থম বার ওজনটা কাঁধে তুলে নিল সে। কাঁধে নিয়েই বসল। কিন্তু উঠতে গিয়ে, টলে গেল সামান্য। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সাহায্যকারীরা সামলে দিলেন। ফের চেষ্টা। একই ভাবে। না, এবারেও হল না। তৃতীয় বার কোচ এসে দাঁড়ালেন সামনে। উৎসাহ দিলেন চোখে চোখ রেখে। এবার আর কোনও গন্ডগোল হল না। নিখুঁত ভাবে বিশাল ওজন কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। তার পরেই ছুট্টে গিয়ে জড়িয়ে ধরল কোচকে। একেবারে বাচ্চাদের মতো। ১৯ বছর বয়সের নিরিখে অবশ্য খুব ছোটো বলা যায় না তাকে, কিন্তু ‘ডাউন সিন্ড্রোম’ নামের ডিসঅর্ডার তার মনের বয়সকে এখনও অতটা বাড়তে দেয়নি।
সে মানালি মনোজ শেলকা। মহারাষ্ট্রের পাওয়ার লিফটার। শরীর-মনের প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে পৌঁছেছে অলিম্পিক্সের মঞ্চে। সারা দুনিয়ার সামনে চরম আত্মবিশ্বাসের পরিচয় দিয়ে, তিন বারের চেষ্টা ওজন তুলে ছিনিয়ে নিয়েছে জয়ের পদক। অবশ্য মানালির এই পদকই প্রথম বা শেষ নয়।
দেখে নিন, মানালির সেই চেষ্টা এবং সফল হওয়ার ভিডিও।
৬০টি সোনা, ৮৩টি রুপো ও ৯০টি ব্রোঞ্জ– সব মিলিয়ে ২৩৩টি পদক। হ্যাঁ, এটাই ২০১৯ আবু ধাবিতে আয়োজিত বিশেষ অলিম্পিকে ভারতের সাফল্যের খতিয়ান। বুধবার রাত পর্যন্ত পদকপ্রাপক তালিকার শীর্ষে ভারতই রয়েছে। যদিও গোটা দেশের ক্রীড়া মহলে এই অলিম্পিক্সের এত বড় সাফল্য নিয়ে তেমন হেলদোল নেই কারও।
আসন্ন আইপিএলের গ্ল্যামারে অবধারিত ভাবে ঢাকা পড়ে গিয়েছে, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা থাকা ক্রীড়াবিদদের নিয়ে আয়োজিত এই অলিম্পিক্সে ভারতের সাফল্যের কাহিনি।
১৯৬৮ সাল থেকে প্রতি চার বছর অন্তর বসে এই বিশেষ অলিম্পিকের আসর। বিশ্বের ১৭৩টি দেশ এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এই বারের অলিম্পিক্স আয়োজিত হয়েছে আরবে আবু ধাবি শহরে। এই অলিম্পিক্সে এখনও পর্যন্ত ভারত মেডেল জিতেছে অ্যাথলেটিক্স, অ্যাকোয়াটিক্স, সাইক্লিং, জুডো, পাওয়ারলিফটিং, টেবিল টেনিস, রোলার স্কেটিং, ব্য়াডমিন্টন, বাস্কেটবল ট্র্যাডিশনাল, হ্য়ান্ডবল ট্র্যাডিশনাল ও সেবেন সাইড মহিলা ফুটবলে।
এত রকমের বৈচিত্র্যপূর্ণ ইভেন্ট থেকেই এত এত পদক এনেছে ভারত। পাওয়ার লিফটার মানালি ছাড়াও, সুপ্রীত সিং, ঋষভ জৈন, প্রিয়া প্রকাশ গাবা, জীতেন্দ্র পাওয়াল-রা নিজেদের সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে দেশকে গর্বিত করেছেন এক নাগাড়ে।
কিন্তু কয়েকটি টুইট, কয়েকটি আঞ্চলিক কাগজে স্বীকৃতি। তার বেশি কিছু এই অলিম্পিয়ানরা পাচ্ছেন না বলেই তাঁদের পরিবারের অভিযোগ। পাওয়ার লিফটার মানালির বাবা যেমন বলছিলেন, “আমাদের ১৯ বছরের এই মেয়েটা এক জন প্রতিবন্ধী হওয়ার পরেও, অ্যাথলিট হিসেবে যোগ্যতার মাপকাঠিতে নিজেকে যেখানে নিয়ে গেছে, তার উপযুক্ত সম্মান পাচ্ছে কি? এক জন সাধারণ মানের ক্রিকেটারও যে আভিজাত্যপূর্ণ জীবন যাপন করেন, তার ছিটেফোঁটাও পায় না আমার মেয়ে। কোনও প্রচারই নেই!”
সকলেই বলছেন, কয়েক দিন কিছু সংখ্যক টুইটের পরেই হারিয়ে যাবেন, নিজের প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করে দেশের জন্যে সম্মান এনে দেওয়া স্পেশাল অলিম্পিয়ান সুপ্রিত, ঋষভ, প্রিয়া, মানালিরা। ঠিক যেমন ২০১৫ সালে লস এঞ্জেলেসের স্পেশ্যাল অলিম্পিক্সে অটিজমের সঙ্গে লড়াই করে, মাত্র ১৪ বছর বসের রণবীর সিং সাইনি ভারতের প্রথম সোনার মেডেল এনেছিলেন গলফে। কেউ কি তাকে মনে রেখেছে? ওই অলিম্পিক্সেই মানসিক প্রতিবন্ধী, পাওয়ার লিফটার ফুলন দেবির সোনার মেডেল পাওয়ার গল্প ও হারিয়ে গেছে।
কিন্তু হাজার কৃতিত্বের মাঝেও, এই বিশেষ ভাবে পারদর্শী ছেলেমেয়েরা জগৎসভায় ভারতের মুখ উজ্জ্বল করে চলেছে নিয়মিত। তাদের আশা, এক দিন হয়তো চিরাচরিত স্পোর্টসের দুনিয়ায় তারাও প্রবেশাধিকার পাবে! হয়তো তাদের সাফল্যেও প্রচারের চকচকে আলো ফেলবে গণমাধ্যম!