মোদী সরকারের ৫ বছর প্রায় অতিক্রান্ত এবং সাধারণ নির্বাচন আগত। তাই এই সময় তার পাঁচ বছরের কাজের বিশ্লেষণ আমাদের করা দরকার যাতে যুক্তিযুক্তভাবে আমরা বুঝতে পারি কেন মোদী সরকারকে পুনর্নির্বাচিত করা ভারতের জন্য আবশ্যক। মোদী তাঁর প্রথম কার্যকালে ভারতের জন্য যা করেছেন তা কি তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনোনীত করার জন্য যথেষ্ট? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজব মোদী সরকারের সাফল্য বিফলতা ও অসমাপ্ত কাজের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে।

প্রথমে আমরা বলি যে, সাধারণত ভারতের প্রেক্ষিতে এবং প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে কোনও সরকারের নিয়ম নীতির সুদূরপ্রসারী ও সঠিক সুফল পেতে ৫ বছরের অধিক সময় লাগে, তাই যে কোনও সরকারের প্রথম কার্যকালে তা সম্পূর্ণ ও সামগ্রিক রূপে প্রতিফলিত হয় না। তাই যে কোনও সরকারকে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত করা দরকার যাতে তাদের প্রণীত নীতির সম্পূর্ণ সুফল পাওয়া যায়। তাই সরকারের প্রথম কার্যকালে জনগণের দেখা উচিত সরকার জনকল্যাণমূলক ও দেশের ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের জন্য দরকারি নিয়ম নীতি প্রণয়ন করছে কিনা ও সেসব ঠিক পথে এগোচ্ছে কিনা। সেই নীতিকে প্রত্যক্ষভাবে বাস্তবায়নের সূচনা করেছে কিনা। যদি তার উত্তর ইতিবাচক হয় তাহলে সেই সরকারকে পুনরায় নির্বাচন করা উচিত যাতে তারা তাদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করে দেশের ও দশের জীবনে আমূল পরিবর্তন আনার লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করতে পারে।

এখানে আমরা উদাহরণ হিসাবে ২০০৪-এ ইউপিএ সরকারের কথা বলব যে তারা কোনও রকম বড় সংস্কারমূলক নীতি প্রণয়ন না করলেও ভাগ্যের জোরে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়, কারণ বিশ্বব্যাপী বাজারে অর্থনৈতিক তেজির দৌড় ২০০৪ থেকে চালু হয় এবং সেই স্রোত তাদের নির্বচনী বৈতরণী পার করতে সাহায্য করে। যদিও ইউপিএ সরকারের ঋণ সৃষ্টিকারী বিলাসবহুল ও ব্যয়বহুল নীতি ভারতীয় অর্থনীতিকে অত্যন্ত বিরূপভাবে প্রভাবিত করে, কিন্তু দারিদ্র্য দূরীকরণে তারা পূর্বতন সরকারের থেকে অনেকটাই বেশি সক্ষম হয়। তাই জনতা খুব সঠিকভাবেই তাদেরকে দ্বিতীয়বারের জন্য নির্বাচিত করেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তারা তাদের দ্বিতীয় সুযোগকে সম্পূর্ণভাবে অপব্যবহার করে।

মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর উত্তরাধিকার সূত্রে দুর্নীতিময় ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চলা বিত্তব্যবস্থা, গতিহীন ও দিশাহীন অর্থনীতি, ব্যাপক বাজেট ঘাটতি এবং চরম লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি লাভ করা সত্ত্বেও দ্রুতগতিতে বিভিন্ন সংস্কারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে যার সম্পূর্ণ সুফল হয়ত আগামী কিছু বছরে আমরা প্রত্যক্ষ করব। তাই এক সম্পূর্ণ অব্যবস্থা থেকে শুরু করে ভারতের আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে সঠিক পথে নিয়ে এসে দ্রুত গতিতে দেশকে সঠিক ভাবে দিশা দিতে অতি অবশ্যই মোদী সরকারকে দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া দরকার।

তবুও আমরা চুলচেরা বিশ্লেষণে যাব মোদী সরকারের কাজকর্মের আলোচনা করার জন্য, যাতে অর্থনীতি, বিদেশনীতি, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সুরক্ষা ও কূটনীতির মতো বিভিন্ন দিকে মোদী সরকার কী ঠিক ও কী ভুল করেছে তা বোঝা যায়।

প্রথমেই পর্যালোচনা করা উচিত সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে। ৫ বছর পার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও প্রচুর সমস্যার সমাধান এখনও বাকি, যেমন কৃষির সমস্যা, পরিমিত পরিমাণের চাকরির সুযোগ এবং কিছু ক্ষেত্রে আইন ব্যবস্থার শিথিলতার দায় এনডিএ সরকারকে নিতে হবেই। যদি ওই সমস্যাগুলি এনডিএ সরকারের তৈরি নয়, তবে যারা ক্ষমতাসীন তারা সেই অজুহাতে নিজেদের দায় এড়াতে পারে না।

বস্তুত এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুবছর একাধারে চরম খরা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় এবং যার ফলস্বরূপ ক্রমহ্রাসমান গ্রামীণ মজুরির হার ও গ্রামীণ ক্ষেত্রে কাজের পরিমাণ কমতে থাকে। ২০১৬ সালে ওই সমস্যা চরম আকার নেয়, কারণ আগের দুবছর টানা খারাপ বর্ষার পর সেবছর খুব দারুণ বর্ষা ও প্রাকৃতিক আনুকূল্য গ্রামীণ অর্থনীতি ও কৃষিকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করলেও ‘ঠিক নভেম্বর মাসে ‘নোটবন্দি’ চালু হওয়ায় তা ক্যাশ-নির্ভর গ্রামীণ ক্ষেত্র ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের অর্থনীতির বিকাশকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করে, ফলে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোও পিছিয়ে যায়। সরকারের গ্রামীণ ও কৃষি বিকাশের উল্লেখ্য পদক্ষেপ যেমন নিম মিশ্রিত ইউরিয়া, ‘নারেগা’তে বর্ধিত অর্থ বরাদ্দ ও অভাবনীয় ফসলবিমা যোজনা পুরোপুরি কার্যকরী হয়নি। যার জন্য নির্বাচনের কাছাকাছি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে ফসলের ন্যূনতম মূল্যে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও কৃষি ঋণ মকুবের মতো অর্থনীতিতে ক্ষতিকর ও ভোটব্যাঙ্ক ভিত্তিক অকার্যকরী পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে।

কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও এনডিএ সরকারের সন্তোষে কিছুটা হলেও খামতি আছে, কারণ তারা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই জিডিপি বৃদ্ধির হার ক্রমে বাড়তে থাকে এবং সরকারের তিন বছর সময় লাগে বুঝতে যে, দেশের জিডিপি বাড়লেও অতিরিক্ত কর্মসংস্থান সেভাবে বাড়ছে না। সরকার তখনই ওই কর্মসংস্থানের অভাব বোধ করে বা তাদের চোখ খোলে যখন বেসরকারি ক্ষেত্র তাদের পরিসংখ্যানে নোটবন্দির ফলে গ্রামীণ ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের উপর বিরূপ প্রভাবের ছবি তুলে ধরে এবং জাতিবাদী কিছু সংগঠন জাতের ভিত্তিতে কর্মক্ষেত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। গভীরে গেলে দেখা যাবে, যথাযোগ্য কর্মসংস্থানের অভাব ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জমিতে কৃষির ফলনে উন্নতির অভাব ও তজ্জনিত ক্রমহ্রাসমান কৃষি-আয় কৃষির সমস্যা ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করেছে। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে তাই কেন্দ্রীয় সরকার বস্ত্রশিল্পে নিয়োগ এবং লঘু ও মাঝারি শিল্পে অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের উপর কর ছাড় ও নানা সুবিধা প্রদান করে এবং ২০১৮ সালে তা সমস্ত শিল্পের জন্য প্রযোজ্য করে, তার পরিণাম এখনও পুরোপুরি গোচর না হলেও কিছু সুফল পাওয়া গিয়েছে, তবে কাজ এখনও অসমাপ্ত।

তবে যে ভাবে মোদী সরকার সমগ্র কর্মক্ষেত্রকে সংগঠিত করার দিকে জোর দিচ্ছেন তা ইতিবাচক, সঠিক ও প্রশংসনীয়। কোম্পানিগুলিকে ইপিএফও-র আওতায় আনা এবং তাতে তাদের উৎসাহিত করতে সরকারের তরফ থেকে আর্থিক সাহায্য এবং শিক্ষানবিশী নিয়ম পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন নিযুক্তিতে উৎসাহিত করার যথেষ্ট প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য। কিন্তু পুরো কর্মক্ষেত্রকে সুসংগঠিত করতে গেলে সাময়িকভাবে কর্মসংস্থানে ঘাটতি হওয়া স্বাভাবিক তবে অত্যন্ত কার্যকরী এই ব্যবস্থা অদূর ভবিষ্যতে প্রচুর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করবে। যদিও সুসংগঠিত করাতে মজুরির মান বেড়ে যাচ্ছে এবং যার ফলস্বরূপ শিল্পক্ষেত্রে সাময়িকভাবে কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে, তবে তা ক্ষণস্থায়ী।

এনডিএ সরকারের বড় বিফলতা এটা নয় যে, তারা বেশি কর্মসংস্থান করতে পারেনি এবং এভাবে ভাবলে তাদের কাজকে অযাচিতভাবে ছোটো করে দেখা হবে। তবে তাদের সবচেয়ে বড় বিফলতা এই–পরিসংখ্যান ভিত্তিক যাচাই করে দেখা যে, কর্মসংস্থানের বাস্তব সমস্যাটি কী এবং তার সমাধান কোথায় তা খোঁজার অনিচ্ছা ও উদাসীনতা। তাদের উচিত ছিল পরিসংখ্যান দপ্তরকে কাজে লাগিয়ে কর্মসংস্থানের অবস্থা তৃণমূল স্তরে কী পর্যায়ে রয়েছে তা বোঝা এবং তা তারা শুরুতেই করতে পারত। বর্তমানে জাতীয় সমীক্ষা কেন্দ্রের বেকারত্বের পরিসংখ্যান যদিও কিছুটা সরকারের বিফলতাকে প্রকাশ করে, তবুও কর্মসংস্থানের অবস্থা বোঝার জন্য সেটি একটি ভালো পরিসংখ্যান। এই পরিসংখ্যানকে আরও বস্তুগত ও বাস্তবায়িত করতে মোদী সরকারকে কেউ বাধা দেয়নি এবং তা সমস্ত সহায়-সম্পদ ব্যবহার করে আগেই করা উচিত ছিল। তাহলে সরকার অনেক সময় পেত কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নে।

কৃষি-গ্রাম সমস্যা ও কর্মসংস্থানের সমস্যা ছাড়াও, এনডিএ সরকার অনেক পরে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় অনাদায়ী ঋণের সমস্যাকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেয়। এটা সকল অর্থনীতিবিদ ও ব্যাঙ্কের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জানা ছিল যে, ব্যাঙ্কের প্রদত্ত যথেচ্ছ ঋণ ব্যবসায়ীরা ফেরত দিচ্ছেন না, ফলে ব্যাঙ্কগুলির হিসাবের খাতা অনাদায়ী ঋণে ভরপুর এবং তারা সকলেই ভুল হিসাবপত্র দেখিয়ে প্রকৃত ব্যাপার চাপার চেষ্টা করছে। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই সমস্যার সমাধানে ভুল পদক্ষেপ নেয়। পুনর্মুদ্রায়ন এবং ঋণের রাইট অফ প্রথমেই হওয়া উচিত ছিল এবং তারপর ব্যাঙ্কের সংখ্যা কমানো ও তার বেসরকারীকরণ করা, কিন্তু মোদী সরকার প্রথমেই তা না করে ব্যাঙ্ক ব্যুরো গঠন করে, যা অপর্যাপ্ত ও অকার্যকর প্রমাণিত হয়। দুটি বছর তাতে নষ্ট হয় এবং ২০১৭ সালে এসে প্রথমবার সঠিকভাবে মোদী সরকার সমস্যা সমাধানে কার্যকরীপদক্ষেপ নেয় যা হল, ইনসলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাঙ্করাপ্টসি কোড আইন প্রণয়ন এবং মাঝারি ও বিত্তীয়ভাবে দুর্বল রাষ্ট্রয়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে তুলে দেওয়া। তবে এটা এত দেরী করে এসেছে তাই ওই সমস্যার সমাধান মোদী সরকারের প্রথম কার্যকালে হওয়া সম্ভব নয়। তবে সমস্যার যে সঠিকভাবে সমাধানের চেষ্টা সরকার করছে সে ব্যাপারে কোনও দ্বিমত নেই। ভালো ভালো বড় অসাধু শিল্পপতি যারা ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করছিল না, তাদের কোম্পানির মালিকানা পর্যন্ত বিক্রি করে ব্যাঙ্কের ঋণ শোধে বাধ্য করেছে সরকার, যা সত্যিই অভাবনীয় এবং আশা করা যায়, ২০১৯-২০২০ অর্থবর্ষের শেষের দিকে ওই সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান সম্ভব হবে।

তাই উপরিউক্ত বিফলতাগুলির সমাধানে কিছুটা দেরিতে হলেও সরকার সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ওই তিনটি বিফলতা মোদী সরকারের অন্য সকল ক্ষেত্রে অসামান্য সফলতা ও সংস্কারকে খর্ব করতে পারবে না।

সাফল্যের দিকগুলির মধ্যে উল্লেখ্য জিএসটি প্রণয়ন ও চালু করা, আইবিসি আইন চালু করা ও তার সঠিক প্রয়োগ, আধার কার্ড প্রয়োগের মাধ্যমে ভর্তুকিসহ অন্যান্য আর্থিক সুবিধা সরাসরি ও দুর্নীতিমুক্তভাবে ব্যাঙ্কে পৌঁছে দেওয়া, এবং শতকরা ১০০ শতাংশ পরিবারে ব্যাঙ্ক খাতা খোলানো, গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছানো এবং ৯৮% পরিবারে শৌচালয় নির্মাণ। যদিও কেউ কেউ বলতে পারে যে, এগুলির আকাঙ্ক্ষিত পরিণাম এখনও পাওয়া যায়নি এবং জিএসটিতে এখন অনেক কিছু করা বাকি। তবে জিএসটি কার্যকরী করে এবং তাতে বেশ কিছু পরিবর্তন করে এটিকে একটা সুষ্ঠু জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা মোদী সরকার করেছে, যার ফলে চেকপোস্টগুলিতে আর কালো ধোঁয়া ওড়ানো ট্রাফিক লাইনের ট্রাকের দেখা মেলে না এবং জাতীয় সড়কগুলি জ্যাম মুক্ত হয়েছে।

আইবিসি নিয়মও ব্যাঙ্কগুলির ক্রমাগত দুর্নীতি রুখতে উৎসাহিত করছে এবং সেইসব তথাকথিত প্রভাবশালী শিল্পপতি যারা ব্যাঙ্কের ঋণ নেওয়ার পর শোধ দিত না এবং নানারকম দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ব্যবসা করত তাদেরকে নিজের ব্যবসা বিক্রি করে ব্যাঙ্কের দেনা শোধে বাধ্য করেছে। আগে যেখানে প্রাইভেট কোম্পানির লোকসানকে সরকার মাফ করে দিয়ে জাতীয়করণ করত এবং সরকারের মুনাফাকে বেসরকারীকরণ করত ব্যক্তিগত স্বার্থে, সেখানে আইবিসির যুগে আজ শিল্পপতিদের নিজস্ব লাভজনক শিল্প বেচতে বাধ্য করছে, না হলে তাদের ইচ্ছাকৃত আর্থিক দুর্নীতির জন্য তাদের শাস্তি পেতে হচ্ছে। ব্যাঙ্কগুলির হিসাবের খাতা ঠিকঠাক করে পুনর্মুদ্রায়ন হচ্ছে এবং ব্যাঙ্কগুলিকে ঋণ আদায়ে আরও আইনি ক্ষমতা ও বেনিয়মের জন্য চরম শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তাই ব্যাঙ্কগুলির তরফে হিসাবশাস্ত্রের ফাঁকফোকরের মাধ্যমে আনাদায়ী ঋণকে গোপন করার চেষ্টা হলেও কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার।

অর্থনীতির দিক থেকে দেখতে হলে, নির্বাচনকালীন আর্থিক প্রতিশ্রুতি ও বিনামূল্যের সুযোগসুবিধা সত্ত্বেও ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট উন্নতির দিকে এবং মুদ্রাস্ফীতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এই জায়গায় পৌঁছতে ইউপিএ সরকার কখনও সফল হয়নি যদিও বিশ্ববাজারের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তাদের বৈতরণী পার করে দিয়েছিল। অর্থনীতিতে ঘাটতি সমস্যার জন্য শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ কিছুটা অল্প থাকলেও মোদী সরকার সর্বতোভাবে কাঁচা তেলের উপর থেকে পাওয়া অতিরিক্ত করকে পরিকাঠামো তৈরির কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে, যার ফলে জাতীয় সড়ক ও গ্রাম সড়ক তৈরি, মেট্রোরেল তৈরি, রেলের আধুনিকীকরণ এবং প্রচুর পরিমাণে ইন্টারনেটের কেবল সম্প্রসারণের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়েছে, যার কিছু অসমাপ্তও রয়ে গেছে। এখন বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে খুব তাড়াতাড়ি পুনরুজ্জীবন সম্ভব, কারণ আইবিসির মাধ্যমে পুরোনো মালিকানা থেকে নতুন মালিকানার কাছে ব্যবসা হস্তান্তর ও ব্যাঙ্কের হিসাবের খাতা ঠিকঠাক করা সম্ভব।অর্থনীতিতে এখন শুধুমাত্র উদ্বেগের জায়গা হল রপ্তানি শিল্প। রপ্তানি শিল্পের পুনরুজ্জীবনে সরকারকে কৃষির ফসল রপ্তানিতে আরও ছাড় দেওয়া ও ভারতীয় কারিগরি তথা উৎপাদন শিল্পকে উন্নতমানের ও প্রতিযোগিতামূলক করার উপর জোর দেওয়া দরকার। কৃষির সংস্কারকে মোদী সরকারের দ্বিতীয় পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কাজ হিসাবে দেখা প্রয়োজন।

আরেকটি কারণে মোদী সরকারের অর্থনৈতিক নীতির সমালোচনা করা উচিত কারণ যথেষ্ট পরিমাণ সরকারি সংস্থাকে তারা বেসরকারীকরণ করতে পারেনি। ব্যয়বহুল ও লোকসানকারী সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া ও বিএসএনএল এবং আরও অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সরকারের কাছে এক অর্থনৈতিক বোঝা হয়ে রয়েছে যেখানে সেই পয়সাকে সুষ্ঠুভাবে অন্য সামাজিক পরিকাঠামো নির্মাণে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু মোদী সরকার যথাযথ ভাবে ঐসব সংস্থা পুরোপুরি বিক্রি করার উপরে জোর দেননি। ২০১৮-তে এয়ার ইন্ডিয়ার মালিকানা সম্পূর্ণ হস্তান্তর এগোয়নি শুধুমাত্র অযৌক্তিক পরিকল্পনার জন্য। নতুন সরকার নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত ওই বেসরকারীকরণ ফাইল বন্দি হয়ে থাকবে।

সামাজিক সংস্কারের দিক থেকে মোদী সরকারের সবচেয়ে বড় কাজ ঘরে ঘরে ব্যাঙ্কিংসহ বিমা পরিষেবা পৌঁছে দিয়ে বিত্তীয় অন্তর্ভুক্তিকরণের কাজকে ব্যাপক ভাবে প্রসারিত করা। জন ধন যোজনার সাফল্যের পর এবার স্বাস্থ্যবিমা ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে পেনশনের ব্যবস্থাকেও সুদৃঢ় করতে সরকার উদ্যোগী যা আয়ুষ্মান ভারত যোজনা ও প্রধানমন্ত্রী শ্রমযোগী মানদান যোজনা বলে পরিচিত। তাছাড়া গরিব পরিবারে ঘরে ঘরে বিনামূল্যে রান্নার গ্যাস পৌঁছনোর ফলে মহিলাদের স্বাস্থ্যের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। সমস্ত গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর কাজ হওয়ায় জীবনের ব্যাপক মানোন্নয়ন হয়েছে এবং পুরোপুরিভাবে কাঠ ও কেরোসিনের উপর নির্ভরতা কম হওয়ায় ভর্তুকির পয়সা অন্য কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছে। প্রথমবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ঘরে ঘরে শৌচালয় বানানোকে নিজস্ব ব্যক্তিগত গুরুত্বের মধ্যে নিয়ে এসেছেন এবং হু (WHO)-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী খোলা জায়গায় শৌচকর্ম করা বন্ধ হয়েছে এবং ২০১৯-এর অক্টোবরে যখন স্বচ্ছ ভারতের কাজ ১০০ শতাংশ পূর্ণ হবে তখন প্রায় ৩০০০০০ বাচ্চাকে জন্মকালীন বিভিন্ন ব্যাধি ও অপুষ্টি থেকে মুক্ত করা সম্ভব হবে।

বৈদেশিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে মোদী সরকারের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। বিশ্বের দরবারে ভারতকে দেখার ধারণা সম্পূর্ণরূপে বদলে গিয়েছে। ভারতের কূটনীতি দেশকে আজ FISSILE MATERIAL CUTOFF TREATY-এর দেশগুলির সদস্য হতে সাহায্য করেছে। তবে আমেরিকার নেকনজর সত্ত্বেও ভারতকে নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপে প্রবেশে বাধা দিচ্ছে চিন। ভারতের কূটনীতিতে বারংবার বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে চিনই এবং পাকিস্তানের সঙ্গে তার মিলিত প্রয়াস ভারতের সবচেয়ে ক্ষতি করতে পারে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রক্ষণমূলক বাণিজ্যিক নীতি চিনকে বাধ্য করেছে ভারতের বিরুদ্ধে আগ্রাসনী ভাবকে কম করতে যার ডোকলামে ভারতের কূটনৈতিক সাফল্যে দেখা গেছে। কিন্তু ভারতেরও উচিত ক্রমাগত সামরিক শক্তি ও কূটনৈতিক সমর্থন এমনভাবে বৃদ্ধি করা যাতে চিন তার আগ্রাসী নীতি থেকে দূরে থাকে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে মোদী সরকার সবচেয়ে আক্রামক ভূমিকা নিয়েছে এবং বারংবার জঙ্গিদের তথা পাকিস্তানকে উপযুক্ত ভাষায় জবাব দিয়েছে। জবাবটা আগের অন্যান্য সরকারের থেকে অনেক বেশি জোরালো হলেও পাকিস্তান-সমস্যার পুরোদস্তুর সমাধান কিন্তু এখনও হয়নি। তবে অন্ততঃ এইটুকু বোঝা গেছে যে, এই সরকারের নীতিতে দাঁতনখ আছে এবং এক অনবদ্য শক্তির পরিচয়ও বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হয়েছে।

জম্মু-কাশ্মীরের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে পিডিপির সঙ্গে বিজেপির ‘পরীক্ষামূলক’ সরকার গঠন বিফল পদক্ষেপ প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এখন কেন্দ্রীয় সরকার একেবারে সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছে কাশ্মীরে রাজ্যপালের শাসন জারি করে। সরকার অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে জঙ্গিদমনের কাজ করে চলেছে যাতে কাশ্মীরে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করা যায়। জঙ্গিদের প্রতি নরম মনোভাবাপন্ন পিডিপি ও মেহবুবা মুফ্‌তির উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার নিঃসন্দেহে মোদীর এক সঠিক পদক্ষেপ।

উত্তর-পূর্ব ভারতকে মূলধারায় আনতে মোদী সরকারের অবদান ও সাফল্য অনস্বীকার্য। তবে বর্তমানে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধির জন্য উত্তর-পূর্ব ভারতে ক্ষণস্থায়ী কিছু বিবাদ রয়েছে; ওই বিল বাংলাদেশত্যাগী অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠদের দ্রুত নাগরিকত্ব প্রদানে সহায়ক হবে, কিন্তু স্থানীয় ক্ষেত্রে কিছু বিভ্রান্তি ও বাইরের কিছু উস্কানি পরিবেশকে কতক বিষিয়ে তুলেছে। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিকে আলোচনার মাধ্যমে বোঝানো উচিত যে, তাদের দায়ভার সমগ্র দেশ ভাগ করে নেবে, কারণ অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা কখনই একা অসমের সমস্যা হতে পারে না। দ্বিতীয় দফার সরকারে মোদীর উচিত সমস্ত উত্তরপূর্বের রাজ্যকে এই ব্যাপারে একমত করা।

তাই মোদী সরকারকে পুনরায় নির্বাচিত করা দেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, যাতে তার শুরু করা ব্যাপক সংস্কার দেশের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে তৃণমূল স্তরে রূপান্তর ঘটাতে ও বিকাশকে সর্বজনবিদিত করতে পারে। তার জন্য আরও বেশি করে নজর দিতে হবে বিগত পাঁচ বছরের অসমাপ্ত কাজগুলির দিকেই।

তাছাড়াও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বিহীন এক সুনিয়ন্ত্রিত আইনি ব্যবস্থা, আরও দায়িত্ববান, নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র সিবিআই, রাজনৈতিক দলের তহবিলে কালো টাকার প্রবেশ রোখা, বিচারব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, বিশেষ করে বিচারক মনোনয়ন ও তাদের দায়িত্বসচেতন করে তোলা, রাজ্যগুলিকে আরও বেশী ক্ষমতা প্রদান এবং ভূমি ও শ্রম সংস্কারের মাধ্যমে আরও শিল্পোন্নতি ও উন্নতমানের কর্মসংস্থান ইত্যাদিকে বাস্তবায়িত করতে দ্বিতীয় দফায় দ্রুত গতিতে কাজ করতে হবে।

প্রথম পর্যায়ে মোদী সরকারের কাজের সাফল্য, তাদের বিফলতা ও অসমাপ্ত বা অর্ধসমাপ্ত কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের বিশ্লেষণ করে এবং সেগুলি থেকে শিক্ষালাভ করে ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে মোদী সরকার আজ সঠিক পথে ভারতকে অগ্রসর করছে, তাই বলাবাহুল্য তাকে আরেকবার নির্বাচিত করে দেশকে আরও উন্নততর স্থানে নিয়ে যেতে আমাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করতেই হবে। আর তা যদি না করি তাহলে দেশ আরও কয়েক বছর পিছিয়ে যাবে এবং মোদী সরকারের সংস্কারকর্মের ফলে শুরু হওয়া বিকাশযাত্রা ও অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন মুখ থুবড়ে পড়বে। মনে রাখতে হবে, এক নতুন ভারতের লক্ষ্যে মোদী সরকার অক্লান্ত, অবিরাম পরিশ্রম করে চলেছে। মোদিকে পুনর্নির্বাচিত না করা তাই আমাদের নিজেদের প্রতিই শুধু নয়, উত্তরসূরীদের প্রতিও বিশাল ভুল করা হবে, যার মাশুল কয়েক প্রজন্ম ধরে আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে।

অভিজিৎ সেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.