সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল ২০১৬ নিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে জনগণের একাংশের অসন্তোষ ছিলই, থাকবেও, কিন্তু এখন প্রতিবাদ-আন্দোলন যেন একটা মাত্রাছাড়া রূপ নিচ্ছে। সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির মতে, কিছু ইসলামি সংস্থা নিতান্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই এই বিলের বিরোধিতায় তৎপর হয়েছে, তারাই প্রতিবাদী শক্তিগুলিকে টাকা কড়ি দিয়ে সাহায্য করছে এবং উস্কে দিচ্ছে । ওই সব সংস্থাতে আবার সংশ্লিষ্ট প্রদেশের মূল বাসিন্দারাই প্রতিনিধিত্ব করছেন।
সম্পদশালী সংস্থা অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, যার নেতা সুগন্ধী সম্রাট মৌলানা বদরুদ্দিন আজমল, অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু) এবং আরো বেশ কিছু ইসলামি সংস্থা খোলাখুলি ভাবেই এই বিলের বিরোধিতা করেছে। এই বিল সেই সব হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিস্টান, জৈন এবং পার্সি মানুষদের পক্ষে ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়া অনেক সহজ করে দিয়েছে, যারা বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে নির্যাতন এড়াতে ভারতবর্ষে পালিয়ে এসেছেন।
সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলির সন্দেহ দৃঢ় হয় যখন তারা সোশ্যাল মিডিয়াতে এই বিল নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী পোস্টের হদিশ পান। এই পোস্টগুলির মূল উদ্দেশ্যই ছিল সেখানকার মূল নিবাসীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে তাদের পরিচালিত করা। এছাড়াও, উত্তরপূর্বের নিবাসীদের মনে ভারতীয় মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার যে যন্ত্রণা রয়েছে, তাকে পরোক্ষ ভাবে বাড়িয়ে দেওয়াও ছিল এই পোস্টগুলির উদ্দেশ্য।
তদন্তে জানা গেছে যে, এই পোস্টগুলির বেশিরভাগই পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে করা হয়েছে। যে সব টুইটার হ্যান্ডেল থেকে এই বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো হয়েছে সেগুলিও পাকিস্তান থেকেই চালনা করা হচ্ছিল। শয়ে শয়ে নকল ফেসবুক অ্যাকাউন্ট তৈরি করা হয়েছে গত এক মাসে এবং পাকিস্তান ও মধ্য প্রাচ্যের কম্পিউটার থেকেই যে সেগুলিকে চালনা করা হয়েছে, তা তাদের ইউআরএল থেকেই বোঝা গেছে। একজন বরিষ্ঠ আই বি আধিকারিক বলেন, গুজব ছড়ানোর কাজও চালাচ্ছে তারাই। আই বি একটি নির্দিষ্ট নকশাও আবিষ্কার করেছে। এই পোস্টগুলির তথ্য কিছু টুইটার হ্যান্ডেল এবং কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্ট থেকে ব্যাপক ভাবে উত্তরপূর্বের দিকে ছড়ানো হয়েছে এবং নাগরিকত্ব বিল-বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলির নেতারা সেই ভুল তথ্যগুলিকে আবার ব্যাপক হারে সেখানকার মূল নিবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এইভাবে এই বিভ্রান্তিমূলক তথ্য খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়েছে, জানান সেই বরিষ্ঠ আধিকারিক।
উদাহরণ স্বরূপ তিনি বলেন, মাস খানেক আগে পাকিস্তানে অবস্থিত কিছু হ্যান্ডেল থেকে কিছু টুইট ছড়ানো হয়। তাতে বলা হয়, এই বিল পাস হলে উত্তর পূর্ব ভারত হয়ে দেড় কোটিরও বেশি বাংলাদেশি হিন্দু ভারতে প্রবেশ করবে এবং তারা এসে ভারতীয় নাগরিকত্ব পেয়ে যাবে। টুইটগুলি ব্যাপক হারে শেয়ার করা হয় এবং অসম ও উত্তর পূর্বের বিভিন্ন সংস্থার নেতারাও এই মিথ্যে তথ্য পরিবেশন করতে থাকেন। একজন আই বি আধিকারিক জানান, কোথায়, কীভাবে, কারা এই ধরনের বিভ্রান্তিমূলক তথ্য বানাচ্ছেন ও ছড়াচ্ছেন এবং কীকরে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই সেই সব তথ্য চারিদিকে ব্যাপক হারে ছড়িয়েও পড়ছে তার একটি নির্দিষ্ট ছকের সন্ধান তাঁরা পেয়েছেন।
তবে যেটা সবচেয়ে আশ্চর্যজনক তা হল, বিলের প্রতিবাদের ঘটনাপ্রবাহ একেবারে সূচনা থেকেই কেমন করে বিজেপি-বিরোধী ঘটনায় পরিণত হল। গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে কিছু প্রতিবাদ তো একদম ভারত-বিরোধী রূপ নেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, অসমের উপরের দিকে ছাবুয়া নামক একটি স্থানে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে একটি সংস্থা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের আয়োজন করে । এই ছাবুয়াতে আমাদের বিমান ও সেনাবাহিনীর বেস ক্যাম্প রয়েছে। বিক্ষোভকারীরা “ ভারতীয় সেনা বাহিনী ফেরত যাও” স্লোগান দিচ্ছিল। অসমের একজন পুলিশ আধিকারিকের কথায়, “আমরা তখনই সন্দেহ করি, বিল-বিরোধী আন্দোলন ভারত-বিরোধী শক্তিদের কব্জায় চলে গিয়েছে এবং তাকে ভারত-বিভাজন চক্রান্তের অংশ হিসেবে চালনা করার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
যে সব সংস্থার বিরুদ্ধে এই ধরনের বিভ্রান্তিমূলক প্রচার চালানোর অভিযোগ রয়েছে তার অন্যতম হল কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি, যার নেতা বহু বিতর্কিত এখিল গোগোই। গোগোইকে একজন মারক্সিস্ট হিসাবে পরিচিত এবং তাঁর সঙ্গে মাওবাদীদেরও সম্পর্ক রয়েছে বলা হয়। সিটিজেনশিপ বিল পাস করা হলে অসমকে ভারত থেকে পৃথক করার ডাক দিয়েছিলেনগোগোই। অসমের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা এবং আরও অনেকেই অবশ্য গোগোইয়ের বিরুদ্ধে ভারত-বিরোধী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই বিলের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মিথ্যে প্রচার করার অভিযোগ এনেছেন। সুশীল সমাজের কিছু নেতাও গোগোইকে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলের ব্যাপারে বিভ্রান্তি সৃষ্টির দায়ে অভিযুক্ত করেছেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রী শর্মা বলেছেন যে, ইসলামি সংস্থা এবং এ আই ইউ ডি এফ-এর মতো রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যই বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনে নেমেছে। তিনি বলেছেন, “যদি আসামে এখন বসবাসকারী বাংলাদেশি হিন্দুদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ চলে যায়, কিছু না হলেও রাজ্যের ১৭ টি বিধানসভা কেন্দ্রে মুসলমান প্রার্থীরা জিতে যাবেন। কারণ সেক্ষেত্রে নয় মুসলমানরা সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাবে, নয়তো তাদের সংখ্যা ৪০ শতাংশের বেশি হয়ে যাবে। এটাই এ আই ইউ ডি এফ চাইছে এবং সে জন্যই তারা বিলের বিরোধিতা করছে ও টাকাপয়সার জোগান দিয়ে এই বিরোধিতা চালিয়ে যাওয়ার রসদ জুগিয়ে যাচ্ছে। অসম অচিরেই আরেকটি কাশ্মীরে পরিণোত হবে এবং শেষমেষ অসমের মাটি থেকে অসমীয় হিন্দুরাই বিতাড়িত হবেন।“
বিল-বিরোধী এই মিথ্যে প্রচারের বিরুদ্ধে খুব শীঘ্রই একটা প্রচার অভিযান চালানো হবে বলে জানিয়েছেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তিনি বলেন, আমরা এই বিলের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াচ্ছি। আমরা মানুষজনকে জানাচ্ছি যে, এই বিল পাশের ফলে বাংলাদেশ থেকে নতুন করে কোনও বাংলাদেশি হিন্দু আসবেন না। যদি আমরা অসমকে আরেকটি কাশ্মীরে পরিণত করতে না চাই তবে অসমীয়দের অবশ্যই এই বিলটিকে সমর্থন করা দরকার। বাঙালি হিন্দুরা নয়, বাঙালি মুসলমানদের থেকেই অসমীয়দের আসল বিপদ। বিপদের মুখে আজ অসমীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং পরিচয়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই, বাংলাদেশি মুসলমানেরা এই বিল নিয়ে যারপরনাই অখুশি।
অসমের স্বাস্থ্য মন্ত্রী এও বলেন যে, সিটিজেনশিপ বিলের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়াতে সবচেয়ে বেশি সরব হয়েছেন মুসলমানেরা,যাদের মূল বাংলাদেশে। বাঙালি মুসলমানদের এই বিল নিয়ে সমস্যাটা ঠিক কোথায়? আমাদের নিজেদের বুদ্ধি বিবেচনা খাটিয়ে নিজেদেরকেই এই প্রশ্ন করতে হবে যে, বিলটির সঙ্গে এই সব বাঙালি মুসলমানের সম্পর্কটা কী এবং তাদের কাছে বিলটি কেন এত মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তর হল, তারা যদি বাংলাদেশের বাঙালি হিন্দু অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরিক হওয়া থেকে এবং অসমের ভোটার হওয়া থেকে আটকাতে পারে, তা হলে পরবর্তী নির্বাচনের মধ্যে তারা রাজ্যের প্রায় ১৭ টি বিধানসভা কেন্দ্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠবে এবং খুব দ্রুতই অসম একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে পরিণত হবে বলে সতর্ক করেন শর্মা।
সেন্ট্রাল এজেন্সিরা খুব সতর্ক চোখ রাখছেন সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টগুলিতে যেখানে এই নাগরিকত্ব সংশোধন বিল নিয়ে আলোচনা চলছে। “ আমরা আর্থিক সহায়তার দিকটা খতিয়ে দেখছি। প্রাথমিক কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে যেখানে টাকার হাতবদল ঘটেছে। কিছু সংস্থা এবং কিছু লোক যারা এই বিলের বিরোধিতায় নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা জেনে বা না জেনে ইসলামিদের থেকে অর্থ গ্রহণ করেছে। “ জানান সেই আই বি আধিকারিক।
এই নাগরিকত্ব সংশোধন বিল অসমের ইসলামিদের এবং বিদেশে তাদের পৃষ্ঠপোষকদের ঘোলা জলে মাছ ধরার এবং চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার একটা সুযোগ করে দিয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে, রাজ্য সেই আচরণের বিরোধিতা করার জন্য সক্রিয় হয়েছে এবং তৎপরতার সঙ্গে বিলের ব্যাপারে বিভ্রান্তিমূলক সকল কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
2019-03-19