জন্মাষ্টমী ভারতাত্মাকে জানার উৎসব

 আঁধারঘন অমাবস্যা নিশি। শেষ রাতের আকাশে উঁকি মারে প্রতিপদের বাঁকা চাঁদ। দিব্য আলোকে কেমন যেন। জ্বলজ্বল প্রকৃতি। এক হৃদয়হরা আনন্দের আভাস চারিদিকে। অন্ধকারের পরেই আছে আলোর দেশ—- এ যেন তাঁরই আগমনীবার্তা। অশুভশক্তি, অধম আর দুর্নীতিতে যখন চারিদিকে নামে অন্ধকার তখনই আলোয় আলোয় জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে তার আবির্ভাব। যুগে যুগে একই সে লীলায় চারিদিকে পুলক, হিল্লোল। দ্বাপরেও দেখা গিয়েছিল সেই একই লীলার অবতারণা।অধর্মের ভারে বসুধা তখন অবনত, পীড়িত। শোষণ আর নির্যাতনে জনগণ। নিষ্পেষিত। মথুরায় কংস হয়ে উঠেছে সমস্ত অশুভ শক্তির এক জ্বলন্ত । আগ্নেয়গিরি। তার লোভ ও লালসা অগ্নিময় লাভার মতোই দগ্ধ করছে। সকলকে। ধর্মনিষ্ঠ মানুষ পদে পদে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। চারিদিকে শুধুই হাহাকার। চোখের জল, আর নীরব । প্রার্থনা— এসো, প্রতিষ্ঠা করো ধর্মকে।
ভক্তের চোখের জলে টলে ভগবানের আসন। তাই তিনি অবতীর্ণ হওয়ার সংকল্প নিলেন মনে মনে। এবার অংশ নয়, পূর্ণাবতার রূপেই দেখা দেবেন। পৃথিবীকে কলুষমুক্ত করবেন। নিরপেক্ষ, নির্মোহ এবং নির্মম মানসিকতায় তিনি এবার। দুষ্টের বিনাশ, শিষ্টের পালন করবেন। এবার তার বিচারের হাত থেকে রেহাই পাবে না তার অতি আপনজনও। ধর্ম প্রতিষ্ঠার কারণে মদমত্ত নিজের কুলকেও। ধ্বংস করবেন। ধর্ম আর শান্তি প্রতিষ্ঠাই হবে তার একমাত্র লক্ষ্য। মানুষের শত্রু যারা, ধর্মের নাশক যারা তাদের সকলকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবেন। শান্ত ও রুদ্র— দুই রূপেই এবার দেখা দেবেন তিনি।
শ্রীকৃষ্ণরূপে ভগবান বিষ্ণুর আবির্ভাবের পটভূমিটি তৈরি করেছিলেন। মথুরারাজ কংস এবং চেদিরাজ শিশুপাল, দেবদ্বেষী, মানব নির্যাতনকারী এই দুজনের নানা অশুভ কর্মে মধ্যাহ্নেই নামে কৃষ্ণা-শর্বরীর গভীর আঁধার। সেই আঁধারেই তিনি দেখা দেন আলোর বর্তিকা রূপে। সেই আলোয় ভেসে যায় সকলে। সেই আলোর মধ্যেই হারিয়ে যায় কংস আর শিশুপালের মতো মানবতার শত্রু। পৃথিবীতে আবার নেমে আসে শান্তি। ধর্মের পথে মানুষ হয় অমৃত পথযাত্রী।
এবার তাঁর আবির্ভাব যেন বড়ো তাৎপর্যময়। কোনও রাজার প্রাসাদ নয়, কোনো মুনিঋষির তপোবন অথবা কোনো ভক্তদম্পতির পর্ণকুটির নয়, এবার তিনি আবির্ভূত হলেন কারাগারের অন্ধকারে।
নানা দুঃখ-যন্ত্রণা, অধর্মের নানাবিধ ক্ষণে এক ভয়ংকরের অবসানের ইঙ্গিতেই বিদ্যুৎ-চমকে প্রকক্ষিত, অবিরাম বর্ষণে মুখরিত এই ধরণী। এক নতুন জীবনের জাগানিয়া গান শোনাবেন বলেই তাঁর কামড়ে নীল সাধারণ মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই তার এবারের এই আসা। আর সে কারণেই তাঁর পার্থিব জনক-জননী দুষ্ট-অশিষ্ট অশুভ শক্তির হাতে পীড়িত মানুষের মতোই। কংস-কারাগারে শৃঙ্খলবদ্ধ। শেকল ভাঙার গান গাইবেন যিনি তিনি তাই এলেন। শৃঙ্খলিত পিতা-মাতার কোলে। সকলকে তিনি নিষ্ণাত করাবেন মুক্তির আলোক ধারায়। তাই আলোর পথযাত্রী তার আবির্ভাব নিবন্ধু আলোকহীন গভীর নিশীথে। অধর্মের রুদ্ররোষে বিশুষ্কপ্রায় ধরণীতে তিনি ঝরে পড়বেন নববর্ষার জলধারার মতো। তাই তার আবির্ভাব অবতীর্ণ হওয়ার মুহূর্তে গভীর সুষুপ্তিতে মগ্ন চারিদিক।
পিতা বসুদেব এবং মাতা দেবকীর অষ্টমগর্ভের সন্তান তিনি। তাই আবির্ভাবের তিথি হিসেবে বেছে নেন তিনি ভাদ্রের কৃষ্ণা অষ্টমীকে। কাল পঞ্জিকার একটি দিন চিহ্নিত হয়ে গেল সেদিন থেকেই পুণ্য জন্মাষ্টমী তিথি হিসেবে। ভক্তি আর প্রাণের উৎসবে। মেতে ওঠার দিন হিসেবে।
আকাশের মতোই তিনি অনন্ত, সীমাহীন, উদার এবং উন্মুক্ত। তাই আকাশের রং তার গায়ে। আকাশের মতোই সকলকে ছায়া এবং আলো দেওয়ার প্রতীক যেন তার ওই গাত্রবর্ণ। পীতবাসধারী তিনি। পৃথিবীর দুঃখভার লাঘবের জন্য তাঁর এই আসা। তাই পৃথিবীর রং-ই তাঁর গাত্রাবরণের বর্ণ। তাই বা কেন, তিনি বংশীধারী। তাঁর বাঁশিতে বাজে অনন্ত দিব্য জীবনের সুর। অবিরাম বেজে চলা সেই বাঁশি শুধু বৃন্দাবনের গোপিনীদের নয়, সমগ্র বিশ্বের ভক্ত আশ্রিত জনের কানে আজও বেজে চলে সেই একই ধারায় একই সুরে। তাই তার ওই বাঁশি দিব্য-অনন্তের প্রতীক।
শৃঙ্খল মুক্ত করার আশ্বাস নিয়ে তাঁর আবির্ভাব। তাই তার মর্ত্যে অবতীর্ণ হওয়ার মুহূর্তেই শৃঙ্খল মুক্ত হলেন মাতা দেবকী, পিতা বসুদেব। উদ্ধার করবেন। জীবজগৎকে— এমনই প্রতিশ্রুতি তার। সেই প্রতিশ্রুতি রাখতেই পিতা-মাতাকেও শিশুর পাদপ্রহারের ছলেই দিলেন শ্রীচরণের স্পর্শ।
বসুদেব পুত্র বাসুদেব তিনি। কৃষ্ণা শর্বরীতে জন্ম তাই তিনি তিনি কৃষ্ণ। সকল কলুষ হরণ করবেন বলেই শ্রীকৃষ্ণ। তিনি জন্মমুহূর্ত থেকেই জগতের। সেই কারণেই কারাগারে বেশিক্ষণ সঙ্গ দিলেন না। পিতা-মাতাকে। বাৎসল্য তাড়িত পিতা-মাতাকে কংসের রোষ থেকে রক্ষা করার জন্য তার জন্মমুর্তেই এক নির্মম সিদ্ধান্ত নিলেন। সদ্যোজাতকে বুকে নিয়ে মুগ্ধ পিতা এগিয়ে চলেন গোকুলের পথে। নন্দালয়ে। জগতের যিনি, তাঁর সঙ্গে। মায়ার বন্ধন ছিন্ন হলো যেন এভাবেই।
অন্ধকার, বর্ষণমুখরিত সেই রজনীতে বসুদেবকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল এক। শৃগাল। শেষনাগ অনন্ত তার ফণা বিস্তার করেই আতপত্রের মতোই বৃষ্টির ধারা। থেকে আড়াল করে পিতা বসুদেব এবং শিশু কৃষ্ণকে। পথে পড়ল তরঙ্গমুখর। যমুনা। কিন্তু কৃষ্ণকে বুকে নিয়ে বসুদেব যমনা তটে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই জলধারা হলো দ্বিধাবিভক্ত। গভীর জলেই অগভীর জলপথ। সেই পথ ধরেই এগিয়ে চলেন বসুদেব। সেই চলার মধ্যে অকস্মাৎ যমুনা হলো উত্তাল। উত্তাল তরঙ্গে ভেসে যাওয়ার উপক্রম। সেই তরঙ্গ বসুদেব বস্থিত বালগোপালের চরণ স্পর্শ করেই শান্ত হন। আবার সেই নিরাপদ পথ, আসলে সকলকে চরণের স্পর্শ দেবেন। বলেই তাঁর এই লীলাভিনয়।
কাউকেই বঞ্চনা নয়, নিরাশ করা নয় কাউকে। তাই বুঝি অবিরাম বৃষ্টি। তাঁর গা। এবং পা ছুঁয়ে সেই জল পড়ল ধরার বুকে। তারই মধ্য দিয়ে তাঁর স্পর্শ পেল বসুমতী। যমুনাও উত্তাল তরঙ্গবিভঙ্গে তাকে জানাল প্রণাম। গোকুলে তার প্রবেশ মুহূর্তেও অবিশ্রান্ত সেই বৃষ্টি। সকলেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তারই মধ্যে সন্তান পরিবর্তন। নন্দরানি যশোদার সদ্যোজাত কন্যা যোগমায়ার জায়গায় কৃষ্ণকে শুইয়ে কন্যাকে নিয়ে বসুদেব ফিরে এলেন কংস কারাগারে। আবার সেই আগের অবস্থা। শৃঙ্খলিত পিতা-মাতা। নবজাতিকার কান্নায় ঘুম ভাঙে প্রহরীদের। সকলে সজাগ। দ্রুত খবর যায় মথুরারাজ কংসের কাছে।
ছুটে আসেন কংস। ক্ষণিক দ্বিধা। পুত্রের জায়গায় দেবকীর কোলে কন্যা দেখে মুহূর্তের বিভ্রান্তি। তারপর সেই কন্যাকে কেড়ে নিয়ে সজোরে আছাড় শিলাতলে। কিন্তু আশ্চর্য, সে কন্যা শিলায় পড়ে আকাশগামী হয়। সেখান থেকেই অমোঘ বাণী, “তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।
এরও মধ্যে তাঁর করুণারই প্রকাশ। যার বিনাশের জন্য তার এবারের আসা, তাকেও আগে থেকে সতর্ক করা। ভ্রান্তি দূর করা। নিজেকে নিরাপদ ভেবে যাতে নিশ্চেষ্ট না থাকে তারই জন্য কংসকে এভাবে জানিয়ে দিলেন তিনি, তিনি। এসেছেন— তারই হাতে মৃত্যু হবে। কংসের। তাই এখন থেকেই তৈরি হও। শেষের সেই দিনের জন্য।
শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের এই দিনটিই সারা ভারতের ধর্মপ্রাণ মানুষ পালন করেন জন্মাষ্টমী উৎসব হিসেবে। উত্তর থেকে দক্ষিণ, সারা ভারতের মানুষ ওই দিনটি কাটান উপবাস, পূজা অর্চনা, ভজন কীর্তন এবং নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। বালক শ্রীকৃষ্ণের তৃপ্তির জন্য প্রস্তুত করা হয় বিভিন্ন খাদ্যবস্তু। সেই নিবেদিত ভোগেই হয় যেন নন্দোৎসব।
দিনটিকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন জায়গায় বসে মেলা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনের নানা মুহূর্ত নিয়ে রচিত নাটক, কীর্তন ইত্যাদি পরিবেশিত হয় গভীর নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতায়। নানা ক্রীড়া প্রতিযোগিতাও হয়। এরই অন্যতম হলো ‘দহি হান্ডি’। বহু উঁচুতে ঝোলানো দইয়ের হাঁড়ি উদ্ধার মানব পিরামিড তৈরি করে।
শুধু ভারত নয়, ভারতের বাইরেও। নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশেও জন্মাষ্টমী উৎসব হয়। ভারতের বেশিরভাগ অনুষ্ঠানের মতোই জন্মাষ্টমীও কেবল কোনো সম্প্রদায় বিশেষের অনুষ্ঠান নয়। মেলা ও উৎসবের মধ্য দিয়ে এটি হয়ে ওঠে দেশের আপামর জনগণের প্রাণের উৎসব। সকলের প্রাণের উত্তাপে । এই উৎসব শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় এক। সর্বজনীন শুভ উৎসবের।
শ্রীকৃষ্ণের পুণ্য আবির্ভাবকে কেন্দ্র করে জন্মাষ্টমীর সূচনা হলেও ব্যাপ্তির দিক থেকে এই উৎসব হয়ে ওঠে সকলের। সকলের মঙ্গলস্পর্শে ভরে ওঠে মঙ্গলঘট। আর তারই মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত ভারতের আন্তর রূপটি। জন্মাষ্টমী তাই শুধুই একটি তিথি বা উৎসব নয়, আসলে এটি। ভারতাত্মাকে জানারই এক বিরামহীন প্রয়াস।
নন্দলাল ভট্টাচার্য
(জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে প্রকাশিত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.