মোদীর প্রশাসনিক মন্ত্র ন্যূনতম সরকার সর্বাধিক সুশাসন

২০০২ সালের ১২ ডিসেম্বর গুজরাটের ৬১.৫ শতাংশ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে ১২৭ আসনে জয়ী হয়ে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী দ্বিতীয়বারের জন্য বসেছেন মুখ্যমন্ত্রীর তখতে। ঠিক সেরকম সময়েই ঘটেছিল এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা যা ভারতবর্ষকে আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছিল এক নতুন ধরনের মুখ্যমন্ত্রীকে। তিনি আমলাদের রাজনৈতিক চাপে রাখেন না। সব দপ্তরের সচিবদের ডেকে ডেকে বলেছেন—“প্রকল্প রূপায়ণের স্বাধীনতা আপনাদের। রূপায়ণের দায়িত্বও আপনাদের। সরকারের দায়িত্ব রসদ সংগ্রহ করা। সে দায়িত্বটা আমার।” বলছেন“আপনারা স্বাধীনভাবে কাজ করুন, কাজ করতেই হবে।শাস্তির ভয় পাবেন না। আমি কাউকে শাস্তি দেব না।”
মোদীজী যখন চাইছেন— সরকারি অফিসাররা কাজ করুন আত্মতৃপ্তির সঙ্গে মানুষকে তৃপ্ত করতে, সেরকম সময়েই তার কাছে রিপোর্ট এল— একজন উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা নানাভাবে তার দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন। দপ্তরের কাজে কোনও গতি নেই।
মোদীজী তাকে ডেকে পাঠালেন। জিজ্ঞেস করলেন— ‘আপনার অসুবিধাটা কোথায় ?’ ওই অফিসার বললেন, তাঁকে যে। দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেটা তার পছন্দের কাজ নয়।
—কোন কাজ আপনার পছন্দ খোলাখুলি বলুন।
—আমি গানবাজনা পছন্দ করি।
শুনে একটু চমকে গেলেও, মোদীজী রেগে যাননি। শান্ত কণ্ঠে বলেছিলেন— “বেশ, আপনি যেটা ভালোবাসেন সেটা করুন।”
সরকারিভাবে গরিব ছেলেমেয়েদের গান বাজনা শেখানোর জন্য একটা স্কুল খোলা হলো। আর ওই অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া হলো—গান শেখানোর। কয়েকমাস বাদে দেখা গেল, ওই অফিসার গান বাজনার পাশাপাশি তার দপ্তরের দায়িত্বও সমান পারদর্শিতার সঙ্গে পালন করে চলেছেন।
প্রশাসক নরেন্দ্র মোদীর দৃষ্টিভঙ্গি এটাই। কোনো চাপ নয়। তিনি বিশ্বাস করেন স্বামী বিবেকানন্দের সেই ভাবনায়– ‘চিন্তা ও কাজের স্বাধীনতার ওপরেই নির্ভর করে জীবন, উন্নতি এবং কল্যাণ।তাই তিনি লাল ফিতের গেরোয় অবিশ্বাসী। তাই তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হবার পরও সরকারি অফিসারদের বলে দিয়েছিলেন— ছুটি নেবেন। কিন্তু কাজের পর। কাজ শেষের আগে নয়। তার কণ্ঠে গমগম করে ওঠে— “In Government, the major problem in our system is that the the mentality is one of the secrecy. One person who is sitting at the table thinks that no one should know what he is doing. All is compartmentalised, psychologically and physically. I wanted to change this environment. মোদীজীর কাছে এটাই প্রশাসনিক সংস্কার যে আমলাতন্ত্র মানে মুক্তমন, মুক্তচেতনা। গোপনীয়তা এবং সংস্কারের নিগঢ়বদ্ধতা নয়। আবার মন্ত্রী বা সরকারের চাকরতন্ত্রও নয়। আমলা মানে জনগণের সেবক। মন্ত্রী বা সরকারও তার বেশি কিছু নয়।
প্রধানমন্ত্রী পদে নরেন্দ্র মোদী আসীন হবার পর যেসব পুরনো আমলারা ঘর গোছাতে শুরু করেছিলেন অন্য কোথাও অন্য কোনখানে যেতে হবে ভেবে, তাদের চমকিত করে মোদীজী তাদের স্বস্থানেই রেখে দিলেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যে যেখানে ছিলেন, থাকবেন’- এই নীতি মেনেই। মোদীজী তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, নেপোলিয় বোনাপার্টের একটি উক্তি : ‘Gentlemen, there are no bad soldiers. only bad officers.’ প্রশাসনিক কর্তা হিসেবে এক নতুন আঙ্গিক, এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছেন মোদীজী ‘সামনে থেকে নেতৃত্ব দাও। বলির পাঁঠা খোঁজার চেষ্টা কোর না। সাধারণ গুজরাটকে ভাইব্রান্ট গুজরাটে পরিণত করা, নিজেকে ‘বিনাশ পুরুষ’-এর তকমা থেকে মুক্ত করে ‘বিকাশ পুরুষ’-এ পরিণত করা, গোটা ভারতবর্ষকে চমকিত, মুগ্ধ এবং স্তব্ধ করে দিয়ে সমস্ত বিরোধী শক্তির অপপ্রচারকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে ২০১৪ এবং ২০১৯-এর নির্বাচনে মোদী ম্যাজিক প্রতিষ্ঠার পিছনেও রাজনৈতিক কৌশলের চেয়েও অনেক বেশি কাজ করেছে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর এই প্রশাসনিক চিন্তাধারা এবং ভূমিকা। ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর রেকর্ডকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ২০১৪ এবং ২০১৯-এও একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার উপহার দেওয়া মোদী সরকার গতানুগতিকতাকে ‘দূর হটো’ বলে নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে এগোতে চায়। সেই চিন্তাভাবনার অভিমুখ মূলত দুটি : স্বচ্ছ ঘুষমুক্ত মেদমুক্ত প্রশাসন আর । জাতীয়তাবোধের সচেতনতা। তিনি বিশ্বাস করেন, প্রশাসনের সময় নেই সময় নষ্ট করার। দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার। আর সেজন্যই বুঝি একদা এঁদো গলি, সুতোকল আর কাপড়ের মালখানার গুজরাটে মোটরগাড়ির কারখানা করে রতনলাল টাটার মতো ব্যক্তিত্বও বলতে পারেন- “আমি আমার ঘর খুঁজে পেয়েছি। এখন ভারতবর্ষ অপেক্ষমাণ এক নতুন ছাদের যে ছাদ ভারতবর্ষকে পরিচিত করবে ২০৩০ সালের মধ্যেই বিশ্বের প্রথম সারির তিনটি অর্থনৈতিক দেশের একটি হিসেবে।
নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর রাজনৈতিক স্লোগান যেমন ‘সবকা সাথ সবকা বিশ্বাস তেমনই তার প্রিয় প্রশাসনিক স্লোগান 36071— ‘Minimum Government, Maximum Governance। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ১৩ বছরে এবং ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম পাঁচ বছরে মোদীজী এটাই করেছেন মানুষের জীবন থেকে সরকারের ভূমিকা কমিয়ে এনে প্রশাসনের ভূমিকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর জীবনীকার অ্যান্ডি মারিনোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মোদী বলেছেন— “When I first took charge (in Gujrat), the problem I was facing there was the same problem my country is facing today. The problems ane not new. The problems were there in Gujrat. The confidence level was very low.” প্রশাসক হিসেবে তিনি তাই বারবার জাতীয়তাবাদের কথা বলেন, শারীরিক ও মানসিক শক্তি অর্জনের কথা বলেন।
সমীর কোচার তার ‘Modinomics : Inclusive Economics, Inclusive Governence’ গ্রন্থে লিখেছেন :“Modi’s vision of development has three simple pillars. First, higher investment leads to higher growth. Second, progressive policies lead to greater investments. Third, all stake holders should be encauraged for state and national good without the baggage of isms.’
তাই মোদীর প্রশাসন সব মতবাদের ছত্রছায়াবিহীন এক অনন্য প্রশাসন যা বিশ্বাস করে সেই উন্নয়নে পঞ্চামৃতর— জলশক্তি, জনশক্তি, জ্ঞানশক্তি, উর্জাশক্তি আর রক্ষা শক্তিতে। এবং ওইবিশ্বাসে দুর্নীতির কোনও জায়গা নেই। ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদের কোনও স্থান নেই। জনশক্তিই তার মূল চালিকাশক্তি আর জনশক্তির কাছে দেওয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি পালনই তাঁর প্রশাসনিক কর্মধারা। তাই মোদীর প্রশাসন সম্বন্ধে শেষ কথাটা বোধহয় অনেক আগেই লিখে গেছেন মোদীজীর আর এক জীবনীকার নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় তাঁর Narendra Modi ‘The Man, The Times’-এ। তিনি জ্যোতিষীর মতোই ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন—“Modi makes business a pleanere and delivers on his promises. And perhaps like many other theories this will go down in history as one of his achievements.’
সুজিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.