শেষমেশ বেরিয়েই পড়লাম। নানা কাজের চাপে এবারে কুম্ভে যেতে পারব কিনা তা নিয়ে সংশয়ে ছিলাম। কিন্তু শিব চতুর্দশীর শেষ স্নানটা করার সুযোগ এসে যাওয়ায় ওটা আর হাতছাড়া করা গেল না। রওনা দিলাম কুম্ভের উদ্দেশে। এর আগেও প্রয়াগের কুম্ভমেলায় দু’বার এসেছি। দু’বারই মেলা প্রাঙ্গণে গড়ে তোলা ভিএইচপি-র শিবিরেই ছিলাম। এবার ভিএইচপি-র শিবির ইতিমধ্যেই গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। শুধু ভিএইচপি কেন, বহু সংস্থার শিবিরই এখন শুনশান। তথ্য হলো, এবারে প্রায় ৬ হাজার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছিল। আসলে শাহি স্নান আর নেই। তবে শিবচতুর্দশীর স্নান আছে। এবং তা কুম্ভের কাছাকাছিই পড়েছে। তার উপর সোমবার বাবার জন্মবার। তাই এবারও যে উপছে পড়া ভিড় হবে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। বাস্তবে হয়েছেও তাই।
কালীমার্গ দিয়ে সঙ্গমে যাওয়ার মুখেই বিশাল মিডিয়া সেন্টার। ব্যবস্থায় উত্তরপ্রদেশ সরকারের তথ্য দপ্তর। প্রথমে সোজা সেখানেই গিয়ে হাজির হলাম। উদ্দেশ্য দুটো— এক, মেলা ‘কভার’ করার জন্য ‘ইউপি’ সরকারের প্রেস কার্ড সংগ্রহ, দুই, দু’রাত্রির জন্য মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই। তা সরকারি নিয়ম-কানুন মেনে শেষপর্যন্ত দুটোরই গতি হলো। ভাগ্যটা ভালো বলতে হয়। সেদিনই প্রয়াগের ডি এম এবং এস পি-র (প্রয়াগের মেলা প্রাঙ্গণকেই একটা জনপদ বা ডিস্ট্রিক্ট বলে ধরা হয়েছিল) উপস্থিতিতে প্রেস কনফারেনস ছিল। প্রেসকে তাঁরা যা জানালেন তার সারসংক্ষেপ এই শিবরাত্রির পরেরদিন মানে ৫ মার্চই মেলার শেষদিন। প্রায় দু মাস ধরে চলা মেলার বড়ো কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। এখনও পর্যন্ত ২২ কোটি মানুষ স্নান করেছেন।
শিবচতুর্দশীতে আরও ১ কোটি পুণ্যার্থী আসার সম্ভাবনা। রাত ১টা বেজে ২৬ মিনিটে শিবচতুর্দশী তিথি শুরু। তাই আজ রাত থেকেই পুণ্যার্থীদের ঢল নামবে। এজন্য যানবাহন অনেক দুরেই থামিয়ে দেওয়া হবে। হারিয়ে যাওয়া লোকের সংখ্যা এবারে ২৯, ৩০৭। এর মধ্যে এখনও ৭৬২ জনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। মেলা নিয়ে ৯০ মিনিটের একটা তথ্যচিত্রও তৈরি হয়েছে এবং তা দেখার জন্য তাঁরা অনুরোধও জানালেন।
প্রেস কনফারেন্স-এর চা-পর্ব শেষ করে মিডিয়া সেন্টারের তৈরি ঘেরা জায়গার একটা নির্দিষ্ট তাঁবুতে জিনিসপত্তর রেখে সঙ্গী সৈকতদার সঙ্গে রওনা দিলাম সঙ্গমের দিকে। তিন কিলোমিটার হাঁটা পথ। ধীরে সুস্থেই হাঁটছি। পথে কিন্তু এরই মধ্যে তীর্থযাত্রীর ঢল নেমে এসেছে। সঙ্গমের কাছে ব্রিজ পর্যন্ত পৌঁছে দেখলাম সঙ্গমের চারপাশ আলোয় ভেসে যাচ্ছে। যেদিকে তাকাই শুধু আলোয় ভেসে যাওয়া এক বিস্তীর্ণ তাঁবুর শহর। আজ আর বেশি দূর এগোতে ইচ্ছে হলো না, কেননা কাল এই পথ দিয়েই সঙ্গমে স্নানে যেতে হবে। তাই পায়ে পায়ে তাঁবুতে যখন ফিরলাম তখন ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘর ছুঁইছুঁই করছে।
ঘুম ভাঙালো ‘হর হর গঙ্গে’-র জয়ধ্বনিতে। সকাল আটটা নাগাদ যখন রওনা দিলাম তখন বিপুল জনস্রোত। ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ, শুধু মানুষ আর মানুষ। মানুষের এক চলমান স্রোত। কারও পিঠে ব্যাগ, কারও হাতে ঝোলা, কারও মাথায় বোঁচকা। কারও কোলে শিশু। কারও হাত ধরে রেখেছে কচি-কাঁচাকে, কারও হাত ধরে চলেছেন কোনও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। একটা দল যাচ্ছে তাদের সবার একজনের সঙ্গে একজনের কাপড় বাঁধা। আবার একটা দলকে দেখলাম— বিশাল লাঠির ডগায় হলদে কাপড় বাঁধা। সেটা দেখেই দলের বাকিরা চলছে। এদের মধ্যেই একজনকে দেখলাম উদ্ভ্রান্তের মতো এগিয়ে চলেছেন, তার মা-কে পাওয়া যাচ্ছে না। ভুলে-ভটকে শিবির থেকে অহরহ হারানো লোকেদের উদ্দেশে ঘোষণা হচ্ছে—“মধ্যপ্রদেশের পান্না জেলার সীতাদেবী আপনার মেয়ে মহাত্মা গান্ধী মার্গ থানায় অপেক্ষা করছেন। আপনি এখানে আসুন।” প্রশাসনের তরফেও নানা ঘোষণা— ‘আপলোগ স্নানকে বাদ তুরন্ত জায়গা খালি করে, তা কি অন্য পুণ্যার্থীয়ে কো স্নানকে লিয়ে অবসর মিলে।’ পথের দু’পাশে গঙ্গাপূজার সামগ্রী, শীতের পোশাক, নানা কিসিমের দোকান। আর দেদার বিক্রি হচ্ছে পুণ্যার্থীদের গঙ্গাবারি নিয়ে যাওয়ার জন্য নানা সাইজের প্লাস্টিকের বোতল। পোশাক-আশাক, ভাষা-বুলি, খান-পান, গরিব-আমির, পড়-আনপড়—কত রকমের মানুষ যে চলছে তার ইয়ত্তা নেই। সেই চলমান ভারতবর্ষের সঙ্গে আমরাও পা মেলালাম। না, কোনও ক্লান্তি নেই। আছে এক তীব্র ব্যাকুলতা। সঙ্গমে অবগাহন।
সঙ্গমে পৌঁছে দেখি দাঁড়ানোর কোনও স্থান নেই। থিকথিক করছে ভিড়। তীর ধরে গঙ্গার উপরে বাঁশের বেড়া দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আছে সিভিল ভলেন্টিয়ার। সুরক্ষার ব্যবস্থাটা বেশা আঁটোসাটো। বস্তুত বড়ো কোনও দুঘর্টনা ঘটেনি। সারা জায়গাটা জল-কাদায় ভর্তি। তারই মধ্যে লোকেরা জামা-কাপড় ছেড়ে স্নানে যাচ্ছে আবার ফিরছে। কেউ কেউ নৌকো করে মাঝ নদীতে যাচ্ছে, যেখানে যমুনা গঙ্গার সঙ্গে মিশেছে। যাত্রীপিছু ষাট টাকা। তা আমরাও একে একে স্নান করলাম। এই বারের গঙ্গা— অবিরল নির্মল গঙ্গা। সরকারের চেষ্টায় কুম্ভের এই ক’দিনের জন্য এটা সম্ভব হয়েছে। এরই মধ্যে স্নানার্থী চার-পাঁচজন যুবকের একটা দলকে দেখলাম। তাদের একজন স্নান করতে যেতে রাজি নয়। বাকিরা তাকে বোঝাচ্ছে ‘আরে যাও না ইয়ার, মজা আ যায়গা।’ এত কষ্ট করে এত মানুষ যে এখানে এসেছেন, কারও মুখে কোনও বিরক্তি নেই। সবারই চোখে-মুখে এক প্রসন্নতা। তৃপ্তির আভাস। এই মঙ্গল-ভাবনাই এদেশের আত্মা যা যুগ যুগ ধরে এত বৈচিত্র্য সত্ত্বেও আমাদের জাতিকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে। বিশ্বকেও আত্মীয় জ্ঞান করেছে—‘বসুধৈবকুটম্বকম্’।
এবার ফেরার পালা। লেটে হনুমান মন্দিরের দিক দিয়ে ফেরার পথ। ভিড়ের চাপে লেটে হনুমান মন্দির ও অক্ষয় বট দর্শন এখন বন্ধ। আগের দু’বারে এসব অবশ্য দর্শন করে গিয়েছি। আগে যখন এসেছি তখন কুম্ভ ছিল জমজমাট। এখন ভাঙা হাট। সব আখড়াই প্রায় গুটিয়ে নিয়েছে। আছে শুধু কিন্নর-সন্ন্যাসিনীদের আখড়া। এই আখড়ার প্রধানের মিলেছে মহামণ্ডলেশ্বরের স্বীকৃতি। হিন্দু জাতি যে ‘অল ইনক্লসিভ’ এটা তার এক প্রমাণ। হাজার হাজার বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে এই জাতির জীবনধারা যে বয়ে চলেছে, তার কারণ বোধহয় এটাই। সকলকে আত্মসাৎ করে নেওয়ার ক্ষমতা এর অসাধারণ— ঠিক মা গঙ্গার মতো। অসংখ্য নদী গঙ্গাতে এসে মিশলেও সকলেই শেষপর্যন্ত গঙ্গা হয়ে যায়।
এবারের মেলার একটা লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো সুরক্ষা আর স্বচ্ছতা। প্রায় দু’মাস (মকরসংক্রান্তি থেকে শিবচতুদশী) ধরে চলা এই মেলায় প্রায় ২৪ কোটি মানুষকে সামলানো নিঃসন্দেহে এক কঠিন কাজ। চার-পাঁচদিনের বাংলার দুর্গোৎসবে বিশেষত কলকাতায় আমাদের রাজ্যপ্রশাসনের কী অবস্থা হয়, তা জানি। তাই ইউপি-র যোগী বা কেন্দ্রের মোদী সরকারকে সাবাস দিতে হয়। আর একটা দেখার মতো বিষয় হলো— কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলির ব্যাপক প্রচার। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের বিশাল বিশাল সেন্টার যেমন রয়েছে, তেমনই অসংখ্য হোর্ডিং ও গ্লোসাইন বোর্ড। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আর মুখ্যমন্ত্রী যোগীর বিশাল বিশাল সাইজের কাট আউট। কুম্ভ পর্বের পর দেশ জুড়ে যে আর এক রাজনৈতিক কুম্ভ শুরু হতে চলেছে, এ তারই সূচনা। সারাদেশে, বিশেষত সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পর জাতীয়তার একটা যে অন্তর্লীন স্রোত বইছে তা বেশ টের পাওয়া গেল। মেলার মধ্যেই ধ্বনি উঠছে, ‘জয় শ্রীরাম’। ‘ভারতমাতা কী জয়’। মোদী এখন হিরো। তা গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী থেকে সুটেড-বুটেড যুবক— সবারই এক-রা। ক্লান্ত দেহটাকে টানতে টানতে তাঁবুতে ফিরলাম, আজ রাতটা এখানে কাটিয়ে সকালেই ফিরছি। কিন্তু কী জানি কেন, বারবার ঘুরেফিরে মনে আসছে— শেষ হয়েও না হইল শেষ।
বিজয় আঢ্য