আফগানিস্তানের ঊত্তর পশ্চিমে “হিরাট’ নামে একটি প্রদেশ আছে। এর রাজধানী শহর ও ‘হিরাট’ এই শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে যে নদী তার নাম সেই প্রাচীন কাল থেকেই ‘হরি নদী”। কিছু পন্ডিতের লেখায় জানা যায় এই হিরাট কেন্দ্রিক এক রাজ্য ছিলো যার বৈদিক নাম “কেকয়”। কেকয় রাজ্যের রাজকুমারী “কৈকেয়ী” র সংগে বিবাহ হয় রামায়নের রাজা, শ্রী রাম চন্দ্রের পিতা ‘দশরথ’ এর। কৈকেয়ীর পুত্র ভরত এবং শত্রুঘ্ন। শ্রী রামের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনের পর ভরত গান্ধার রাজ্য (তখনো নাম গান্ধার হয়নি) দখল করে এক রাজ্য স্থাপন করেন। তার বড়ো ছেলে তক্ষকের নামে রাজধানীর নাম হয় ‘তক্ষশিলা’। এই তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আগেই লিখেছি- বৈয়াকরনিক ‘পানিনি’ যিনি ‘পানিনি সুত্র- (সংষ্কৃত ভাষার ব্যাকারন) এবং ‘অষ্টাধ্যায়ী’ নামে ভাষ্য লিখে রেখে গেছেন এবং বিখ্যাত পন্ডিত এবং রাজনীতিবিদ চানক্য বা কৌটিল্য, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য র গুরু,যিনি ‘অর্থশাস্ত্র’ নামে তার জ্ঞান পুর্ন ভাষ্য এবং বহু শ্লোক লিখে রেখে গেছেন, তারা দুজনেই এই তক্ষশিলা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং তক্ষশিলা নগরী হাল আমল অবধি ছিলো কিন্তু মুসলিম আগ্রাসনে ধ্বংস হয়ে গেছে। ভরতের বড়ো পুত্র ‘তক্ষক’ বর্তমান ‘উজবেকিস্তান’, তুর্কমেনিস্তান এবং তার আশ পাশ অঞ্চলে নিয়ে এক রাজ্য গঠন করেন। সেই রাজ্যের নাম ছিলো ‘ তক্ষক খন্ড’। উজবেকিস্তান আজো সেই রাজা তক্ষকের নাম বয়ে নিয়ে চলেছে ‘তাসখন্দ’ নামে শহর টাকে তার রাজধানী করে। আমি আগেই বলেছি, তক্ষক খন্দ= তাকস খন্দ= তাসখন্দ (Takhsak = Task. মুখোপাধ্যায়=মুখার্জী, চট্টোপাধ্যায়=চ্যাটার্জী, গঙ্গোপাধ্যায়=গাংগুলী, ভট্ট্যাচার্য= ভটচায, কলকাতা=ক্যালকাটা )। ভাষা তত্ব বিদ মহামান্য ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় যদি বৈদিক যুগের নানা নাম এবং বর্তমান যুগে সেই নাম গুলো কি ভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে সেটা নিয়ে বিশেষ কিছু আলোক পাত করতেন তাহলে যারা আমার এই বক্তব্য কে নস্যাত করে দেবেন তারা আর সেই সুযোগ পেতেন না। ।

মহাভারতে ‘কেকয়’ বংশের প্রায় সব রথী মহারথী অংশ গ্রহন করেছিলো। কুন্তীর ৫ বোনের বিয়ে হয় কেকয় রাজ ‘সহস্রচিত্ত’ র নাতি রাজা ‘সত্যযুপা’ র সঙ্গে। সেই ৫ বোনের ৫ পুত্র। বড়ো পুত্র ‘বৃহৎক্ষেত্র’ ছিলেন মহারথী। তিনি এবং তার অন্য ৪ ভাই এক অক্ষৌহিনী সৈন্য নিয়ে পান্ডবদের সৈন্য ব্যুহের দক্ষিন দিক সামলেছিলেন। বেশ কিছু সৈন্য ‘অর্জুনের’ রথের চাকা রক্ষা করেছিলো। বৃহৎক্ষেত্রের সংগে দ্রোনের মহাসংগ্রামের বিশদ বিবরন মহাভারতে লেখা আছে। বৃহৎক্ষেত্র দ্রোনের হাতে যুদ্ধে মারা যান। তার পুত্র ‘ভীষক’ মারা যান কর্নের হাতে। যারা বৈদিক সনাতনি হিন্দুদের ইতিহাস জানতে চান তারা যদি সময় বার করে, ধৈর্য্য সহকারে একটু রামায়ন এং মহাভারত পড়েন তাহলে এই সব বিবরন ভালো ভাবে জানতে পারবেন। কিন্তু সেই সময় এবং ইচ্ছা আজ আর কোন হিন্দুর আছে?????

হিরাট কেন্দ্রিক কেকয়, কাপাশি কেন্দ্রিক কম্বোজ এবং তক্ষশিলা কেন্দ্রিক গান্ধার রাজ্য, এই প্রাচীন তিন জনপদ নিয়েই বর্তমান আফগানিস্তান। পারস্য সম্রাট সাইরাস-১ এই অঞ্চলে তার প্রভাব বিস্তারের আগে অবধি, অর্থ্যাত খ্রীষ্ট পুর্ব ষষ্ট শাতাব্দী পর্য্যন্ত, এই বৈদিক সভ্যতা এই অঞ্চলে বিদ্যমান ছিলো। সাইরাস কম্বোজদের রাজধানী ‘কাপাশি’ ধ্বংস করে দেন। তাদের অপরাধ এই ছিলো যে তারা স্বাধীন ভাবে বাচতে চেয়েছিলো এবং তারা প্রতিরোধ্য মহান সম্রাট সাইরাসের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করেছিলো।

এর প্রায় ২০০ বছর পর সুদুর গ্রীসের ‘ম্যাসিডোনিয়ার’ আর এক মহান সম্রাট আলেকজান্ডার, পারস্য সাম্রাট দারায়ুসকে মেরে,তার সাম্রাজ্য পদানত করে, তার বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে এসে উপস্থিত হন আফগানিস্তানে । তিনিও তার মহান কাজ কর্ম করেন, ওখানকার অর্থ্যত কেকয় এবং কম্বোজের মানূষ জনকে মেরে কেটে শেষ করে তাদের রক্তে হোলি খেলা করলেন। তারও রাগ ওই কেকয় এবং কম্বোজ জাতির ওপর, কারন, তারা আলেকজান্ডারের (মহান) বিরোধিতা করেছিলো, বিনা শর্তে আত্ম সমর্পন করেনি। আলেকজান্ডারের হাত থেকে বাচতে না বাচতেই এসে হাজির হলেন “কুষান” রাজারা। জাতিতে হুন, দক্ষিন চীনের বাসিন্দা এই জাতি দখল করে নিলো আফগানিস্তান। এদের বিখ্যাত রাজা’ কনিষ্ক’ বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেন। কিন্তু ক্রমশ তার সাম্রাজ্য দক্ষিন-পুবে মগধ অবধি বিস্তার করেন। কুষান সাম্রাজ্য এতো বিস্তৃত ছিলো যে সেই সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিলো ৪ টি— বামিয়ান (কম্বোজদের কাপিশি) পুরুষ পুরা (পেশোয়ার), তক্ষশিলা এবং মথুরা।

বর্তমান আফগানিস্তান, দক্ষিন চীন, কিরগিজস্তান, সমগ্র উত্তর ভারত এবং পুর্ব ভারতের বর্তমান পাটনা (পাটলিপুত্র) , নেপাল, পাকিস্তান, তাজিকস্তান , উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এই সব বিশাল বিস্তীর্ন অঞ্চল জুড়ে কুষান সাম্রাজ্য ছিলো। ‘ইরান কেন্দ্রিক সাসানিদ’ সাম্রাজ্য এই কুষান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত অনেক অঞ্চল, যার মধ্যে ছিলো আফগানিস্তান সহ উত্তর পুর্ব অঞ্চল, যা হিন্দু কুশের উত্তর পশ্চিমে ছিলো, ব্যাক্ট্রিয়া, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকস্তান এবং দক্ষিন চীন দখল করে নেয়। পুর্বদিক থেকে হিন্দু গুপ্ত সম্রাটরা ভারত থেকে কুষান দের বিতাড়িত করেন।বৈদিক আফগানিস্তানের শাসন হাত বদল হয়। কেকয়, এবং কম্বোজ চলে যায় পারসী শাসনে। গান্ধার চলে আসে হিন্দু শাসনে।

ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.