দুর্গাপুজোর মণ্ডপে আজানের ক্যাসেট বাজানোর অভিযোগ উঠল বেলেঘাটা ৩৩ পল্লি পুজোকমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে। এই ক্লাবের প্রাণপুরুষ স্থানীয় বিধায়ক পরেশ পাল। আজানের ক্যাসেট বাজানোর অভিযোগে পরেশ পাল-সহ এই পুজোকমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন কলকাতার নেতাজিনগর এলাকার বাসিন্দা আইনজীবী শান্তনু সিংহ। ফুলবাগান থানায় দায়ের করা অভিযোগপত্রে শান্তনুবাবুর জানিয়েছেন, বেলেঘাটা ৩৩ পল্লি পুজোকমিটির সদস্যদের এই কাজ এলাকায় শান্তি এবং রীতি ভঙ্গ করেছে। সেই কারণে, তিনি মোট পাঁচটি ধারায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। পরেশ পাল ছাড়াও, অভিযোগপত্রে নাম রয়েছে অরূপকুমার সিনহা, পরিমল দে, সুশান্ত সাহা, কৌশিক ঘোষ, তাপস পাল, পলাশ দে, মহেশ্বর দাস, বিশ্বজিৎ চন্দ ও গৌতম দাসের।
এই প্রসঙ্গে শান্তনুবাবুর বক্তব্য, আজানের বাংলা অনুবাদ হল এইরকম:- আল্লাহু আকবর (আল্লাহ সর্বশক্তিমান), আশহাদু-আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই), আশহাদু-আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (স) আল্লাহর প্রেরিত দূত), হাইয়া আলাস সালা ( নমাজের জন্য এস), হাইয়া আলাল ফালা (সাফল্যের জন্য এস), আল্লাহু আকবর (আল্লাহ সর্বশক্তিমান), লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই)।
এই প্রসঙ্গে শান্তনুবাবুর প্রশ্ন, ‘দুর্গাপুজোর মণ্ডপের সামনে দুর্গাপ্রতিমা। প্রতিমার মাথার ওপরে থাকে দেবাদিদেব মহেশ্বরের ছবি। দুর্গাপ্রতিমার পাশে থাকে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী আর সরস্বতীর প্রতিমা। সর্বশক্তির প্রতিভূ হিসেবেই তাঁদের অকালবোধনে আবাহন করা হয়েছে। অথচ মাইকে বাজানো হচ্ছে-আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোনও উপাস্য নেই! এটা প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ভাবনার নজির কী ভাবে হতে পারে?’
বেলেঘাটা ৩৩ পল্লি পুজোকমিটির সদস্যদের জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে শান্তনুবাবুর বক্তব্য, ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্যরা আমাকে ঘটনাটি জানান। তাঁরা আমাকে একটি ভিডিও পাঠিয়েছিলেন। আমি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছি। তার পরই থানায় এফআইআর দায়ের করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু, পুলিশ আমাকে কোনও এফআইআর নম্বর দেয়নি। পুলিশ ব্যবস্থা না-নিলে, আমি আদালতের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হব।’
সুভাষ সরোবর পার্কের ৯৪, হেমচন্দ্র নস্কর রোডে বেলেঘাটা ৩৩ পল্লি পুজোকমিটির অফিস। সেখান থেকে ফোনে বিধায়ক পরেশ পালের সাফাই, ‘বিজেপি, আরএসএস বাংলার সংস্কৃতি জানে না। এখানে বিবেকানন্দের গুরু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মুসলিম রীতি, খ্রিস্টান রীতি সব পালন করতেন। যে দুর্গা, সেই শিব আর সেই আল্লাহ, সেই যীশু। গুরু যা বিশ্বাস করতেন, বিবেকানন্দও তাই বিশ্বাস করতেন। ছোট থেকে বিভিন্ন জনের হুঁকো খেয়ে দেখতেন, জাত যায় কি না। জাতির জনক মহাত্মা গান্ধি পর্যন্ত মনে করতেন ঈশ্বর, আল্লাহ একই শক্তির আলাদা নাম। বিজেপি, আরএসএস এখানে ধর্মীয় বিভাজন করতে চাইছে। এনআরসি করতে চাইছে। এখানে ধমকে চমকে কোনও লাভ হবে না। বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি। সিপিএমের কত বড় বড় সব গুন্ডাদের হাল খারাপ করে দিয়েছি। আর বিজেপি তো ছুঁচো। আমরা এবারের পুজোয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে তুলে ধরতে চাইছি। তাই আজানের ক্যাসেট বাজিয়েছি।’
ঘনিষ্ঠরা বলে থাকেন, ‘পরেশদা এরকমই।’ আবডালে তাঁকে, ‘বাংলা মায়ের দামাল ছেলে’ বলে ডাকতেও তাঁরা দ্বিধা করেন না। কখনও রক্তদান শিবির করা, কখনও অ্যাম্বুল্যান্স চালানোর মতো নানাভাবে জনসংযোগে দক্ষ পরেশ পালের বিরুদ্ধে অভিযোগেরও অবশ্য অন্ত নেই। বিধানসভার মধ্যেই তৎকালীন দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতা অর্জুন সিংকে ধাক্কা মারা, কখনও আবার কমবয়সিদেরকে হাতে ধরে বোমা তৈরির কায়দা শেখানোর অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে।
শুধু তাই নয়, তাঁর সংগঠনের গণবিবাহর অনুষ্ঠানকে উজ্জ্বল করে দেখাতে, বিবাহিত দম্পতিকে পুনরায় বিয়ে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে পরেশ পালের বিরুদ্ধে। শিল্পপতি লক্ষ্মীনিবাস মিত্তলের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল ভিক্টোরিয়ায়। তাতে এই স্থানের ঐতিহ্য নষ্ট হয়েছিল। এই অভিযোগে, ভিক্টোরিয়ার ঘাস পুড়িয়ে দেওয়ারও অভিযোগও উঠেছিল পরেশ পালের বিরুদ্ধে। নিন্দুকদের অভিযোগ, পুলিশ সেই সময় চ্যাংদোলা করে কয়েক ঘা লাঠির বাড়ি দেওয়ার পর, পরেশ পাল ওই অবস্থায় স্কুলপড়ুয়ার মতো করে বলেছিলেন, ‘স্যর, আমি নই। ওরা ওসব করেছে। আমাকে ডেকে এনেছিল।’ কিন্তু, যাঁদের বিরুদ্ধে তাঁর এই অভিযোগ ছিল, সেই সঙ্গীরা অবশ্য ততক্ষণে ভিক্টোরিয়ার প্রাচীর টপকে চম্পট দিয়েছিলেন। ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’ পুজোর মাধ্যমে তুলে ধরতে গিয়ে এবার ফের তেমনই এক বিতর্কে জড়ালেন এই বিধায়ক।