ডোকলাম উত্তেজনা কমলেও মোদীর সফরেই সেটি অন্যতম আলোচ্য

দলসিংপাড়া পার করার সময় দূর থেকেই মেঘে ঢেকে থাকা ভুটানের সারি সারি পাহাড়ি মাথাগুলো থাকতে দেখলাম। মেঘ জমেছে ওপারে-বিদেশে। প্রকৃতির মেঘ কি কূটনীতির ইঙ্গিত দেয় ? রূপক অর্থে এটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে। কারণ চলতি মাসেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভুটান সফরে আসছেন। রাজধানী শহর থিম্পুতে তাঁকে রাজকীয় অভ্যর্থনা দেওয়া হবে।

দ্বিতীয়বার এনডিএ সরকার তৈরি হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদীর এটাই প্রথম ভুটান সফর। পরিস্থিতি এর মধ্যে কিছুটা বদলেছে দুই দেশেই। ভারতে সরকার পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু ভুটানে পরিবর্তন হয়েছে। ড্রাগনভূমির ক্ষমতায় এখন ডিএনটি (Druk Nyamrup Tshogpa) দল। প্রধানমন্ত্রী ড. লোটে শোরিং। তাঁর দল মধ্য বাম মতাদর্শ রাখে বলেই কূটনৈতিকদের ধারণা। যাবতীয় কূটনৈতিক জট লেগেছে এখানেই। কারণ ভুটানের প্রতিবেশী অপর রাষ্ট্র তথা কমিউনিস্ট শাসনের চিন তার কূটনৈতিক চাল চেলেছে। বেজিং চাইছে থিম্পুর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে। ক্ষমতায় থাকা ডিএনটি দল যদি কূটনৈতিক অভিমুখ পাল্টায় তাহলেই নয়াদিল্লির পক্ষে চিন্তার কারণ।

ফুন্টশোলিংয়ে আসা পর্যন্ত যা দেখছি, তাতে খুব একটা ভারত বিদ্বেষী মনোভাব নেই। বরং রোজকার সীমান্ত পারের জয়গাঁ গিয়ে দৈনন্দিন কাজ চালাচ্ছেন আম ভুটানিরা। তাঁদেরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। পরিষ্কার জানালেন, ভারতের বন্ধুত্ব চাই কিন্তু বড় দাদার ভূমিকা নয়। ডিএনটি ক্ষমতায় আসার আগে থেকে অর্থাৎ সর্বশেষ ভুটানি জাতীয় নির্বাচনের অন্যতম ইস্যু ছিল ভুটানের উপর ভারতের প্রভাব কতটা থাকবে। এই প্রশ্ন ছড়িয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। পরিবর্তন হতেই সেই ইস্যু রয়েছে জনমানসে। ফলে আপাতভাবে না হলেও চিনের সঙ্গে ভুটানের সখ্যতা বাড়ছে বলেই মনে করা হচ্ছে।

ফুন্টশোলিং এমনিতেই ভুটানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এই শহর হিমালয় ঘেরা দেশটির প্রধান বাণিজ্য নগরী। ভুটানের আন্তর্জাতিক স্থলপথ বাণিজ্য ফুন্টশোলিং দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের সঙ্গে হয়ে থাকে। তাই এর বাণিজ্যিক গুরুত্ব অফুরান।এদিকে দেশটির অভ্যন্তরে বাড়ছে চাপা ক্ষোভ। কূটনৈতিক চ্যানেল মারফত সেই তথ্য পৌঁছে যাচ্ছে নয়াদিল্লিতে। ফলে ভুটান সফর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নরেন্দ্র মোদীর কাছে। আপাত নির্ধারিত স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের পরেই আগামী ১৭ অগস্ট মোদী আসছেন ড্রাগনভূমিতে।

ডোকলাম…কথাটা শেষ করতে দিল না, বছর ২৮ এর জিগান। ভুটান থেকে জয়গাঁতে এসেছিল কিছু ফল বাজার করতে। সরাসরি ভাঙা বাংলায় বলে দিল, ‘ডিসপিউটেড ল্যান্ড নিয়ে হামরা ভারতের পাশেই রয়েছি। মগর হামার তো কুছু দরকার..’ এই দরকারটা অর্থনৈতিক। পর্যটনের দেশ, বিশ্বের সব থেকে সুখী দেশ ভুটান চায় নিশ্চয়তা। তার সামনে চিনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের বিরাট অর্থনৈতিক হাতছানি। এই ফর্মুলা ক্রমে ভুটানিদের চিনমুখী করছে। তবুও দীর্ঘ সময়ের সেই ১৯৪৯ সালের দুই দেশের বন্ধুত্বের চুক্তি যা দার্জিলিং শহরে হয়েছিল তাকেই মনে রেখেছেন অনেকে।

নেহরু জমানার সেই উদ্যোগের ফল এতদিন কুড়িয়েছে ভারত। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে দ্রুত। এখানে আসার আগেই ভুটান সম্পর্কে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে চোখ রাখছিলাম। তাতে পরিষ্কার ইঙ্গিত, ডোকলাম ভূখণ্ড নিয়ে চানা সীমান্ত উত্তেজনার আগে থেকে বেশ কিছুটা ভুটানের প্রতি অমনোযোগী হয়েছিল ভারত। তারপরেও ভুটান সরাসরি ভারতের পক্ষই অবলম্বন করে। কিন্তু সরকার পাল্টে যেতেই নয়াদিল্লি বুঝতে পারছে এবার সম্পর্ক ঝালাই করার দরকার। অতএব আসছেন নরেন্দ্র মোদী।

২০১৪ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর মোদীর প্রথম বিদেশ সফর ছিল ভুটান। ইতিমধ্যে ভুটানি প্রধানমন্ত্রী ড. লোটে শোরিং নয়াদিল্লি সফর করে এসেছেন। দুই দেশ সুস্থ সম্পর্কের বার্তা দিয়েছে। জমতে থাকা চাপা ক্ষোভ চাপা পড়বে কি ভুটানের পাহাড়ির জমিতে, সেই প্রশ্নের উত্তর মিলবে প্রধানমন্ত্রীর সফরে। অপেক্ষায় বজ্র ড্রাগনের দেশ।

প্রসেনজিৎ চৌধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.