উত্তরাধিকারের ঢাক পেটালে তার ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে

সম্প্রতি দিল্লির নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়মে গিয়ে আমার মনে পড়ল নেহরুর মৃত্যুর পর তার স্বাভাবিক রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তাকে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসস্থান ‘তিনমূর্তি ভবনে’ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ইন্দিরা গান্ধী এই বাড়িটিকে তার বাবার স্মৃতিভবন করার ইচ্ছা প্রকাশ করে দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রীকে আটকে দেন।
এই তিনমূর্তি ভবন কিন্তু ৩০ একরের বিশাল এক ভূমিখণ্ড। যেখানে এখনও ময়ূর নাচে, ময়না গান গায়। সেটি ছিল পরাধীন ভারতে ইংরেজ সেনাবাহিনীর প্রধানের আবাসস্থল। ১৯৪৮ সালেই নেহরু এখানে প্রবেশ করেন যা কিনা চাকচিক্যে বিশালতায় তার সহকর্মী অন্যান্য মন্ত্রীদের বাসভবনের তুলনায় আকাশ পাতাল তফাতের। লক্ষণীয়, এখানে আসার আগে পর্যন্ত তার জন্য নির্দিষ্ট বাঙলোতেই তিনি থাকতেন।
অতীতের একটা অলৌকিক ক্ষমতা আছে হঠাৎ করে বর্তমানের ওপর ছায়া ফেলার। ১৯৬৪ সালে লাল বাহাদুরকে বঞ্চিত করার এই ঘটনা তেমনি ছায়াপাত ঘটাল। রাহুল গান্ধী তার নির্বাচনী বক্তৃতাগুলিতে প্রায়শই বলছেন, সেনাবাহিনী কখনই প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। সত্য ঘটনা হলো, রাহুলের বোঝা উচিত অতীতের যেমন বর্তমানকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রয়েছে। অনাগত ভবিষ্যতের ওপরও রয়েছে তার নিয়ন্ত্রণ।
২০০৪ সালে আমেথি লোকসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য রাহুল গান্ধীকে নেহরু-গান্ধী পরিবারের একজন প্রতিনিধি হিসেবেই মনোনীত করা হয়। কালক্রমে সম্পাদক ও সহ-সভাপতির পদ পেরিয়ে তিনি তার জন্য পূর্ব নির্দিষ্ট কংগ্রেস সভাপতির পদে বসেন। তিনি হলেন পারিবারিক উত্তরাধিকারী হিসেবে পঞ্চাশতম ব্যক্তি যিনি এই দলীয় সর্বোচ্চ পদে আসীন। আর আজকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ারও যে বাসনা পোষণ করছেন তা কেবলমাত্র প্রাক্তন কোনো প্রধানমন্ত্রীর পুত্র বা নাতি বা দৌহিত্র হওয়ার সুবাদে। এই সুবাদে তিনি যদি এক তরফা তার বংশ লতিকার গুণগানে মত্ত থাকেন তখন বিরোধীদেরও এটা স্বাভাবিক অধিকার জন্মায় যে সেই বংশধরের কাজকর্মের কীর্তিকাহিনির সমালোচনা করার।
কংগ্রেস দল যদি নেহরুর দূরদৃষ্টি,ইন্দিরা গান্ধীর দৃঢ়তা বা রাজীব গান্ধীর ভারতকে কম্পিউটার জমানার দিকে এগিয়ে দেওয়া নিয়ে গুণগান করতে পারেন, সেক্ষেত্রে বিরোধীরাও তাদের ভুলগুলো খুঁজে জনতার কাছে তুলে ধরবেই। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী পদ (নরসিমহা রাও, দেবেগৌড়া, গুজরাল, মনমোহন প্রমুখ ছাড়া) ৫০ বছর যদি তাদেরই বংশের কুক্ষিগত হয়ে। থাকে সেক্ষেত্রে অর্থনীতির পরিভাষায় কাজকর্মের অডিট করানো বাধ্যতামূলক। সেই কারণেই যারা নেহর গান্ধী পরিবারতন্ত্রের ওপর আরোপিত বিরোধীদের অভিযোগগুলি নিয়ে খেপে উঠছেন তারা এই পর্যালোচনা করার অধিকারটিকেই কেড়ে নিতে চাইছেন বা পক্ষান্তরে ওই বংশবাদীদের স্বপক্ষে দেওয়া আমার যুক্তিগুলিকে মান্যতা দিচ্ছেন।
এই প্রসঙ্গে বামপন্থী উদারবাদীরা অর্থাৎ তথাকথিত সামাজিক – রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা, যাদের এই পরিবার সযত্নে লালন করে এসেছে তারা এই পরিবারের বিশেষ কোনো আলোচনা ততক্ষণ পর্যন্তই মেনে নেবে যতক্ষণ তা এই পরিবারের উত্তরাধিকারীর ভাবমূর্তির পক্ষে ক্ষতিকারক হবে না।
এই সূত্রে যখনই রাহুল বা প্রিয়াঙ্কা গান্ধী তাদের আত্মীয় স্বজনদের দেশের জন্য মহান অবদানের কথা তুলে ধরেন তখন এই ধামাধরা লোকজন এ প্রসঙ্গে আরও বেশি বেশি করে শুনতে চান।
মার্কসবাদীরা নিপুণভাবে কংগ্রেসের সঙ্গে একটি অলিখিত চুক্তির মাধ্যমে দেশের সমস্ত রকমের বৌদ্ধিক চর্চা ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলিকে কবজা করে এর মাধ্যমে নেহরুর উত্তরাধিকারের গুণগান করার এক মনোমতো narrative খাড়া করেছিল। রাহুল পরিবারের ঊর্ধ্বতনদের মহিমা কীর্তন করলে এরা স্বভাবতই আহ্লাদিত হন, কেননা এঁরা পালিত।
কংগ্রেস ও বামবাদীরা পারম্পরিকভাবে তথা যোগসাজসে ভারতের ‘সাংস্কৃতিক চিন্তনের ক্ষেত্রে একটা নিজস্ব ভুবন তৈরি করেছিল যাতে মনে হয় নেহরু গান্ধী পরিবারই চিরন্তন ভারতীয় চেতনার ধারক ও বাহক। দেশব্যাপী পাঠ্যপুস্তকগুলি লেখা হতো এমনভাবে যেখানে ভারত গঠনে কেবলমাত্র এই পরিবারের ভূমিকাই শুধু উদ্ভাসিত হয়। অন্যান্য দেশপ্রেমীদের কর্মকাণ্ড থাকে উপেক্ষিত। আর এই উত্তরাধিকারকে চিরস্থায়ী করতে রাস্তা, ঘাট, স্থান, দ্রষ্টব্য প্রতিষ্ঠান, উল্লেখযোগ্য কোনো কেন্দ্র, জাতীয় গুরুত্বের যা কিছু সবই এদের নামে উৎসর্গীকৃত হয়। পরিবারটি হয়ে ওঠে জনস্মৃতিতে অক্ষয়, অমর। যে সমস্ত পোষিত উদারপন্থীরা এদের ছাতা ধরে চলতেন তারা এতদূর পর্যন্ত গেলেন যে অতীত সামন্ত্ৰতান্ত্রিক প্রথা মেনে পরিবারটিকে দেশের ‘first family’ আখ্যা দিয়ে বসলেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবীরা, সমাজসংস্কারকের দল এমনকী কংগ্রেসের সর্দার প্যাটেলের মতো মহীরুহকে পর্যন্ত দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা দেওয়া হলো। আর হ্যা, যদি বলেন তাহলে মহাত্মা গান্ধীকে কেন এখনও এত বরণীয় স্থলে রাখা হয় ? স্বার্থ, নিটোল স্বার্থ। তার নামকে ব্যবহার করে বিশেষ করে তার পদবিটা এই বংশবাদীদের খুব কাজে লাগে। অবশ্যই রাহুল বা প্রিয়াঙ্কাকে ব্যক্তিগতভাবে দোষ দেওয়া যাবেনা যে তাদের এমন পরিবারে জন্ম হয়েছে বলে। তবে তারাও যতক্ষণ মানুষ তাদের প্রশংসায় ভরিয়ে রাখছে বা তাদের পরিবারের মাহাত্মে মগ্ন হয়ে থাকছে তারা খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারতন্ত্র তার নখ দাঁত সব সময়। প্রস্তুত রাখে। তারা যেমন চাটুকারিতা ভালোবাসে কিন্তু তা থেকে বিচ্যুতি ঘটলেই শাস্তির খাঁড়া নেমে আসে। যেমন নরসিমহা রাও তার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় ছিলেন সদা অস্থির ও অপমানিত। তার মৃতদেহ পর্যন্ত দিল্লিতে সৎকার করতে দেওয়া হয়নি।
একটা কথা মনে রাখা দরকার বিরোধীদের দোষ দেওয়ার আগে পরিবারবাদীদের মনে রাখতে হবে তারাও কিন্তু কথাবার্তার ক্ষেত্রে সঠিক মাত্রাজ্ঞান রাখতে জানেন না বা রাখেন না। কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে রাহুল গান্ধী তার প্রথম বক্তব্যে বীর সাভারকারকে ব্রিটিশের পদলেহী বলেছিলেন। তিনি এই বক্তব্যে বরাবর অবিচল থেকেছেন। তার Twitterএ পাকাপাকিভাবে চিহ্নিত করা আছে। সাভারকার একজন বিশ্বাসঘাতক। ইতিহাসের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে রাহুলের জ্ঞান যথার্থই অগাধ ! সেই কারণেই বর্তমান নির্বাচিত সরকার সম্পর্কে তার নির্বোধ উচ্চারণ, ভারত একনায়কতন্ত্রের যুগে প্রবেশ করছে। তার অনুচররা মনে করিয়ে দেয় যে, ‘সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র বলতে হবে। তিনি হয়তো বোঝাতে চান একজন ব্যক্তি নেতা হিসেবে অবিমিশ্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠছেন। তার । ইতিহাস জ্ঞানে কুলোয় না যে তার ঠাকুমা যখন সারা ভারতে অসাংবিধানিক জরুরি অবস্থা জারি করার ক্ষমতা ধরেছিলেন তখন তার চাটুকার দেবকান্ত বরুয়া বলেছিলেন India is Indira, Indira is India’l feat 109 যখন গরিবি হটাও স্লোগান তোলেন তখন ৫০ বছর আগে ইন্দিরা গান্ধীর একই ধ্বনির প্রসঙ্গে দেওয়া প্রতিশ্রুতির প্রতিধ্বনি হয়। জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বিপুল যুদ্ধ হয়। এর গৌরবগান করতে গেলে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে পর্যদুস্ত হওয়ার কারণও বিশ্লেষণ করা দরকার।
ঠিক তেমনি হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে নির্মোহ আলোচনা করতে গেলে আসবেশাহবানু মামলার পরবর্তী রাজীব গান্ধীর সংবিধান সংশোধন, দেশে সলমন রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সের্স’ নিষিদ্ধ করা বা বিতর্কিত বাবরি ধাঁচার তালা খুলে দেওয়ার প্রসঙ্গ।
তর্কযুদ্ধ করতে গেলে তা নির্দিষ্ট পরিসরেই করতে হবে। সাদা কালো দুটিকেই স্পষ্টভাবে মানুষের কাছে নিয়ে আসতে হবে। তাই নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন দীর্ঘদিনের নেহরু গান্ধী পরিবারের বহতা বংশবাদের ধারা নিয়ে বিতর্ক চলার পর্যাপ্ত যুক্তি থেকেই যায়।
বৈভব পুরন্দরে
(লেখক টাইমস অব ইন্ডিয়ার কলাম লেখক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.