পুলওয়ামায় সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ দুটো জিনিস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়— সন্ত্রাসবাদের বিপদ আর ভারতের নিরাপত্তার দুর্বলতা, কিন্তু তার চেয়েও বেশি করে দেখায় চীনের ভূমিকা, বিশেষত উহান চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে। পাকিস্তানের মাটিতে পুষ্ট জয়েশ-ই-মহম্মদ দাবি করেছে যে তারা পুলওয়ামায় আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, তাতেও পাকিস্তান প্রমাণ চাইছে। আর কত প্রমাণ দিতে হবে? ভারত মাসুদ আজাহারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী হিসাবে গণ্য করার জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে বারবার আবেদন জানিয়েছে; সব সদস্য রাষ্ট্র তাতে সমর্থন জানিয়েছে, একমাত্র চীন তাতে ভেটো প্রয়ােগ করে ভারতের সেই প্রচেষ্টায় জল ঢেলে দিয়েছে।
আসলে ভারতের সীমান্ত ভীতি সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা কাজ করেছিল শুরু থেকে, তা হলাে ভারতের সীমান্তের বিপদে পাকিস্তান ও চীনকে একত্রে ভাবতে হতাে তা হয়নি নেহরু ও কংগ্রেসের ভুলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে ভারত দুই তরফে সীমান্তের বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল— চীনের তিব্বত দখল ও পাকিস্তানের জম্মু-কাশ্মীরের বৃহৎ অংশ দখল। এর ফলে ভারতের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অনাবৃত হয়ে পড়ে। কিন্তু ভারত সীমান্তের ব্যাপারে একটা সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে তখন বিচার করেনি। এই ভ্রান্ত বােঝার ফল হয়েছে মারাত্মক, ভারতের সন্ত্রাস-দমন নীতি কার্যকর হয়নি। এটা কংগ্রেস শাসনের উত্তরাধিকার।
ব্রিটিশরা ভারতকে তিব্বতের ব্যাপারে অনেক কিছু সুবিধা দিত। ১৯৫৪ সালে নেহরু চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত সুরক্ষিত করতে সেই দেশের সঙ্গে একটা চুক্তি করেন। তাতে সেই সমস্ত সুবিধা থেকে ভারতকে বঞ্চিত হতে হয়। কিন্তু এত করেও শেষ রক্ষা হয়নি। ভারত-চীন প্রীতি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৬২ সালে চীন অতর্কিত ভারত আক্রমণ করে আর অপ্রস্তুত ভারত যুদ্ধে হেরে যায় ও ভারতের প্রায় ৩২ হাজার বর্গকিলােমিটার এলাকা চীন দখল করে নেয়। এটা নেহরুর আহম্মকি ও বেইজ্জতির ফল। নেহরু সবার সঙ্গে মাস্টারি ফলাতেন, পাণ্ডিত্য জাহির করতেন, কিন্তু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সঠিক ভাবে গড়ে তােলার দিকে নজর দেননি। এমনও শােনা যায় (অবশ্য তার কোনাে তথ্যপ্রমাণ বর্তমান লেখকের হাতে নেই) নেহরু বিশ্ব শান্তির পুরস্কার পাওয়ার প্রত্যাশায় কাউকে আক্রমণ না করার নীতি নিয়েছিলেন এবং জোট নিরপেক্ষ নীতি নিয়েছিলেন, অথচ তিনি সেই সােভিয়েত ব্লকের দিকেই ঝুঁকেছিলেন। এই ব্যর্থতার গ্লানি তাঁকে এতটা গ্রাস করেছিল যে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।
পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ১৯৪৭-৪৮ সালে ভারত কার্যত কিছুই বাধা দেয়নি। আয়ুব খান তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, “আমরা মাত্র বারোজন লােক নিয়ে ঢুকেছিলাম কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ভারতের তরফে কোনাে প্রতিরােধই হয়নি। যখন ভারত আমাদের থামতে বলল আমরা তখন অনেকখানি ঢুকে পড়েছি”। আর সেখানেই আন্তর্জাতিক সীমানা নির্ধারিত হয়। ইতিমধ্যে পাকিস্তান ভারতের কাশ্মীরের প্রায় ৩৩ হাজার বর্গকিলােমিটার এলাকা দখল করে নিয়েছে যা এখন আজাদ কাশ্মীর নামে পাকিস্তান উল্লেখ করে আর ভারত বলে পাক-অধিকৃত কাশ্মীর (পিওকে)। ১৯৬৩ সালে চীনের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তির ফলে পাকিস্তান পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের শাকসগম উপত্যকার ৫১৮০ বর্গকিলােমিটার এলাকা চীনকে উপহার দেয়। এতে বেজিংয়ের পক্ষে কাশ্মীরের উপর পাকিস্তানের দাবিকে বৈধতা প্রদান করে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এর থেকে চীন-পাকিস্তান চক্র তৈরি হয়। তখন থেকে চীন সর্বদা ভারতকে পাকিস্তান-তাস দেখায় যাতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারত মাথা তুলতে না পারে। চীন পাকিস্তানকে পারমাণবিক শক্তি অর্জনে সবরকম সহযােগিতা করেছিল যাতে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের মধ্যে সমতা রক্ষা হয়। আসলে চীনকে বাদ দিলে পাকিস্তানের পারমাণবিক ক্ষমতা শূন্য। অধুনা চীন-পাকিস্তান আঁতাত ভারতের সন্ত্রাস-দমন ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
যতবার ভারত পাকিস্তানের মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলিকে নিরাপত্তা পরিষদের তালিকাভুক্ত করতে উদ্যত হয়েছে চীন তা রুখে দিয়েছে। ২০১৭ সালে শেষবার চীন ইউএনএসসি-র ১২৬৭ কমিটির দ্বারা মাসুদ আজাহারকে সন্ত্রাসবাদী হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য ভারতের প্রয়াসকে রুখে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, চীন জম্মু-কাশ্মীরের ভারতীয় নাগরিকদের স্টেপলড্ ভিসা প্রদান করে কার্যত ভারতের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। এবং কাশ্মীরের উপর পাকিস্তানের দাবিকে ন্যায্যতা প্রদান করেছে।
বর্তমানে চীন-পাকিস্তান ইকনমিক করিডর (সিপিইসি) যেটা পিওকে-র মধ্য দিয়ে গেছে তা শুধু ভারতের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করেনি, ভারত মহাসাগরে ভারতের নৌ-শক্তিকেও ক্ষুণ্ণ করেছে এবং বিশ্বের প্রাথমিক তেল-চেক পয়েন্ট হর্মুজ প্রণালীর উপর চীনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। পাকিস্তানের গওদর নৌ-ঘাঁটিকে চীনা নৌ-ঘাঁটি করে দেওয়া হলে তা সরাসরি ভারতের পক্ষে সামরিক বিপদ-স্বরূপ হবে।
কিন্তু চীন কখনােই তার সবসময়ের বন্ধু পাকিস্তানকে ছাড়বে না। ভারতের ক্ষেত্রে যে কোনাে সন্ত্রাসবাদ বিরােধিতায় কাশ্মীর প্রসঙ্গ উঠবেই, শাকসগম প্রসঙ্গ আসবেই। আর চীন কখনাে তার সাধের বেল্ট অ্যান্ড রােড (বিআরআই) নীতি পরিহার করবে না।
তাই ভারতকে চীনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে। নতুবা উহান সমঝােতায় ভারত-চীনের সম্পর্কের ব্যাপারে যা বলা হয়েছে তা অধরাই থেকে যাবে।
সুদীপ নারায়ণ ঘোষ