[কবি ও স্বদেশপ্রেমিক হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৭ ই এপ্রিল, ১৮৩৮ – ২৪ শে মে, ১৯০৩)-এর গঙ্গা বিষয়ক কয়েকটি কবিতা বিশ্লেষণ করে গঙ্গানদীর সংজ্ঞা-স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন লেখিকা।]

১. গঙ্গার উৎস সন্ধানে
কবি ‘গঙ্গার উৎপত্তি’ শীর্ষক কবিতায় দেখিয়েছেন কীভাবে হিমালয়ের গোমুখ থেকে গঙ্গা তার সহস্র তরঙ্গকে একত্রে মিলিয়ে উৎপন্ন হয়ে এসেছে। হরিদ্বারে কীভাবেই বা সমতলে পতিত হয়েছে সেই গঙ্গা। কবির কথায় গঙ্গার উৎপত্তি “ব্রহ্মা কমণ্ডলে/জাহ্নবী উথলে/পড়িছে দেখিনু বিমানপথে।” এই কমণ্ডলুতে কীভাবে জল এলো? কবি লিখলেন, “বিন্দু বিন্দু বারি/পড়ে সারি সারি/ধরিয়া সহস্র সহস্র বেণী।” এই বারিরাশি গগনে গগনে গভীর গর্জন করে ভীম কোলাহলে মহাবেগে নেমে আসছে। নেমে আসছে রজত-কায়ায় বায়ু বিদারিত করে। যেখান থেকে এই বারিরাশি আছড়ে পড়ছে তা যেন ভূধর-শিখরের মুকুট; তা যেন সলিলরাশি সজ্জিত হিমানী-আবৃত হিমাদ্রি শির! তা যেন অনন্ত গগনে রজত-বরণ স্তম্ভ। এরই চারিদিকে স্তূপাকার ধবল ফেনা। এই গিরিচূড়ার চারিদিক আবৃত হয়ে আছে হিমানীর গুঁড়ো। হিমানী থেকে সলিলকণা খসে খসে পড়ছে। হিমাদ্রীতে বইছে এমন সহস্র ধারা। পাহাড়ে পাহাড়ে আছড়ে পড়ছে তারই তরঙ্গ। এই মহাবেগে ত্রিলোক আতঙ্কে কেঁপে উঠছে।

কবি হেমচন্দ্র লিখছেন, ‘ছুটিল গর্বেতে/গোমুখী পর্বতে/তরঙ্গ সহস্র একত্রে মিলি।/গভীর ডাকিয়া/আকাশ ভাঙিয়া/পড়িতে লাগিল পাষাণ ফেলি।” তারপর পালকের মতো পর্বত ছিঁড়ে, বাঁধ ভেঙে, পৃথিবী কাঁপিয়ে, তরঙ্গ ছুটিয়ে, অসংখ্য কেশরী-নাদ ডেকে, বক্রাকার বেগে ধেয়ে আসছে স্রোতঃস্তম্ভ। যোজন অন্তর নীচে সেই জলস্তম্ভ পতিত হচ্ছে। তৈরী হচ্ছে সাদা ফেনরাশি। তার তরঙ্গ নির্গত জল প্রকৃতপক্ষে হিমানীর চূর্ণ, হিমরাশি আবৃত। গঙ্গার চিত্রিত রূপ যেন জলধনু। কবি লিখছেন,”শত শত ক্রোশ/জলের নির্ঘোষ/দিবস রজনী করিছে ধ্বনি;/অধীর হইয়া/প্রতিধ্বনি দিয়া/পাষাণ খসিয়া পড়ে অমনি।”

এরপর দেখা যায় হরিদ্বারে নেমে এসেছে গঙ্গার বিমল ধারা; তার শ্বেত সুশীতল জল। পৃথিবী সেই পবিত্র জলে আনন্দে বিভোর। মর্তবাসী সেই পতিত পাবনীর জয়ধ্বনি দিচ্ছে, “অবনীমণ্ডলে/সে পবিত্র জলে/হইল সকলে আনন্দে ভোর;/জয় সনাতনী/পতিত পাবনী/ঘন ঘন ধ্বনি উঠিল ঘোর।”

২. গঙ্গার মূর্তি ভাবনা
রামনগরে কাশীরাজের ভবনে শ্বেতপ্রস্তরনির্মিত গঙ্গার মূর্তি স্থাপিত আছে। এই মূর্তিটিকে বিষয়বস্তু করে হেমচন্দ্রের একটি কবিতা ‘গঙ্গার মূর্তি’। সে মূর্তি শ্বেতবরণা, সে মূর্তি শ্বেতভূষণা। মূর্তির বদনমন্ডলে চন্দ্রবিভাস। দেবী শান্ত-নয়না, শান্ত -বদনা, প্রসাদ প্রতিমা। দেবীর ওষ্ঠ-অধরে হিঙ্গুল রাগ। তাঁর শঙ্খ লাঞ্ছিত শুভ্র কণ্ঠ। মূর্তির চতুর্ভুজ এইরকম, “দক্ষিণ বামেতে/উর্ধ দ্বিভুজ/স্বর্ণ কমল তায়,/অধঃ দুই ভুজে/দক্ষিণ বামেতে/করতলে ধৃত বর অভয়।” দেবীর চরণ- প্রতিমা রক্ত-রাজীবের মত। দেবী শুভ্র মকরে আসীনা, “রক্ত-রাজীব/চরণ-প্রতিমা/শুভ্র মকরে আসীনা সুখে,/শান্ত-নয়না/শান্ত-বদনা/প্রসাদ-প্রতিমা শরীরে মুখে!”

এরপরই প্রশ্ন তুলেছেন কবি। দেবী কী এই মর-ভবনে বসে আমাদের অভয় বর দেবেন? দেবী কী জীয়ন্ত-জীবনে আমাদের পরাণের জ্বালা জুড়াতে পারবেন? মানুষের ব্যথা কী তার হৃদিতেও ব্যথা জাগাবে? যদি জাগিয়েই থাকে, তবে তার এত প্রশান্ত মুখ কেন? মানুষের কলুষে তাপিত দুখ কী দেবতার পরাণে প্রবেশ করবে? শমন ডাকবার আগেই, পরাণ-পাখী উড়বার আগেই কবি জানতে চাইছেন দেবী মূর্তির কাছে, কীভাবে পাপের পীড়নের পরেও ধরাতে রয়েছেন তিনি! কিন্তু তবুও দেবী নিদয়, নিরুত্তর, মৌন, পাষাণ, অসাড়, অচেতন।
কবি বলছেন, যদি তিনি মৃতই হবেন, তবে তার মুখমন্ডলে কেন এত লাবণ্য? কেন জীবন-চন্দ্রমা? কেন সর্ব অঙ্গে রাকা? হতাশ কবি তাই লিখছেন, “হায় রে পাষাণী,/পারিতাম যদি/দিতে এ পরাণী ও দেহ-মাঝ,/জানিতে তা হ’লে/এ ভবমণ্ডলে/কিবা সে পার্থিব মানব-রাজ!”

৩. গঙ্গার প্রবাহ
‘গঙ্গা’ কবিতায় হেমচন্দ্র এক জীবনগঙ্গার চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন। গঙ্গার বয়ে চলার পথে নানান উদ্ভিদ বৈচিত্র্য, নানান প্রাণিবৈচিত্র। “শাল, পিয়াল, তাল,/তমাল, তরু, রসাল,/ব্রততী – বল্লরী- জটা-/ সুলোল- ঝালর- ঘটা”। জলে পানিবক, মীনরাশি। জলের কোলে শঙ্খ, শুক্তি নিয়ে বেগবতী এই গঙ্গা। গঙ্গা প্রবাহ পথে শশধর-জ্যোৎস্নায় স্নাত হয়। চারিদিকে পরিমল, বায়ুগন্ধ।
গঙ্গার বিস্তৃত ধারার সঙ্গে ধরণীও যেন দুধারে নিবিড় রঙ্গে চলেছে। প্রফুল্ল করেছে নানান উদ্ভিদ ও কৃষিক্ষেত্র। ঘাটে ঘাটে ফুল ফোটে “বট, বেল, নারিকেল,/শালি- শ্যামা- ইক্ষু – মেল,/অরণ্য, নগর, মাঠ,/গবাদি -রাখাল- নাট”। গঙ্গার প্রবাহের পথে হর্মপটের মত মন্দির-দেউল-মঠ। গঙ্গার প্রবাহে নগর পল্লীর সুখ। ধবল ধীর তরঙ্গস্রোতে ভেসে চলে বাণিজ্য-বেসাতি-পোত। গঙ্গার বুকে খেলা করে তরি-ডিঙ্গা-ডোঙ্গা-ভেলা।

কবি লক্ষ্য করেছেন তবুও কোথায় যেন মহাভারতের সঙ্গে বঙ্গ চিত্রের প্রভেদ। যেখানে কবি বলছেন, “পবিত্র তোমার জল,/পবিত্র ভারত-তল;/সর্ব দুঃখবিনাশিনী,/সর্ব পাপসংহারিণী”; যেখানে তাঁর কাব্যে গঙ্গা পতিতপাবনী, পুণ্যতোয়া, বিষ্ণুপদী; যেখানে গঙ্গার তিলোদক অমৃত বলে গায়ে ঢাললে দেহাঞ্জন মুক্ত হয়, মুক্ত হয় সর্বপাপ; যেখানে গঙ্গা ত্যাগ-শিক্ষা-পুণ্যফলের কথা বলে; যে গঙ্গার পরহিত-চিন্তা-ব্রত; সেই গঙ্গাই যখন বঙ্গপথে বয়ে চলে, তখন তাঁর নরনারী যেন জীবন-সঙ্গীত-হীন! “জীবন-সঙ্গীত-হীন নরনারী বঙ্গে!/সেখানে চলেছ কোথা এ আহ্লাদে গঙ্গে?”

কবি আশা প্রকাশ করে বলেছেন বঙ্গের চিন্তার সদর্থক ধারা যেন গঙ্গার ধারার সঙ্গেই প্রবাহিত হয়! ঘুচে যায় এই বঙ্গ-চিত্তের কারা। গঙ্গার প্রবাহে যে সামগ্রিক জীবের বসবাস, তাদের যেন দেবী উদ্ধার করেন! “বঙ্গের চিন্তার ধারা, ঘুচুক চিত্তের কারা/উদ্ধার-উদ্ধার, ওগো, জীব দিয়া বঙ্গে!/কোথায় চলেছ, তুমি, হে পাবনী/গঙ্গে?”

ড. মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.