ভারতবর্ষে প্রধানমন্ত্রীর মনোনয়ন

এবারের লোকসভা নির্বাচন সম্প্রতি শেষ হয়েছে। তার গুরুত্ব অপরিসীম। তার কারণ এই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই ঠিক হবে কোন দল বা গোষ্ঠী কেন্দ্রে সরকার গঠন করবে।
তাৎপর্যের বিষয় হলো— প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্র করেই সরকার গঠিত হয়। কিন্তু কীভাবে প্রধানমন্ত্রীকে মনোনীত করা হবে, সেই বিষয়ে সংবিধান স্পষ্ট করে কিছু লেখেনি। ৭৫(১) নং অনুচ্ছেদে আছে— “The Prime Minister shall be appointed by the President and other Minister shall be appointed by the President on the advice of the Prime Minister”। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শেই অন্য মন্ত্রীদের নিযুক্ত করবেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে কি দেখে তিনি মনোনীত করবেন, সেটা আমাদের জানা নেই। | তবে ৭৫(২)নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “The Ministers shall head office during the pleasure of the President”। আর ৭৫(৩) নং অনুচ্ছেদে 01165 “The Council of Minister shall be collectively responsible to the house of the people”। মন্ত্রীরা ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে দায়ী তবে লোকসভার আস্থা হারালে মন্ত্রীসভাকে যৌথভাবে বিদায় নিতেই হবে।
সুতরাং বলা চলে, প্রধানমন্ত্রীকে লোকসভার আস্থাভাজন হতেই হবে। তাই সাধারণত লোকসভার একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা-নেত্রীকেই উক্ত পদের জন্য বেছে নেওয়া হয়। কারণ তিনি ছাড়া আর কারও পক্ষেই লোকসভার আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়। তবে প্রধানমন্ত্রী (এবং অন্যান্য) মন্ত্রীদের পালামেন্টের যে কোনও কক্ষের সদস্য হতেই হবে। ৭৫(৫) নং অনুচ্ছেদে আছে, কার্যভার গ্রহণের ছয় মাসের মধ্যে বহিরাগত মন্ত্রীকে কোনও একটা কক্ষের সদস্য হতেই হবে, নতুবা তিনি বিদায় নেবেন।
অবশ্য যদি লোকসভায় কোনও দল / গোষ্ঠী নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা না পায়, তবে রাষ্ট্রপতি যেমন বৃহত্তম দলের নেতা বা নেত্রীকে সুযোগ দিতে পারেন, তেমনি বড় দলের দ্বারা সমর্থিত সংখ্যালঘু সরকার গড়তে দলের বা কোয়ালিশন মন্ত্রীসভাকে সুযোগ দিতে পারেন। কিন্তু “When a single party has a clear mojority in the Lok Sabha, the President must invite its leader to form the Government” (ড: হরিহর দাস — ইণ্ডিয়া : ডেমোক্রেটিক গভর্ণমেন্ট অ্যাণ্ড পলিটিক্স, পৃ: ১৯৩)। | সমানভাবে ড: বি সি রাউত লিখেছেন, “Only when are several parties in the house and one command and a clear majority, the President may have some freedom of choice” (ডেমোক্রেটিক কন্সটিটিউশন অব ইন্ডিয়া, পৃঃ ১২৮)। অবশ্যই তিনি যে কোনও ব্যক্তিকে সেই পদে বসিয়ে দিতে পারেন, তাঁর গরিষ্ঠতা আছে কিনা সেটা পরবর্তী ব্যাপার।কিন্তু রাষ্ট্রপতির পক্ষে সহজ ব্যাপার হবে বিষয়টা আগে দেখে নেওয়া, কাজটা “delicate and difficult – ” (ড: এস সি কাশ্যপ— আওয়ার কন্সটিটিউশন, পৃঃ ১৫৮)।
তাছাড়া তিনি যদি সংসদের দুই কক্ষের বাইরে থেকে প্রধানমন্ত্রীকে বেছে নেন। (যেমন দেবেগৌড়া), তাহলে একটা শর্ত থেকেই যায়— কোনও কক্ষের সদস্য না 3697 “a Minister shall lose his office” তাঁর মেয়াদ হবে মাত্র ছয় মাস (ড: জে সি জোহরী— দ্য ইন্ডিয়ান কন্সটিটিউশন, পৃঃ ৩২৯)।
এটা লক্ষণীয় যে, আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পর দীর্ঘকাল পর্যন্ত কংগ্রেসের একাধিপত্য ছিল। তার ফলে সংসদের দুই কক্ষ ও রাজ্যে রাজ্যে ওই দল প্রাধান্য বিস্তার করেছে। নেহরুর আমলে তিনবার কংগ্রেস লোকসভার যথাক্রমে ৩৬৪, ৩৭১ ও ৩৬৯টি আসন পাওয়ায় একক গরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। চতুর্থবার (১৯৬৭) কংগ্রেসের আসন কমলেও সেটা ছিল ২৮৩। কংগ্রেসের ভাঙনের পর ইন্দিরা গান্ধীর পেছনে ছিলেন মাত্র ১৪০ জন সদস্য। কিন্তু সিপিআই, সমাজতান্ত্রিক দল ইত্যাদির সাহায্যে তিনি গদি বাঁচিয়েছেন— (কল্যাণ রায়— ইন্দিরা গান্ধী, পৃঃ ১৩৪)। ১৯৭৭ সালে কংগ্রেসের বিপর্যয়ের (লোকসভায় মাত্র ১৫৪টা আসন) পর সেই প্রথম ‘জনতা দল’ সরকার গঠন করে। কিন্তু দলের ভাঙনের ফলে সরকার টেকেনি। ১৯৭৯ সালে দলছুট নেতা চরণ সিংহ প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন কংগ্রেসের সাহায্য নিয়ে, কিন্তু ২৪ দিন পরে তাঁকেও বিদায় নিতে হয়েছে। শুরু হয়েছে অন্যদের সাহায্যপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীদের আগমন। ভি পি। সিংহ এবং চন্দ্রশেখর অল্প দিন ক্ষমতায় ছিলেন। অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রথম সরকারও (১৯৯৮) মাত্র ১২ দিন ক্ষমতায় ছিল। দেবেগৌড়া, গুজরালও সরকার টেকাতে পারেননি। বাজপেয়ীর দ্বিতীয় সরকারও একক গরিষ্ঠ ছিল না বলে মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। তবে মনমোহন সিংহয়ের ইউ পি এ এবং বাজপেয়ী এবং নরেন্দ্র মোদীর এন ডি এ পূর্ণ সময় কাজ করতে পেরেছে।
বলা বাহুল্য, সংখ্যালঘু সরকার আদৌ টেকসই হয়নি। আর রাজীব গান্ধীর পর (লোকসভায় রেকর্ড সংখ্যক ৪১২টা আসন) একক দলের সরকারও গড়ে ওঠেনি। এখন চলছে জোট সরকারের যুগ।
আসলে এই রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে কোনও কোনও সময় রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা প্রাধান্য বিস্তার করার সুযোগ পেয়েছেন। ১৯৭৯ সালের কথাই ধরা যাক। মোরারজী দেশাই পদত্যাগ করলে তাঁর দলেরই জগজীবন রাম ওই পদে প্রার্থী হন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডী দলছুট এবং নবগঠিত লোকদলের নেতা চরণ সিংহকে সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ২৪ দিন পরে চরণ সিংহ পদত্যাগ করলে আবার জগজীবন রাম প্রার্থী হন। এবার রাষ্ট্রপতি লোকসভা ভেঙে দিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন এবং তাতে বিরাট প্রাধান্য নিয়ে কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হন। জগজীবন রামের পক্ষে জীবনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ ঘটেনি।
প্রথম ইউ পি এ-র সময়ও কি তেমন কিছু হয়েছিল? কারণ গোষ্ঠী নেত্রী হিসেবে সোনিয়া গান্ধী রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়েছিলেন হঠাৎ তিনি মনমোহন সিংহয়ের নাম প্রস্তাব করেছেন কেন?
তবে এটা ঠিক যে, এই ব্যাপারে লোকসভা নির্বাচনের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। কারণ “The President has to invite the leader of the majority party in the Lok Sabha”(এস এল সিক্রির ইণ্ডিয়ান গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স, পৃঃ ১১৯)।
এক্ষেত্রে ব্রিটিশ প্রথাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে বহু লর্ড প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু ১৯২৩ সালের একটা ঘটনা কম সংখ্যার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী বোলার স্বাস্থ্যের কারণে পদত্যাগ করায় লর্ড কার্জন ও স্ট্যানলি বন্ডউইন ওই পদের প্রার্থী হন। ব্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞতা, খ্যাতি ইত্যাদির দিক থেকে লর্ড কার্জন ছিলেন অবশ্যই অগ্রণী। কিন্তু রাজা পঞ্চম জর্জ বন্ডউইনকেই বেছে নিয়েছেন। সেই থেকে প্রথা অনুসারে এই ব্যাপারে প্রাধান্য স্বাভাবিকভাবেই। ১৯৬৩ সালে অবশ্য লর্ড হিউমকে আহ্বান করা হয়, কিন্তু প্রথাটা ভাঙা হয়নি। কারণ তিনি তখন নিম্নকক্ষের থেকে এসেছিলেন।
আমাদের এখানেও এই ধরনের প্রথা গড়ে উঠেছে। ইন্দিরা গান্ধী প্রথমবার (১৯৬৬) রাজ্যসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী হলেও পরে (১৯৭১, ১৯৮১) এসেছেন লোকসভা থেকেই। অন্যান্যরা ছিলেন লোকসভার সদস্য।
এই সব কারণে তাই বলা যায়, লোকসভায় নির্বাচনেই এই ব্যাপারটা নির্ধারণ হবে। যদি এন ডি এ গরিষ্ঠতা পায়, তাহলে নরেন্দ্র মোদীই প্রধানমন্ত্রী হবেন। বিরোধীরা অবশ্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। তবে তেমন ফ্রন্ট গড়ে ওঠেনি। আর এই ধরনের সুবিধাবাদী ঐক্য অস্থিরতারই সৃষ্টি করে বলে অনেক ভোটারই জানেন। ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে” কথাগুলো এক্ষেত্রে খাটে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.