১৮৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের ভাইসরয় লর্ড মায়োকে আন্দামানে হত্যা করেছিল শের আলী আফ্রিদি, যাকে শের এ আলী নামেও ডাকা হয়। মায়োকে হত্যার সময় সে যাবজ্জীবন কারা দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত হয়ে আন্দামানের জেলে বন্দি ছিল। ভাইসরয়কে হত্যার অপরাধে শের এ আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং ১৮৭২ সালের ১১ই মার্চ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ভাইপার আইল্যান্ডে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
কে ছিল এই শের এ আলী? সে আন্দামানের কালাপানিতে বন্দি ছিল কেন? আর কেনই বা সে ভাইসরয়কে হত্যা করেছিল?
যারা তার অতীত সম্বন্ধে অবগত নন তারা এতটুকু পড়ার পর হয়ত ভাববেন যে সে কোনো স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিল। কিন্তু না, সে কোনো স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলোনা। স্বাধীনতার লড়াইয়ে তার বিন্দুমাত্র অবদান ছিলনা।
শের এ আলীর জন্ম অধুনা খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে। জীবনের প্রথমার্ধে ১৮৬০ এর দশকের শুরুতে সে পাঞ্জাব মাউন্টেড পুলিশে সেপাই হিসেবে যোগদান করে। ছোটবেলা থেকে পারিবারিক পেশা অর্থাৎ হাজাম বা নাপিতের কাজের যুক্ত থাকায় সে এই কাজে অসাধারণ পারদর্শিতা অর্জন করেছিল। পুলিশে যোগদান করার পর সে সেনার হাজামের কাজে নিযুক্ত হয়। ক্ষৌরকর্মে অসাধারণ পারদর্শিতা এবং চাটুকার স্বভাবের জন্য শীঘ্রই সে পেশোয়ার অশ্বারোহী বাহিনীর মেজর জেনারেল রেনেল টেলর (যিনি পরবর্তীতে বেঙ্গল আর্মির দায়িত্বভার গ্রহণ করে সিপাহী বিদ্রোহ দমন করেছিলেন) এর ব্যক্তিগত ক্ষৌরকার নিযুক্ত হয়। গোঁফের শৌখিন টেলর শের এ আলীর কাজে এতটাই প্রসন্ন হয়েছিলেন যে তাকে একটি ঘোড়া ও একটি পিস্তল দিয়েছিলেন উপহার স্বরূপ।
টেলর এর দেওয়া এই পিস্তলটাই কাল হয়েছিল শের এ আলীর জীবনের। ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ ও ধর্ষক প্রবৃত্তির আলী ১৮৬৭ সালে এক আত্মীয়ের নাবালিকা মেয়ের সাথে দুষ্কর্ম করতে গিয়ে ধরা পরে এবং সেই আত্মীয় আলীর নামে অভিযোগ দায়ের করলে তাকে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা ক’রে শের এ আলী।
এই খুনের দায়ে শের এ আলীকে ফাঁসির সাজা শোনানো হয় যা ০২/০৪/১৮৬৭ কার্যকর হওয়ার ছিল। কিন্তু সে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন জানানোয় ব্রিটিশ সরকারের প্রতি তার এত দিনের আনুগত্যের পুরস্কার স্বরূপ ফাঁসি রদ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে আন্দামানের সর্পদ্বীপ বা ভাইপার আইল্যান্ডের জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় (সাজা-এ-কালাপানি)।
প্রবাদ আছে “ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে”, শের আলীরও হয়েছিল তাই। কালাপানি গিয়েও সে নাপিতের কাজ করার আদেশ পেয়েছিল। প্রথম দিকে তার কাজ ছিল জেলের বন্দীদের ক্ষৌরকর্ম। কিন্তু পদলেহন যার মজ্জাগত, সে কি ভালো হয়ে থাকতে পারে? বন্দী বিপ্লবীদের গোপন খবর সংগ্রহ করে তা সুপারকে জানাতে শুরু করেছিল। এই করেই সে সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের অত্যন্ত বিশ্বস্ত অনুগামীতে পরিণত হয়েছিল। সে স্বপ্ন দেখত, তার চাটুকারীতায় খুশি হয়ে তাকে একদিন মুক্তি দেবে।
জেল সুপার রবার্ট ক্রিস্টোফার টেলর তাকে নিরাশ করেননি। ১৮৭২ সালে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মায়ো কালাপানি পরিদর্শনে এলে ক্রিস্টোফার টেলর শের এ আলীর মুক্তির প্রস্তাবনামা দাখিল করেছিলেন ভাইসরয় এর সম্মুখে। কিন্তু ভাইসরয় কালবিলম্ব না করেই তা প্রত্যাখ্যান করার দেন। মুক্তির যে আশার আলো দেখেছিল শের খান, তা এভাবে নিভে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেনি সে। তার তার সমস্ত রাগ গিয়ে পরেছিল ভাইসরয় এর উপর।
০৮ই ফেব্রুয়ারি ১৮৭২ সন্ধ্যা ০৭:০০টা, আন্দামান থেকে কলকাতা ফিরে আসার প্রাক মুহূর্তে ভাইসরয় লর্ড মায়ো ব্রিটিশ আধিকারিকদের সংবর্ধনা গ্রহণ করছিলেন, লেডি মায়ো জাহাজের কেবিনে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। জেল সুপার সাহেবের অনুচর হিসেবে শের এ আলীও উপস্থিত ছিল। ব্রিটিশের তাঁবেদার হওয়ায় ভাইসরয় সাহেবের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল সে, ভাইসরয় এর দেহরক্ষীদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। সেসময় নিজের দাড়ি কামানো ক্ষুর নিয়ে লর্ড মায়োর উপর অতর্কিতে আক্রমণ করে শের এ আলী। ক্ষুরের আঘাতে ভাইসরয়ের খাদ্যনালী ও স্বাসনালী ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করে।
পুনশ্চঃ – কিছুদিন যাবৎ দেখছি সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা গোষ্ঠী শের এ আলীকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে প্রচার করার মিথ্যা চেষ্টা করছে। তাদের প্রচারে প্রচারে যেন আপনারা ভ্রান্ত ধারণার শিকার না হন, তাই এই পোস্টের অবতারণা।
জয় হিন্দ।
তথ্যসূত্র : দ্য হিন্দু আর্কাইভ, ২১/১২/২০০৫।
লিখেছেন Subhajit Gayen