকে তিনি আত্মতত্ত্ব ও অগ্নিতত্ত্ব জানতে চান। প্রথম বরের প্রার্থনা ছিল যে তার পিতা অহংকার এবং ক্রোধবশত তাকে যে যমালয়ে নিক্ষেপ করেছেন, তার জন্য পিতার যেন কোনো ক্ষতি না হয় এবং এই কর্মের জন্য তিনি যে মানসিক কষ্ট পাচ্ছেন, তা থেকে যেন মুক্তি পান এবং নচিকেতার প্রত্যাবর্তনের পর যেন তিনি চিনতে পেরে সস্নেহে গ্রহণ করেন। সভ্যতার এবং মানবতার ইতিহাসে পুত্রের পিতার প্রতি এই মৌলিক কর্তব্য একটি আদর্শ হয়ে রয়েছে এবং এই কর্তব্য প্রকাশের মাধ্যমে আমাদের দেশের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক পরম্পরার কথাই উল্লেখ রয়েছে।
মনু মহারাজ তার সংহিতায় নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্যগুলিকে বহু উদাহরণের মাধ্যমে পৃথকীকরণ করেছেন। এই কর্তব্যগুলি নাগরিকের সমাজের অবস্থান ও শিক্ষা-সংস্কৃতির উপরে বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন ভাবে দায়বদ্ধতার কথা বলা হয়েছে। সংহিতার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে গুরু ও গুরুকুলের মৌলিক কর্তব্যের কথা বলা আছে। অষ্টম অনুচ্ছেদে রাজার প্রজার প্রতি মৌলিক কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে। এবং নবম অনুচ্ছেদে সংসারের পুরুষ ও স্ত্রীর বৈশ্যের ও শূদ্রের মৌলিক কর্তব্য সমাজের প্রতি ও ব্যক্তির প্রতি উল্লেখ করা হয়েছে। গুরুকুল ও ব্রাহ্মণদের মৌলিক কর্তব্য সম্পাদনে অনেক বেশি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশের রামায়ণ ও মহাভারত গ্রন্থে মৌলিক কর্তব্যের। বহু উল্লেখ আছে। যোগবশিষ্ঠ রামায়ণ, ভগবৎগীতা তার উদাহরণ। মহাভারতের মহামন্ত্রী বিদুরের বাণী রাজা ও প্রজা উভয়ের ক্ষেত্রে মৌলিক কর্তব্য সম্পাদনের একটি নির্দেশাত্মক নীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে। ওই সকল গ্রন্থ থেকেই কল্যাণকর রাষ্ট্রের কথাটি এসেছে এবং রাজা ও প্রজা উভয়েই রাষ্ট্রের কল্যাণে পরস্পর মৌলিক কর্তব্য সম্পাদনে অঙ্গীকারবদ্ধ। এই সব বাণী আমাদের কাছে মৌলিক কর্তব্যের বার্তা বহন করে এনেছে।
প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতি এ কথাই আমাদের শিখিয়েছে যে মৌলিক কর্তব্য সম্পাদন না করলে কোনো অধিকার ভোগ করা যায় না। পিতামহ ভীষ্ম ও বিদুর রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে বারবার রাজ্যশাসনের দায়বদ্ধতা ও মৌলিক কর্তব্যগুলি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ঠিক একইভাবে প্রজারা সুখী। জীবনযাপন, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এবং নানাবিধ রক্ষাকবচ রাষ্ট্রের কাছে তখনই দাবি করতে পারেন, যখন তারা রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য সম্পাদন করবেন। এই কর্তব্য সম্পাদনের উৎসটি পরিবার থেকে আসে। মনু মহারাজ তার আইনি সংহিতায় এই কথা বলেছেন যে বৃদ্ধ পিতামাতাকে পুত্র যদি অর্থনৈতিক ভাবে রক্ষা না করে, তাহলে পিতামাতা রাষ্ট্রের কাছে পুত্রের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করতে পারবেন। মনুসংহিতায় পরিবারের কর্তা কীভাবে ধনসম্পত্তি ভাগবণ্টন করবেন, কন্যার বিবাহ দেবেন, এই সকল মৌলিক কর্তব্যগুলির বিশদ আলোচনা আছে।
প্রাচীন ভারতের রাজধর্ম কথাটি রাজার প্রজাকল্যাণের মধ্যেই নির্দেশিত ছিল এবং ভগবান শ্রীরামচন্দ্র তার জীবনের ত্যাগের মাধ্যমে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজাকল্যাণের দিকনির্ণয় করে গেছেন। সার্বিকভাবে তাই যারা মৌলিক কর্তব্য সম্পাদন করেন— পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতি, তারাই ধর্মাচরণ করেন।
ভারতীয় সংবিধানের ৩০৫, ৩৭২,৩৭২ (ক) অনুচ্ছেদে সংবিধান পূর্ববর্তী সংস্কৃতি ও প্রথাগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে বলা হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকার, নির্দেশাত্মক নীতি ও মৌলিক কর্তব্যগুলি তাই একে অপরের পরিপূরক হিসেবে অবস্থান করছে। মৌলিক অধিকারগুলি নাগরিকদের ক্ষেত্রে নিদের্শাত্মক নীতিগুলি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আর মৌলিক। কর্তব্যগুলি উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলির অনেক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতা আছে। আদালতের কাছে যদি কোনো বিশেষ প্রশ্ন ওঠে যে জাতীয় স্বার্থ অগ্রাধিকার পাবে কিনা একটি ব্যক্তির মৌলিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে, আদালত জাতীয় স্বার্থকে কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারবে না। কেবলমাত্র চরমতম পর্যায়ে কোনো নাগরিকের জীবন যদি দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, আদালত সেরকম ক্ষেত্রে কিছু কিছু নির্দেশ দিতে পারে। ভারতীয় সংবিধানের মূল কাঠামো হলো, ভারতীয় সংবিধান নাগরিকগণের সার্বিক কল্যাণের কথাই ব্যক্ত করবে এবং তা প্রয়োগ করতে গিয়ে। নাগরিকদেরও মৌলিক কর্তব্য সম্পাদন করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক নেতা তার মতামত প্রকাশের মৌলিক অধিকার ব্যক্ত করতে গিয়ে যদি ভারতীয় সংবিধান, জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় পতাকার অসম্মান করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনানুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে, তার কারণ ভারতীয় সংবিধানকে মর্যাদা দেওয়া, জাতীয় পতাকাকে সম্মান দেওয়া, ভারতীয় সার্বভৌমত্ব ও একতা রক্ষা ইত্যাদি ৫১ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এই মৌলিক কর্তব্যগুলির মধ্য দিয়েই দেশকে একটি বিশেষ স্থানে নিয়ে যাবার জন্য নাগরিকদের কর্তব্যের কথাই বলা হয়েছে। পিতামাতার ক্ষেত্রে ছয় থেকে চৌদ্দ বছরের পুত্রকন্যার শিক্ষাব্যবস্থার জন্য, নারীদের সম্মান রক্ষার জন্য, ভ্রাতৃত্ববোধের রক্ষার জন্য, ভারতীয় সংস্কৃতি ও পরম্পরার উচ্চমার্গীয় ধ্যান ধারণার রক্ষার জন্য, সংবিধানে ৫১ (ক) ধারায় মৌলিক কর্তব্যগুলি সংযোজিত হয়েছে। সেজন্যই সংবিধানের তৃতীয় বিভাগে মৌলিক অধিকার, চতুর্থ বিভাগের নির্দেশাত্মক নীতি, ও চতুর্থ (ক) বিভাগে মৌলিক কর্তব্যগুলি সংবিধানের মূল কাঠামো হিসেবে স্থান পেয়েছে, তার কারণ কল্যাণকর রাষ্ট্রে সবকটিই একে অপরের পরিপূরক।
অশোক কুমার চক্রবর্তী
2019-07-12