শ্রীরামকৃষ্ণ পার্ষদ স্বামী অখণ্ডানন্দজীর সেবা-সাধনাকে স্বীকৃতি দিয়ে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এবং বহরমপুরের কাছে গঙ্গার উপর নবনির্মিত সেতুর নাম হোক যথাক্রমে স্বামী অখণ্ডানন্দ বিশ্ববিদ্যালয় এবং অখণ্ডানন্দ সেতুদাবী করলেন ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।

বিশ্ববিজয়ী স্বামী বিবেকানন্দের মতাে তার গুরুভাই স্বামী অখণ্ডানন্দও বিখ্যাত পুরুষ। তিনিই প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে সেবাধর্মের সূচনা করেন। ১৮৯৭ সালে মুর্শিদাবাদের সারগাছি-মহুলা অঞ্চলে তিনি স্থাপন করেন রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম শাখা। হিমালয়ে যাওয়ার পথে সেখানকার দুর্ভিক্ষ দেখে সেখানেই থেকে যান এবং সেবাকাজ শুরু করেন। এক অন্নপূর্ণা পূজার দিন সারগাছিতে সেবাব্রতের সূচনা হয়েছিল, যেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের অন্নপূর্ণারূপে অধিষ্ঠান।

উনবিংশ শতাব্দীর একদম শেষ ভাগ। স্বামী অখণ্ডানন্দ বা দণ্ডীবাবা তখন বাংলার গ্রামাঞ্চলে পরিব্রজনরত। মুর্শিদাবাদের গোটা এলাকায় তখন দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাস। সেদিন মহুলা থেকে বহরমপুর চলে যাবেন ঠিক করেছেন। সকালে অশরীরী বাণী শুনলেন, “কোথায় যাবি? তোর এখানে ঢের কাজ আছে। গঙ্গাতীর। ব্রাহ্মণের গ্রাম, সুভিক্ষস্থান। তোকে এখানে থাকতে হবে!” সেদিন ভাবতা স্কুলের পন্ডিত এবং আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। এমন সময় জনৈক রজনী সান্যাল তাঁকে মহুলা গ্রামে খুড়োমশাই সূর্য সান্যালের বাড়িতে মায়ের প্রসাদ পাবার নিমন্ত্রণ করলেন। ঘোর অন্নকষ্টের দিনে মা অন্নপূর্ণা পূজার সুসংবাদ তাঁর হৃদয়ে ভাবান্তর ঘটালো। ‘স্মৃতি-কথা’-য় তিনি লিখছেন, এই শুভদিন পথ হাঁটিতে হাঁটিতে কাটিয়া গেলে আমার পরিতাপের সীমা থাকিত না। এই ভীষণ অন্নকষ্টের দিনে নিরন্ন ও দুঃস্থ জনসাধারণের অন্নকষ্ট দূর করিবার জন্যই কি মা অন্নপূর্ণা আমাকে এখানে ধরিয়া রাখিলেন? প্রাণে প্রাণে আমি ইহা বিলক্ষণরূপেই অনুভব করিলাম এবং মনে মনে মাকে বলিলাম, এইবার তোমার সঙ্গেই আমার বোঝাপড়া হবে।” সিদ্ধান্ত নিলেন এখানেই আশ্রমের কাজ স্থায়ীভাবে পরিচালনা করবেন। দুর্ভিক্ষের কাজ সাধ্য মতো সম্পন্নও হল। পক্ষাধিককাল থাকার পর চিঠিতে দুর্ভিক্ষের ক্রমাগত বর্ণনা দিলেন স্বামী প্রেমানন্দকে। লিখলেন, দুর্ভিক্ষ-পীড়িতগণের সেবা না করে এখান থেকে তাঁর যাওয়া হবে না। দার্জিলিং থেকে ফিরে স্বামিজী সেই চিঠি পড়লেন। উৎসাহিত করে টাকা আর দু’জন সেবককে মহুলায় পাঠালেন। বললেন, চুটিয়ে কাজ করে যেতে হবে। অখণ্ডানন্দজী তাই করলেন। প্রথম ১৪/১৫ বছর পরগৃহে আশ্রম পরিচালিত হলেও, পরে আশ্রমের জন্য নিজস্ব জমি কেনা হয়৷ সেখানেই বর্তমান আশ্রমটি গড়ে উঠেছে সারগাছি স্টেশনের অদূরে।

একটি চিঠিতে বিরজানন্দজীকে তিনি লিখছেন, “১৩০৩ সালের শুভ অন্নপূর্ণা পূজার দিন ঠাকুর এখানে আমাকে রেখে তাঁর ‘অন্ন-ছত্র’ খুলিয়াছিলেন — ঠাকুর এই আশ্রমে আমাদের মা অন্নপূর্ণা।” ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে (১৯২৮ খ্রীস্টাব্দে) অন্নপূর্ণা পূজার দিনে এখানে ইষ্টকনির্মিত দ্বিতল দেবালয়ে ঠাকুরের অধিষ্ঠান হয়। আশ্রমের মন্দির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে তিনি আরও লিখেছেন, “আমার অন্তরে ঠাকুর জানিয়ে দেন যে, তিনি এখানে ব্যষ্টিরূপে অন্নপূর্ণা। তাই … কী আশ্চর্য শ্রীমন্দিরের সকল কার্য ঠিক সেই অন্নপূর্ণা পূজার পূর্বদিনেই শেষ হল।”

১৯১৩ সালের মাঝামাঝি সারগাছি স্টেশনের অদূরে স্থাপন করলেন স্থায়ী আবাস। উলুখড়ে ভরা জমিটি তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সবুজ বাগান ও কৃষিক্ষেত্রে পরিণত হলাে। দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের সেবা করতে এসে তৈরি করলেন এক স্বর্গীয় অন্নসত্র। সেই প্রতিষ্ঠান আজ কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে। জমি কেনার পর দণ্ডী মহারাজ ( স্বামী অখণ্ডানন্দ সারগাছি অঞ্চলে এই নামে পরিচিত ছিলেন) তার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশটিকে প্রথমে চাষ-আবাদ করতে উদ্যোগী হলেন। উদ্যোগী হলেন পুষ্পেদ্যান সাজাতেও। প্রাণপ্রিয় গুরুভাই স্বামী বিবেকানন্দ যেহেতু গােলাপ পছন্দ করতেন তাই নানান রংয়ের গােলাপের বাগান তেরি করে ফেললেন। আবাসিক অনাথ ছাত্রদের নিয়ে তৈরি করলেন সবজি বাগান। স্থায়ী জমি তৈরি হবার আগে যে যে জায়গায় ছিলেন সেখানেও উদ্যান রচনা করিয়েছেন।

১৮৯৮ সালে তার মনের ইচ্ছা প্রমদা দাস মিত্রকে চিঠিতে লিখেছেন, “আমার আন্তরিক ইচ্ছা যে, এই অনাথ আশ্রমটি সেল্ফ সাপাের্টিং হয়। অনাথ বালকদিগের দ্বারা উত্তমরূপে আবাদ করাইতে পারিলেই, আশ্রমস্থ বালকগণের শ্রমলব্ধ ধনেই আশ্রমের ব্যয় নির্বাহ হইতে পারিবে।” তিনি অনাথ বালকদের পড়াশুনার পাশাপাশি দর্জির কাজ ও কাপড় বােনার কাজ শিখিয়েছিলেন। ১৮৯৮ সালে আশ্রমে মােট ১১ জন অনাথ বালক ছিল।

সারগাছি মিশনের প্রথম অধ্যক্ষ স্বামী অখণ্ডানন্দের লেখা ৬৫০ টি চিঠি অনুধ্যান করলে দেখা যায়, তিনি। আশ্রমের কাজকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিতেন। বেলুড় মঠের নির্দেশিত কাজকর্ম ছাড়া তিনি আশ্রম ছেড়ে থাকতে চাইতেন না। এমনকী তিনি কৃষি মরশুমে মনােরম তীর্থক্ষেত্র ও নিসর্গ-নিবিড় ভ্রমণের অনুরােধও প্রত্যাখ্যান করেছেন। এলাকায় কৃষির উন্নয়নের জন্যও তিনি সক্রিয় থাকতেন। ছায়াবাজি বা ম্যাজিক লণ্ঠনের মতাে ভিস্যুয়াল স্লাইড তৈরি করে আধুনিক কৃষিকাজে কৃষকদের সচেতন করতেন। আজকের বেলডাঙ্গা, ভাবতা, সারগাছি, বলরামপুর অঞ্চলে সবজি, পাট এবং তৈলবীজ চাষের যে ব্যাপক বিস্তার তার অনুপ্রেরণা স্বামী অখণ্ডানন্দ।

তার চিঠিপত্র পড়ে দেখা যায়, আশ্রমে চাষের জন্য তিনি মায়াবতী থেকে বড়াে জাতের কুমড়া, বরবটি ও শিমের বীজ, তৎকালীন পূর্ববঙ্গের আমিনপুর ও ঢাকা থেকে ভালাে জাতের ওলের বীজ, গােয়ালন্দ থেকে তরমুজের বীজ, কলকাতার নার্সারি থেকে তরমুজ, বিট, শালগমের বীজ এবং ময়মনসিংহ থেকে বেগুনের বীজ আনিয়েছিলেন।

এক সময় রাজ্য কৃষি উন্নয়ন আধিকারিক হিসেবে আমার পােস্টিং ছিল বহরমপুর ডালশস্য ও তৈলবীজ গবেষণা কেন্দ্রের বেলডাঙ্গা উপ গবেষণা কেন্দ্রে। সেসময় সারগাছি, মিশনের প্রধান ছিলেন স্বামী অনাময়ানন্দজী মহারাজ। তার সম্মতিতে আমি সারগাছি আশ্রমে থাকার সুযােগ পাই। তখন আশ্রমের বালকদের পড়াতাম ও কৃষিকাজ দেখাশুনা করতাম। প্রায় একবছর সেখানে থেকে আশ্রমের দিব্য পরিবেশ লাভের ও গ্রামবাসীদের কৃষি-কৃষ্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার সুযােগ পাই। সারগাছি তপােবনে বসবাস আমার এ জীবনের একটি স্মরণীয় তপস্যাকাল।

স্বামী অখণ্ডানন্দ তাঁর ‘স্মৃতি-কথা’ গ্রন্থে লিখছেন, শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে কথোপকথন হচ্ছে গয়ার জমিদার দুর্গাশঙ্কর মুখার্জির। দুর্গাবাবু ঠাকুরকে বলছেন, “মশাই, যিনি পূর্ণব্রহ্ম, ব্রহ্মাণ্ডে তাঁর কোথাও অভাব নেই। তিনি সকল স্থানে সর্বদা রয়েছেন। তাঁর আবার অবতার হয় কি ক’রে?” ঠাকুর বলছেন, “দেখ, পূর্ণব্রহ্ম যিনি, তিনি সাক্ষীস্বরূপ। সর্বদা সমভাবে বিরাজমান আছেন। তাঁর শক্তির অবতার। কোথাও দশ-কলা, কোথাও বারো-কলা এবং কোথাও ষোল-কলা। ষোল-কলা শক্তির অবতার যাঁতে হয়, তাঁকেই পূর্ণব্রহ্ম ব’লে লোকে পুজো করে — যেমন শ্রীকৃষ্ণ।” অখণ্ডানন্দ জানাচ্ছেন ঠাকুর শ্রীরামকে বললেন বারো-কলা। মহালয়ার অমাবস্যা তিথিতে ১৮৬৪ সালের ৩০ শে সেপ্টেম্বর (১২৭১ বঙ্গাব্দের ১৫ ই আশ্বিন) স্বামী অখণ্ডানন্দ মহারাজের জন্ম কলকাতার আহিরীটোলায়।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.