দ্বিতীয় অংশ
কালিঞ্জর দূর্গটি বিন্ধ্যাচল পর্বতের ৭০০ফুট উঁচুতে অবস্থিত। দুর্গের মোট উচ্চতা ১০৮ ফুট। তার দেয়াল মোটা প্রশস্ত এবং উচ্চ। এই দূর্গকে ইতিহাসের সুপ্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতের সেরা দুর্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই দুর্গ মধ্যে বিভিন্ন যুগের বহু স্থাপত্য শৈলী পরিলক্ষিত হয় , যেমন – গুপ্ত শৈলী, প্রতিহার শৈলী, পঞ্চায়তন নাগর শৈলী, ইত্যাদি।
এই সুপ্রাচীন দূর্গের স্থাপত্য শৈলী দেখলে উপলব্ধি করা যায় যে, দূর্গের সংরচনা কালে বাস্তুকার অগ্নি পুরান, বৃহদারণ্যক উপনিষদ ও অন্যান্য পৌরাণিক গ্রন্থাদিতে উল্লিখিত বাস্তুমতকে অনুসরণ করেছিলেন। দূর্গের কেন্দ্র স্থলে অজয় পালকা নাম্নী একটি প্রাচীন হ্রদ অবস্থান করছে এবং হ্রদকে কেন্দ্র করে বহু প্রাচীন মন্দির বিরাজমান। এখানে এমন তিনটি মন্দির রয়েছে যা গাণিতিক পদ্ধতিকে অনুসরণ করে নির্মিত হয়েছে। দূর্গের প্রবেশ পথ সপ্ত দ্বারবিশিষ্ট। অর্থাৎ দূর্গে প্রবেশ করতে সাতটি দুয়ার রয়েছে অতিক্রম করতে হয় । দরজাগুলি বিভিন্ন শৈলী দ্বারা অলঙ্কৃত করা হয়, কিন্তু প্রত্যেকটি একে অপরের থেকে স্বতন্ত্র অলঙ্করণ।
দূর্গের স্তম্ভ এবং দেয়াল অনেক প্রতিলিপি অঙ্কিত আছে। বিশ্বাস করা হয় যে এগুলি কোনো গুপ্ত রহস্যের কোড বিশেষ।
দূর্গের সপ্ত দুয়ারের মধ্যে প্রথম ও প্রধান প্রবেশদ্বার হল সিংহ দুয়ার । দ্বিতীয় দ্বার, হল গণেশ দুয়ার। তৃতীয় দ্বারটি চন্ডী দুয়ার এবং চতুর্থ দুয়ারটি স্বর্গারোহান দুয়ার বা বুদ্ধগড় দুয়ার নামে অভিহিত হয় । এটির পার্শ্বে অবস্থান করছে একটি জলকুন্ড যা ভৈরবকুন্ড নামে পরিচিত। দুর্গটির পঞ্চম দুয়ার ভীষণই কালত্মক বা শৈল্পিক হয়ে উঠেছে এবং এর নাম হানুমান দুয়ার।
এখানে কালত্মক শিল্প শৈলী ভাস্কর্য, মূর্তি এবং চান্দেল শাসকদের সম্পর্কিত শিলালিপি পাওয়া যায়। এইসব শিলালিপি গুলিতে মূলত কির্তীবর্মণ ও মদনবর্মনের নাম পায়। পিতৃমাত্রিক ভক্ত পরম পুণ্যবান শ্রবণ কুমারের একটি কালজয়ী একটি অঙ্কন আজও হৃদয়ে আবেগ সৃষ্টি করে। ষষ্ঠ দুয়ারটি লাল দুয়ার নামে পরিচিত, এই দুয়ারের পশ্চিমে হাম্মির কুন্ড অবস্থিত। এই দুয়ারের মূর্তি , স্থাপত্য , ভাস্কর্য গুলি এলে চান্দেল শাসকগনের শিল্প প্রেমকে উদ্ভাসিত করে তোলে। সপ্তম এবং শেষ দুয়ার হল নেমি দুয়ার ,যা মহাদেব দুয়ার নামেও আখ্যায়িত হয়।
এর সাতটি দরজা ব্যতীত সাম্রাজ্য বাদী বিশেষ ধর্মে দ্বারা দূর্গ যখন আক্রান্ত হয় তখন , তারা দূর্গের উপর সম্পূর্ণ অধিকার না পেলেও যে যার মত একটি করে দুয়ার নির্মাণ করেছে , যেমন – আওরঙ্গজেব দ্বারা নির্মিত আলমগীর দুয়ার, চৌবুরজি দরজা……এছাড়াও আছে বড়া দুয়ার, বুদ্ধভদ্র দুয়ার ইত্যাদি।
পূর্বেই আমি সীতাকুন্ড ও সীতাসেজের নাম উল্লেখ করেছি। দূর্গ মধ্যে সীতাসেজ নামে একটি ছোট গুহা রয়েছে, যেখানে একটি পাথর বিছানা এবং বালিশ আছে। বনবাস কালে রাম সীতা এখানেই বিশ্রাম গ্রহণ করেছিলেন। এর নিকটেই একটি জলকুন্ড আছে যেটি সীতা কুন্ড নামে পরিচিত। এই গুহার গাত্রে তীর্থযাত্রীদের দ্বারা লেখা অনেক লিপি আছে। এখানে বুড্ডা বুড্ডির জলকুণ্ডের নামও পূর্বে উল্লেখ করেছি। কথিত আছে ,এই জলকুন্ড অতি পবিত্র ও ঔষধি গুন সম্পন্ন। শোনা যায় এখানে স্নান করলে চর্ম রোগ নির্মূল হয় ,এমনকি কুষ্ঠের মত ব্যাধিও নির্মূল করে। এখানে কালিঞ্জরশ্রুতি আছে যে চান্দেল রাজা কির্তীবর্মনের কোনো একসময় কুষ্ঠ রোগ হয়। তিনি চিকিৎসকের পরামর্শে উক্ত কুন্ডের জলে প্রত্যহ স্নান করতেন ও নিরাময় লাভ করেছিলেন।
কালিঞ্জর দূর্গে রাজা মহল ও রানী মহল নামে দুটি মহল রয়েছে আর আছে পাতাল গঙ্গা নামে এক জলাধার। পান্ডু কুন্ডে পাথর থেকে নিরন্তর জলধারা বর্ষিত হয়। কথিত আছে এখানে কখনো এক শিবকুুঠি ছিল।
সেই শিবকুঠিতে শৈব তপস্বীগন যুগ থেকে যুগান্তরে আদিদেব শঙ্করের তপস্যায় মগ্ন থাকতেন। তাদের তপভুমির নিম্ন দিয়ে পাতালের অভ্যন্তরে মা গঙ্গা প্রবাহিত হতেন। সেই গঙ্গার জলেই কুন্ড পরিপুষ্ট থাকত।
কালিঞ্জর দূর্গের সবথেকে উল্লেখ যোগ্য স্থান হল কোটি তীর্থ । এটি একটি জলকুন্ড। এর চারপাশে রয়েছে অজস্র মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন। এই জলাশয়টির নিকটে চান্দেল শাসক আমনসিংহ একটি মহল নির্মাণ করেছিলেন। তার নির্মিত এই মহলটিতে বুন্দেল স্থাপত্য শৈলী বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভাবে দেখতে পাওয়া যায় । যদিও বর্তমানে এর ধ্বংসাবশেষ ব্যতীত আর কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না ।
কালিঞ্জর দূর্গের প্রবেশ পথে বা প্রবেশদ্বার এর বাইরে ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে মোঘল দ্বারা নির্মিত একটি মুঘল প্রাসাদ দেখতে পাওয়া যায়।
আমন সিংহ দ্বারা নির্মিত সুদৃশ্য মহল আছে, মহলটির ভিতরে উদ্যান , তার দেওয়াল, স্থাপত্যশৈলী প্রত্যেকটি চান্দেল সংস্কৃতি এবং ইতিহাস কে আমাদের নিকট উদ্ভাসিত করে তোলে। দূর্গের দক্ষিণ দিকের মধ্যভাগে অবস্থান করছে এক অপূর্ব স্থাপত্য শৈলী মৃগধারা । এখানে পাথর কেটে ছোট করে দুটি কক্ষ তৈরি করা হয়েছে । তার মধ্যে একটি কক্ষে রয়েছে সাতটি মৃগের প্রস্তর মূর্তি। সেই স্থান দিয়ে অনবরত জলধারা বহমান হচ্ছে। হরিণের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে একটি পৌরাণিক কাহিনী সংযুক্ত রয়েছে। বলা হয় এই সপ্ত মৃগ হলেন সপ্তঋষি । এখানে প্রস্তর খোদিত ভৈরব ও ভৈরবীর অতীব সুন্দর মূর্তি চিত্রিত হয়েছে। যা শিল্প সৌন্দর্যের দিগন্তকে উদ্ভাসিত করে তোলে।
কালিঞ্জর দূর্গে শৈব উপাসক বড়গুর্জর শাসকেরা ভগবান দেবাদিদেব মহাদেব এর সঙ্গে অন্যান্য বিভিন্ন হিন্দু দেব দেবীর মন্দির স্থাপন করে নিজের পরিশীলিত সৌন্দর্যবোধ এবং
শৈল্পিক নৈপুণ্যতাপূর্ন রুচির উদাহরণ প্রদান করেছিলেন । এই সমস্ত মূর্তি ও মন্দির গুলোর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য যুগান্তকারী মূর্তি হল কাল ভৈরবের মূর্তি। ৩২ ফুট উচ্চতা ও ১৭ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট কালভৈরব ১৮ টি হস্ত নিয়ে, ত্রিনেত্র কে রুদ্রতেজে প্রজ্জ্বলিত করে, গলায় নৃমুন্ড ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছেন। তার ভঙ্গিমা শিল্প নৈপূন্যতায় অসম্ভব জীবন্ত হয়ে উঠেছেন। জিরিয়ার নিকট গজাসুর বধকারী মন্ডুক ভৈরবের একটি সংহার মূর্তি প্রস্তর খোদিত আছে। তার নিকট রয়েছেন মন্ডুক ভৈরবী। মনচাচরক্ষেত্রে প্রস্তর নির্মিত দেওয়ালে চতুর্ভুজা কালী, পার্বতী,দূর্গা ও একটি অপূর্ব মহিষাসুরমর্দিনীর প্রতিমা সদা অভয়প্রদান করছেন।
এখানে বহু স্থানে সৃষ্টি স্তিতি লয়ের তিন দেবতা ব্রম্ভা , বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মূর্তি খোদিত আছে। এর কিছু দূরেই ক্ষীর সাগরে অন্তত শয্যায় শায়িত ভগবান বিষ্ণুর একটি নান্দনিক ও সুবিশাল প্রতিমা অবস্থান করেছে। এছাড়া ভগবান শিব, কামদেব, চন্দ্রানী ইত্যাদি অপূর্ব প্রস্তর নির্মিত মূর্তি শৈলী এখানে অবস্থান করছে।
যেহেতু কালিঞ্জর কেবল চান্দেল নয় বরং একটি যুগান্তরের দূর্গ এবং যুগে যুগে বহু সাম্রাজ্যের মধ্যে অবস্থান করছে ..তাই এখানে শিল্প , স্থাপত্য , ভাস্কর্য ইত্যাদি বিভিন্ন সময়ের ছোঁয়া পেয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এখানে যখন শৈব মতালম্বী বরগুর্জর শাসকরা শাসন করতেন তখন এই সুপ্রাচীন প্রস্তর দূর্গের বহু স্থানে বিভিন্ন শৈব মূর্তি ,নন্দী ,ভরিঙ্গি, শিব লিঙ্গ, নানা শৈব উপাখ্যান প্রস্তর খোদিত হয়ে নির্মিত হয়েছিল। এই সব শৈব মুর্তিগুলির মধ্যে তান্ডব মূর্তি , নৃত্যরত শিব পার্বতীর মূর্তি অতীব নান্দনিক ও প্রশংসনীয়।
ক্রমশ:
দুর্গেশনন্দিনী