হিন্দু ও মুসলমান আলাদা জাতি। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম। এই কারণেই দুই দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশ বদলের অধিকার মেনে নেওয়া হয়। মোটামুটি ২৩ বছর পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকে ভারতে এসে অত্যাচরিত হিন্দুরা নাগরিকত্ব পেতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চকে সীমা ধরে তখনকার বাংলাদেশ এবং ভারত সরকার ওপার বাংলার হিন্দুদের ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার রদ করে দেয়। ধারণা করা হয়েছিল, ইসলামি পাকিস্তান ভেঙে সৃষ্টি ‘ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে’হিন্দুরা নিরাপদ থাকবেন। কিন্তু স্বাধীনতার চার বছর হতে না হতেই বাংলাদেশ আর ধর্মনিরপেক্ষ থাকেনি। অত্যাচারিত হিন্দুদের ভারতমুখী হতে হয়। কিন্তু দেশভাগজনিত কারণে তাদের দেশ বদলের অধিকার ভারত ফিরিয়ে দেয়নি। পাশাপাশি অর্থনৈতিক কারণে এবং জনবিন্যাস বদলে নেওয়ার পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে ওপার বাংলা থেকে মুসলমান অনুপ্রবেশ ঘটে চলেছে অবিরাম। নির্যাতিত হিন্দুদের বাংলাদেশ ছাড়ার ঘটনা স্বীকৃতি পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আব্দুল বরকতের সম্প্রতি প্রকাশিত বইয়ে (‘Poilitical economy of reforming agriculture-land-water bodies in Bangladesh’) এবং মার্কিন মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক ড. রিচার্ড বেনকিনের বক্তব্যে। অধ্যাপক বরকত লিখেছেন, “প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৬৩২ জন হিন্দু ভারতে চলে যাচ্ছেন। এই হার অব্যাহত থাকলে ৩০ বছর পর বাংলাদেশে কোনো হিন্দু অবশিষ্ট থাকবেন না। তিনি লিখেছেন, ১৯৬৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১ কোটি ১৩ লক্ষ হিন্দু বর্তমান বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন সাম্প্রদায়িক নির্যাতন এবং বৈষম্যের কারণে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে গড়ে দৈনিক ৭০৫ জন হিন্দু পূর্ব পাকিস্তান। ত্যাগ করতেন। ১৯৯১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত দেশতাগের এই হার পাকিস্তান আমলের হারকে ছাপিয়ে যায় বলে লেখা রয়েছে গবেষণা ভিত্তিক এই বইয়ে। আমেরিকার মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক ও লেখক ড. রিচার্ড বেনকিন সানডে গার্ডিয়ানে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রথম জনগণনায় দেখা যায় পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ ছিল হিন্দু। ২০ বছর পরে ১৯৭১ সালে যখন। পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হয় তখন হিন্দুরা কমে হয় এক-পঞ্চমাংশ। এর ২০ বছর পর ১৯৯১ সালে সংখ্যাটা কমে এক-দশমাংশের নীচে নেমে যায়। এখন তা। এক-পঞ্চদশাংশের কাছাকাছি। ড. বেনকিন স্পষ্ট করেই বলেছেন, বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য করার যে প্রয়াস তা নেহাত জেহাদিদের কাজ, এমন নয়। তার মতে, এর মোকাবিলায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় সরকারের সমর্থন অনুমেয়। বর্তমান পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানেও সংখ্যালঘুরা নিরাপদে রয়েছেন, এমন নয়।
কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার নাগরিকপঞ্জি তৈরি করা এবং নাগবিকত্ব আইন সংশোধন করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন এবং খ্রিস্টানদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী। ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে অসমে নাগরিকপঞ্জি তৈরি হচ্ছে। বলাবাহুল্য, অসম চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তা হচ্ছে। এনিয়ে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির লোকেরা হৈচৈ বাধিয়ে দেয় সংখ্যালঘুদের ভোট নিজেদের কবজায় রাখতে। সংখ্যালঘু তোষণের এই রাজনীতি মুসলমানদের কত ভয়ংকরভাবে পিছিয়ে রেখেছে তা সাচার কমিটির রিপোর্টেই স্পষ্ট। ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরা স্বাধীনতার পর থেকে মুসলমানদের ভোটার হিসেবে দেখেছেন, তাদের অগ্রগতির পথ দেখাননি।
দ্বিতীয় মোদী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন এন আর সি বা নাগরিকপঞ্জি হবে অন্য রাজ্যেও। স্বাভাবিকভাবেই এই তোষণের রাজনীতি করা ছোটো বড়ো যেসব দলও তাদের অঘোষিত জোট তৎপর থাকবে মুসলমানদের শুধুই নিজেদের ভোটার করে রাখতে। ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করতে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে এই জোট মুসলমানদের বৃহদংশের মধ্যে যে হীনমন্যতার জন্ম দিয়েছে তা তাদের ভারতীয় জাতীয়তা ও জাতিসত্তার সঙ্গে একাত্ম হতে উৎসাহিত করেনি। তারা আর্থ-সামাজিকরাজনৈতিক মূলস্রোতে আসতে পারেননি। অর্থাৎ এই তোষণের রাজনীতি আমাদের জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় বিকৃতি এনে দিয়েছে। কাশ্মীর নীতিতেও এক ধরনের বিকৃতি স্থান পেয়েছে। এর ফলে হয় মারাত্মক।
একদিকে ভারতীয় মুসলমানদের বৃহদংশের পশ্চাদগামিতা দূর করতে হবে, প্রতিবেশী দেশ থেকে বাধ্য হয়ে ভারতে আগাত হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও খ্রিস্টান শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দান এবং অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে দেশের সম্পদের ওপর তাদের ভাগ বসানো বন্ধ ও প্রতিহত করার মধ্য দিয়ে ভারতীয় জাতীয় জীবনে ঐক্য ও সংহতি আনার আয়োজন করা জরুরি। অন্যথায় ভারত জগৎসভায় তার যথার্থ স্থান নিতে পারবে না।
নিধুভূষণ দাস
2019-07-12