তিন তালাক বিল পাশ করিয়ে মোদী প্রমাণ করলেন তিনি শ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক

ইতিহাসে কিছু কিছু বিরল দিন আসে। ভারতীয় সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে ৩০ জুলাই ২০১৯ ঠিক এমনই একটি দিন। সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় তিন তালাক বিলের অনুমোদন পাওয়া আর পাঁচটা বিলের আইনে পরিণত হওয়া নয়। এটি একটি ঐতিহাসিক ভুলের সংশোধন। একই সঙ্গে মুসলমান মহিলাদের অপহৃত মান মর্যাদার পুনরুদ্ধার। সেই অর্থে এই আইন নারী-পুরুষ উভয়ের সমন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও এক মাইলফলক।
রাজ্যসভায় বিলটির অনুমোদন প্রমাণ করল যে মোদী সরকারের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অবিচল ও দায়বদ্ধ থাকার মাধ্যমে বিরোধীদের নিরন্তর বাধাকেও অতিক্রম করা যায়। এই সামাজিক সংস্কার সেই সমস্ত মুসলমান মহিলা যারা নীরবে দীর্ঘদিনের চলে আসা কদর্যতায় ভরা প্রথার শিকার হয়েছেন নিঃসন্দেহে তাঁদের হাতিয়ার জোগাবে।
বিলটি রাজ্যসভায় পাশ হওয়া কালীন সংসদে ও সংসদের বাইরে যে ঘটনাগুলি ঘটে চলেছিল সেগুলির দিকে নজর দিলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানা যাবে। প্রথমত, এই বিলটি পাশ করাবার ক্ষেত্রে যে অক্লান্ত পরিশ্রম করা হয় তাতে ভারতে মুসলমান মহিলাদের সামাজিক মর্যাদা, সম্মান ও সম্ভ্রমের প্রতি সরকার যে কতটা দায়িত্বশীল তার পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায়। একই সঙ্গে এই বিলকে ঘিরে বেআব্রু হয়ে পড়ে কংগ্রেস দলের দ্বিচারিতা। এর কারণটাও পরিষ্কার। কংগ্রেস বরাবর মুসলমানদের ভোটব্যাঙ্ক হিসেবেই দেখে এসেছে, ফলে সামগ্রিক মুসলমান সমাজে একটা গভীরভাবে প্রোথিত বৈষম্যের পরিবেশ সৃষ্টিহয়। এরই ফলে মুসলমান। মহিলাদের সম্মান দেওয়ার তো কোনো প্রয়োজন কংগ্রেস বোধ করেনি। মুসলমান মহিলাদের মধ্যে ছিল তীব্র হীনমন্যতাবোধ।
আরেকটা মজার ব্যাপার এবার দেখা গেল। অতীতের মতো কংগ্রেস তার একপেশে গোঁয়ারতুমির মাধ্যমে অন্যান্য বিজেপি বিরোধী দলগুলিকে তার দিকে টেনে আনার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। তারা বুঝতেও পারছে না যখন বিরোধী দলগুলি দেখে যে একটা সরকার জনহিতে ও সামগ্রিক সমাজের কল্যাণে দৃঢ়সঙ্কল্প হয়ে কাজ করে যায় যেমনটা নরেন্দ্র মোদী। সরকারের ক্ষেত্রে ঘটেছে তখন তাদের পক্ষে সরকারের পাশে দাঁড়ানোটাই স্বাভাবিক হয়ে পড়ে।
তিন তালাক বিরোধী বিলের পক্ষে এনডিএ জোট বিরোধী দলগুলির কাছ থেকে পাওয়া সমর্থন সদা স্বাগত। সেই কারণে আমরা সকল বিরোধী দলের কাছেই আবেদন করবো তারা যেন দলীয় মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে ভারতের পক্ষে কল্যাণকর বিষয়গুলিতে সরকার পক্ষকে সমর্থন করে। এই সূত্রে ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসের আতস কাচের তলায় রাখতে হবে তিন তালাক বিরোধী বিলের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের ভূমিকাকে। ১৯৮৫ সালে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত তিন তালাকের বলি বৃদ্ধা শাহ বানো মামলায় এই স্বামী পরিত্যক্তাকে ৫০০ টাকা মাসোহারা দেওয়ার আদেশ দেয়। আদালত এও জানায় যে মুসলমানদের ব্যক্তিগত শারিয়া আইনেও এর স্বীকৃতি আছে। ত্রিশ বছর আগের সেই লোকসভায় কংগ্রেসের চারশো সাংসদ থাকা সত্ত্বেও মুসলমান মহিলাদের ওপর চলে আসা অবিচার নির্মূল করতে আদালতের সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও তারা সংস্কার করার ঐতিহাসিক সুযোগ হেলায় হারায়।
শুধু তাই নয়, আদালতের আদেশ কার্যকর করার পরিবর্তে রাজীব গান্ধীর সরকার মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের রক্ষণ তথাকথিত মোল্লাদের পরামর্শে ও একই সঙ্গে মুসলমান ভোটের লোভে সর্বোচ্চ আদালতের রায় বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন করে। এর ফলে তিন তালাকের ক্ষেত্রে মুসলমান মহিলাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। কংগ্রেসের এই কীর্তি তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের প্রসিদ্ধ বাম ঘেঁষা আইনজীবী ডি আর কৃষ্ণ আইয়ারকেও অবাক করে দেয়। কংগ্রেস সরকারের মন্ত্রী আরিফ মহম্মদ খান আদালতের রায়কে ন্যায়সঙ্গত ও যথাযথ বলে মনে করে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রকাশ্য বিরোধিতা করে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। রাজীব গান্ধী সুপ্রিম কোর্টের প্রগতিশীল সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে কাজ করতে চলেছেন এমনটা তিনি আরিফ খানকে বুঝিয়ে ছিলেন।
এরপর থেকে বছরের পর বছর বিষয়টি ঠাণ্ডাঘরে পড়েছিল। শেষমেশ মোদী সরকার ক্ষমতায় এসে যখন বিলটিকে নতুন করে জনসমক্ষে এনে সংসদে তুললেন তখনও কংগ্রেস তার বিলটির প্রতি তার অতীতের ঘৃণ্য অবস্থান সম্পর্কে দোলাচলেই ছিল। কংগ্রেসের ত্রিশ বছর আগের দ্বিচারিতা ও বিভাজনের রাজনৈতিক মানসিকতায় যে। কোনো পরিবর্তন হয়নি তার প্রমাণ আবার পাওয়া গেল। তিন তালাকের ক্ষেত্রে ত্রিশ বছর আগের রাজীব গান্ধীর করা ঐতিহাসিক ভুলের সংশোধনে এই সরকারের প্রচেষ্টাকে তারা অন্তর্ঘাত করার কৌশল নিয়েছিল। বিলটিকে রুখে দেওয়ার অপচেষ্টা থেকে এটাই বোঝা গেল যে কংগ্রেস তোষণ ও ভোটব্যাঙ্কের সস্তা রাজনীতি থেকে এক চুলও সরে আসেনি। তাই, তিন তালাক অধ্যাদেশের আইনে পরিণত হওয়া এই ধরনের রাজনীতির কারবারিদের এক চরম আঘাত।
একই সঙ্গে এই বিলের অনুমোদন ভারতের তথাকথিত উদারবাদীদেরও মুখোশ খুলে দিয়েছে। এঁদেরমধ্যে যাঁরা নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য নিয়ে গলা ফাটান এই বিলের মাধ্যমে যখন মুসলমান মেয়েদের কিছুটা ক্ষমতায়ন হতে যাচ্ছে তারা সন্দেহজনকভাবে হয় নীরব নয়তো নানা অছিলায় বিলটির বিরোধিতা করেছেন। এই স্বঘোষিত উদারবাদীরা যে আসলে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই মানবতাবাদীর মুখোশ পরে থাকেন তা ধরা পড়ে গেছে। মানবিক মূল্যবোধ দেখানোর সময় তারা সরে পড়েছেন।
সেই সমস্ত লোক যারা এই আইনটি আনা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন তাদের জানা দরকার মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত তিন তালাক বেআইনি ঘোষণা করার পরও শয়ে শয়ে মুসলমান মহিলার ওপর তিন তালাক প্রয়োগ ও অত্যাচারের ঘটনার খবর আসছে। এই ধরনের চূড়ান্ত ঔদ্ধত্যের মোকাবিলায় কড়া আইন এনে এই কুপ্রথা বন্ধ করা একান্তই জরুরি ছিল। আর একটা কথা, এই আইনটি যে কোনো মতেই ইসলাম বিরোধী নয় তার প্রমাণ পাকিস্তান, সিরিয়া, ইরান, ইরাক প্রভৃতি দেশ অনেক আগেই তাৎক্ষণিক মুখেমুখে বিবাহ বিচ্ছেদকে বেআইনি ঘোষণা করেছে। আমাদের এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, সেই সমস্ত নারীরা যারা তিন তালাকের বিরুদ্ধে এক কঠিন ও দীর্ঘকালীন যুদ্ধ চালিয়েছে। তাদের আদৌ কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না। তারা নিতান্তই আর পাঁচজন সাধারণ মেয়ের মতো। কিন্তু তাদের ওপর তিন তালাকের নামে যে অন্যায় হয়ে আসছিল তার বিরুদ্ধে লড়ার দুর্জয় সাহস তারা দেখিয়েছিল। এই কুপ্রথাকে রদ করার বিষয়ে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ লড়াই চালায় যার পরিণতিতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাদের পক্ষে রায় দেন। এখন তিন তালাক অবৈধ বলে ঘোষণা করে আমাদের সরকার যে আইন পাশ করল তা এই সমস্ত মহিলাদের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তাদের ন্যায্য সাহায্য করারই প্রচেষ্টা মাত্র। অবশ্যই আইন প্রণেতা ও রাজনৈতিক দলগুলির এই ধরনের ন্যায়সঙ্গত লড়াইকে যথোপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে সঠিক ভাবে সহায়তা ও পরিচালনা করার দায়িত্ব থেকেই যায়।
আইন কেবলমাত্র মুসলমান সমাজের ওপরই প্রযোজ্য হবে বলে বিরোধীরা যে রব তুলেছে তাও অসার। স্বাধীন ভারতে অন্যন্য বহু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই দীর্ঘদিন গেড়ে বসে থাকা বহু অন্যায্য প্রথার সংস্কার করতে আইন আনা হয়েছে। হিন্দু বিবাহ আইন, খ্রিস্টান বিবাহ আইন, বাল্যবিবাহ রোধ বা পণ প্রথা বিলোপ সংক্রান্ত আইনগুলি কি তারই উদাহরণ নয় ? যারা সুবিধেবাদী ও ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থতায় ব্যস্ত তারা এগুলিতে কান দিতে চান না।
যারা তিন তালাক দেওয়াকে ক্রিমিনাল অফেন্স বা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করায় ক্ষেপে যাচ্ছেন তারা সুবিধেজনকভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন যে হিন্দু সমাজের আরও বহু প্রথাকে ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য করে কড়া শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা আগেই বলবৎ রয়েছে।
তিন তালাককে নিষিদ্ধ করে নরেন্দ্র মোদী সরকারের এই সাহসী আইন প্রণয়ন নিশ্চিত প্রশংসার দাবি রাখে। মেয়েদের অধিকার সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমি নিশ্চিত দেশের উল্লেখযোগ্য সমাজ সংস্কারক যেমন রাজা রামমোহন রায়, পণ্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর নামও একই পঙক্তিতে একদিন শোভা পাবে।
অমিত শাহ
(লেখক কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং
বিজেপি নেতা)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.