অন্ধ মোদী বিরোধিতার নামে পাকিস্তানের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন বিরোধীরা

জাতীয় আপতকালীন কোনো পরিস্থিতির মোকাবিলায় মতাদর্শ নির্বিশেষে সমস্ত বিরোধীদের মতৈক্যের ভিত্তিতে যদি শত্রুর মোকাবিলা করতে হয় সেক্ষেত্রে ভারত নিশ্চিতভাবেই ব্যর্থ হবে। এই বিষয়টা আবার বিশেষভাবে সত্যি হয়ে ওঠে যদি সেই সময় দেশে সংসদীয় নির্বাচন দোরগোড়ায় এসে যায়। নির্বাচনী মরশুমে সব দলই মনে করে তাদের হয়তো বড়ো সুযোগ রয়েছে। আপতকালীন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মূল দায় যেহেতু ক্ষমতাসীন সরকারের হাতে থাকে এখানকার বিরোধী দল চায় সরকার ভুল করুক। তারা এমনটাও প্রত্যাশা করে যে সরকার নিষ্কর্মা থাকুক বা কিছু করলেও যেন ভুলের ফাঁদে পড়ে যায়।

বিরোধীদের একগুঁয়েমির কারণ কিন্তু শুধুমাত্র এই নয় যে নরেন্দ্র মোদী এমন একজন ব্যক্তি যিনি বহু মানুষকে নিজের পক্ষে টেনে এনে সফল মেরুকরণ করতে পারেন। তাঁর আগের অনেক প্রধানমন্ত্রীই যা করতে অক্ষম ছিলেন। বেশিদিনের কথা নয় অনেকেই একটু স্মৃতি হাতড়ালে মনে করতে পারবেন ১৯৯৯-এর কার্গিল যুদ্ধের সময় বিরোধীপক্ষ কিন্তু মন খুলে সরকারের পাশে দাঁড়াতে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। সে সময় অটলবিহারী বাজপেয়ীর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল ছিল। সামনেই নির্বাচন। মুখে না বললেও এটা বোঝা গিয়েছিল যে বিরোধীরা মনে মনে ভাবছেন যে কারগিলের ওই খাড়া পর্বতচূড়োর মাথায় বসে থাকা পাকিস্তানি হানাদারদের তাড়াতে সরকার ব্যর্থ হবে।

তাঁদের আশা আর একটু শক্তিমান হয়ে ভাবছিল যে সরকারের সামরিক ব্যর্থতা আসন্ন নির্বাচনে বিজেপির হাওয়া কেড়ে নেবে। যদি তিনি ব্যর্থ হতেন সেক্ষেত্রে তিনি লাহোরে যে শুভেচ্ছা বাসযাত্রা করেছিলেন তারও মূল ধরে টেনে তাঁকে সরাসরি কাঠগোড়ায় তোলা হতো। অনায়াসে তাকে হেয় করে বলা হতো দেশের সেনাবাহিনীর ইজ্জত ধুলোয় লুটিয়ে দিয়ে তিনি শত্রুকে লাহোরে গিয়ে আলিঙ্গন করছেন। একই সঙ্গে বিজেপির জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তি ফুটো হয়ে যেত। ঠিক তাই প্রতিপন্ন করার জন্য যুদ্ধ চলাকালীন পুরো সময় কংগ্রেস মুখপাত্ররা দেশের গুপ্তচর সংস্থার ব্যর্থতা ও সেনাবাহিনীর যুদ্ধ মোকাবিলায় অপ্রস্তুতি নিয়ে সরকারকে কুটিল আক্রমণ করে যেতে থাকে। ভুললে চলবে না এই সময় আরও এক কাঠি এগিয়ে সোনিয়া গান্ধী বাজপেয়ীকে মিথ্যেবাদী বলতেও পেছপা হননি। ঠিক এই অভিযোগই তার ছেলে এখন মোদীর বিরুদ্ধে করে যাচ্ছেন। শতাব্দী শেষের সেই বছরে গোটা দেশ একযোগে সরকার ও সেনাবাহিনীর পেছনে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ঐকমত্য অধরাই ছিল।

এখন দেখতে হবে পুলওয়ামা আর বালাকোটের ঘটনা ১৯৯৯-এর সময় থেকে কতটা আলাদা। উত্তর অতি সহজ। আত্মঘাতী বিস্ফোরণে ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যুর ভয়াবহ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ীভাবে বিরোধীরা সরকারকে প্রয়োজনমতো কাজ করার ফ্রি হ্যান্ড দিয়েছিল। এই সংহতি ও ঐকমত্যের আয়ু ছিল মেরেকেটে ৪৮ ঘণ্টা। এর পরই মমতা ব্যানার্জি বলে উঠলেন যে সরকার কী করে তড়িঘড়ি নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে যে পাকিস্তানই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। দেরি করেনি কংগ্রেসও। বরাবরের মতো গুপ্তচর সংস্থার ব্যর্থতা নিয়ে সরকারের ওপর আক্রমণ শাণিয়েছে। কংগ্রেসের ভাবটা এমন যেন আতঙ্কবাদী গোষ্ঠীরা সবসময়ই ছাঁকনি দিয়ে কঠিন আর তরল পদার্থ ঘেঁকে আলাদা করার মতো গুপ্তচর সংস্থার জন্য ঝাড়াই বাছাই করে কিছু খবর ছেড়ে যায়। কী কার্গিল কী পুলওয়ামা উভয়ক্ষেত্রেই ধরে নেওয়া হয়েছিল যে প্রারম্ভিক কিছু হম্বিতম্বির পর সরকার ভয়ংকর রেগে গিয়ে গুম হয়ে বসে থাকবে। পুলওয়ামায় আক্রমণ ও বালাকোটে প্রত্যাঘাতের অন্তর্বর্তীকালীন ১২ দিন অহোরাত্র মোদীকে তুমুল বিদ্রুপের সম্মুখীন হতে হয়েছে। বারবার তার ৫৬ ইঞ্চি ছাতির প্রসঙ্গ তুলে কুৎসিত আক্রমণ করা হয়েছে।

একথা বলতে আজ কুণ্ঠা থাকা উচিত নয় যে বালাকোটে জইশ-ই-মহম্মদের শিবিরের ওপর তুমুল বোমাবর্ষণ জাতীয় পরাক্রমেরই নিদর্শন, একইসঙ্গে এক আড়ম্বরময় প্রত্যাঘাত। এটা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এক অভিযান কেননা পাকিস্তান পাল্টা জবাব আশা করে সাধ্যমতো প্রস্তুতি নিশ্চয় নিয়েছিল। আচম্বিতে, তীব্র গতিতে ও অসামান্য নৈপুণ্যে এই অভিযান ১০০ শতাংশ সফল করার জন্য দেশবাসীর অকুণ্ঠ অভিনন্দন ভারতীয় বায়ুসেনার প্রাপ্য। কিন্তু গভীর আক্ষেপের সঙ্গে লক্ষ্য করতে হয় এই অভিযানকেও পঙ্কিল বিতর্কের পরিসরে নামানো হচ্ছে।

একটা বিতর্ক এ বিষয়ে অনায়াসে চলতে পারে, ভারতের নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সন্ত্রাসীদের পাকিস্তানে অবস্থিত শিবিরগুলির ওপরই হামলা চালানো? উচিত না কি সন্ত্রাসবাদীদের প্রতিহত করতে তাদের ধাওয়া করে পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডের যেখানে ঢোকা প্রয়োজন সেখানেও ঢোকা উচিত ? ভারতের এযাবৎ অবলম্বিত কৌশলে পরিবর্তন আনা যেতে পারে। এক্ষেত্রে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করে আক্রমণের সঙ্গে পাকিস্তানের আদি আন্তর্জাতিক সীমান্ত পার করে আক্রমণ দুটোই বিবেচনায় রাখতে হবে। এ বিষয়ে দেশের বিরোধীদের মত দ্বিধা বিভক্ত। একটা অংশ চাইছে পাকিস্তানের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধ হোক, আর এক দল বলছে শুধুমাত্র কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মেটানোর চেষ্টাই শ্রেয়। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সুচিন্তিত দৃঢ় অবস্থানের বিপরীতে কোনো সামঞ্জস্যপূর্ণ বিরোধী তত্ত্ব উঠে আসছে না।

এখন সত্যিই যদি মোদী সরকারের বিকল্প কোনো মহাগটবন্ধন সরকার উদিত হয় সন্ত্রাসবাদ বিরোধিতায় তাদের নীতি তো আগাগোড়া বিভ্রান্তিমূলক। কেবল একটা বিষয়ে তাদের অন্ধ বিশ্বাস, এনিয়ে প্রধানমন্ত্রী যা যা ব্যবস্থা নিয়েছেন তার সবই নিশ্চিতভাবে ভুল।

কতজন সন্ত্রাসবাদী বালাকোট বোমাবর্ষণে মারা গেছে বা বাড়িগুলোর ধ্বংসাবশেষ দেখা যাচ্ছে না কেন, এসবই যুদ্ধকালীন বা ওই সময়ে দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরিচালিত অভিযানের বিশদ তথ্য। সরকার কখনই এগুলি প্রকাশ করতে বাধ্য নয়। বিশেষ ধরনের অভিযানের ক্ষেত্রে যেমন পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে সন্ত্রাসী ওসামা বিন লাদেনকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন সেনা যেটা করেছিল সেই সতর্কতা অবলম্বনকে অলিখিত নিয়মাবলী বলে ধরে নেওয়া হয়। মার্কিনী পরিকল্পনা তিলমাত্র অনুমান করতে পারলে গুপ্তচর সংস্থাগুলি দ্রুত সক্রিয় হয়ে উঠে ব্যাপক পাল্টা এলোপাথাড়ি নরহত্যায় নেমে পড়তে পারত। এ ঝুঁকি থেকেই যায়।

কিছু অগ্রিম টের না পাওয়ার ব্যর্থতায় পাকিস্তান এখন মরীয়া হয়ে বোঝাতে চাইছে বালাকোটের আক্রমণ সর্বৈব মিথ্যে। ভারতের তরফে চূড়ান্ত অপপ্রচার। ওখানে যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল বা বোমাবর্ষণে তাদের কেউ কেউ হতাহত হয়েছে এটা কাগজে কলমে স্বীকার করলেই সঙ্গত প্রশ্নটা উঠবে যে পাকিস্তান তাহলে নিশ্চিতভাবে জিহাদি ক্রিয়াকলাপের প্রত্যক্ষ মদতদার। তাদের দেশকেই জিহাদিদের লঞ্চপ্যাড হিসেবে তারা ব্যবহার করতে দেয়। আজকে অস্বীকার করা আর নির্লজ্জ মিথ্যে বলা ছাড়া তাদের কাছে আর কোনো বিকল্প অবশিষ্ট নেই। অবশ্য হতাশ ইমরান খানের যোগ্য প্রত্যুত্তর দেওয়ার হুমকি অক্ষমের আস্ফালন। তাতে কিন্তু কেউই কান দিচ্ছে না।

এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের এক শ্রেণীর বিরোধীপক্ষ ও ভারতের বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ অত্যন্ত বেদনাদায়কভাবে পাকিস্তানের মিথ্যে প্রচার ডিপার্টমেন্টের হাতে অস্ত্র-শস্ত্র তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে চলেছেন। তারা কিন্তু স্বতঃপ্রণোদিতভাবে দেশবিরোধী নয়। মানসিকভাবে অনেকেই দেশপ্রেমিক। কিন্তু মোদীর প্রতি অন্ধ ঘৃণা পোষণ করতে করতে কালক্রমে তারা নিজেরাই বোধবুদ্ধি অন্ধ করে ফেলেছেন। তাদের কাছে মোদীকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করার গুরুত্বের কাছে বাকি কোনো কিছুরই মূল্য নেই। আর এই অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবার পথে যে কোনো হীন কৌশল অবলম্বনেও কুছ পরোয়া নেই।

স্বপন দাশগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.