শ্রীলঙ্কায় বিধ্বংসী সন্ত্রাসী হামলায় ভারতের নিশ্চিন্ত থাকার কোনও কারণ নেই

গত সপ্তাহে শ্রীলঙ্কায় যিশুর বার্ষিক মরণোত্তর প্রার্থনা সভায় রত একটি শান্ত সমাহিত সকালকে আচম্বিতে অতি সুনিয়ন্ত্রিত অসংখ্য সন্ত্রাসী বোমা বর্ষণে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গেল। তিনটি প্রার্থনাগৃহ ও তিনটি হোটেলে এই হামলা চালানো হয়। সরকারি হিসেব অনুযায়ী ২৫৩ জন মৃতের মধ্যে ১৩ জন ভারতীয়-সহ বহু বিদেশি রয়েছেন। আরও অসংখ্য মানুষ আঘাত পেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এত বড়ো আকারের সন্ত্রাসী হামলা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় আগে কখনও ঘটেনি।
ইসলামিক স্টেট এই মারাত্মক আক্রমণের দায় নিয়েছে। অবশ্যই এদের জড়িয়ে থাকার অসংখ্য প্রত্যক্ষ প্রমাণও রয়েছে। প্রথমত বিস্ফোরণের বিশালতা, ব্যবহৃত বিস্ফোরকের পরিমাণ, সর্বোপরি উপযুপরি নানা স্থানে বিস্ফোরণের মধ্যে একটা বীভৎস খুনি মানসিকতার প্রকাশ। এছাড়া এত বড়ো মাত্রার আক্রমণ ভিন্ন দেশে গিয়ে সফল করতে গেলে যে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয় তা আই এস-এর নৃশংস জিহাদি যুদ্ধবাজরা ছাড়া কখনই অন্য কারও সংঘটিত করা সম্ভব নয়। আক্রমণকারী ‘সালাফি জিহাদিরা’ স্বঘোষিত খলিফার শাসন প্রতিষ্ঠায় এক মরিয়া গোষ্ঠী। এরা সমগ্র বিশ্বে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর।
আশ্চর্যের বিষয়, আই এস-এর এই ধরনের পাশবিক কাজ করতে আলাদা করে কোনো মানসিক অনুপ্রেরণার দরকার হয় না। তাদের কাছে পৃথিবীর অন্যান্য ধর্ম ও যারা বিশ্বব্যাপী আই এস-এর চরমপন্থী ইসলামীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কুচিন্তার পক্ষে নয় তারাই তাদের শত্রু। শ্রীলঙ্কা সরকারের তরফে বলা হয়েছে সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্ট চার্চে মুসলমানদের ওপর আক্রমণের প্রত্যাঘাত হিসেবেই এই ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। দুটি স্থানীয় ইসলামিক জঙ্গি-সংগঠন ‘ন্যাশন্যাল তওহিদ জামাত’ ও ‘জামায়েতুল মিলাসু ইব্রাহিম’-এর ওপর কড়া সরকারি নজর রয়েছে।
অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে গোয়েন্দা দপ্তরের আগাম সতর্কতা সত্ত্বেও সন্ত্রাসবাদীরা অবলীলায় হামলা চালাল। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি চাকরি থেকে অপসারিত শ্রীলঙ্কার পুলিশ প্রধান পূজিত জয়সুনন্দর গত ১১ এপ্রিল তার দপ্তরের অফিসারদের সতর্ক করে জানিয়েছিলেন দেশের গুরুত্বপূর্ণ চার্চগুলি ও ভারতীয় হাই কমিশন অফিসকে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভারতের তরফ থেকেও নিশ্চিত সন্ত্রাসবাদী হামলা ঘটার সম্ভাবনার কথা শ্রীলঙ্কা কৃর্তৃপক্ষকে আগেই জানানো হয়েছিল। এই বছর জানুয়ারি মাসেই শ্রীলঙ্কার পুলিশ একটি বন্যপ্রাণী সংগ্রহশালার আড়াল থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও ডেটোনেটর উদ্ধার করেছিল।
এখন প্রশ্ন, পূর্বাহ্নে এতটা সতর্কবার্তা থাকা সত্ত্বেও দেশের তদন্তকারী সংস্থা আক্রমণ ঠেকাতে কেন ব্যর্থ হলো? এই সূত্রে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি সিরিসেনা উদ্বেগজনকভাবে জানিয়েছেন এই ধরনের আশঙ্কার খবর সংস্থাগুলি তাকে দেয়নি। তাহলে, শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে যদি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে নির্দিষ্টবিভাগগুলির মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ না থাকে সেক্ষেত্রে পড়শী দেশ হিসেবে ভারতের কী শিক্ষা নেওয়া উচিত?
ভারত কিন্তু এই আই এস নামের জিহাদি জঙ্গি-সংগঠনের নজরে রয়েছে। বলা বাহুল্য, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ভারত এদের চক্ষুশূল। শুধু তাই নয় ভারতে যে গর্ব করার মতো বিশাল গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বিদ্যমান আই এস তারও ঘোর বিরোধী। তাদের মতে যে সমস্ত ধর্ম গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে তাদের সমূলে ধ্বংস করে ফেলতে হবে। বুঝতে অসুবিধে হয় না শ্রীলঙ্কায় অবস্থিত ভারতীয় হাই কমিশন তাই হিটলিস্টে ছিল। এই ঘটনা কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। আমাদের ইন্টেলিজেন্স ব্যবস্থাটা কিন্তু সেইভাবে এখনও সংহত নয়। অনেকগুলি তদন্তকারী সংস্থা কর্মরত রয়েছে। এরা আবার অনেক সময় পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। ফলে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার ক্ষেত্রে সম্মিলিত আগাম প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজন আছে।
এই সূত্রে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর কথা বোঝা দরকার। এই সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থাটিই দীর্ঘদিন ধরে কর্মী স্বল্পতায় ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে ভুগছে। National Technical Research Organisation (NTRO) ২০০৮ সালে যখন প্রতিষ্ঠিত হয় এর মূল লক্ষ্য ছিল গোপন খবর সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেওয়ার। কিন্তু দপ্তরটি কাজের উৎকর্ষসীমা ছুঁতে পারছে না। অন্যদিকে ২০০৮ সালে কেবলমাত্র সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ বা গতিবিধিনিয়ে খবরাখবর সংগ্রহ ও প্রয়োজনীয় তদন্ত চালানোর কাজে তৈরি হয় National Investigation Agency (NIA)। এই সংস্থার কিন্তু তেমন দম নেই। তার একটি মারাত্মক কারণ হচ্ছে রাজ্যে রাজ্যে নির্দিষ্ট তদন্ত পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা। বাধাপ্রাপ্ত হয়। রাজ্য পুলিশের কর্তারা এঁদের তদন্ত চালানোকেনাক গলানো বা অনধিকার চর্চা বলে মনে করেন। এর ভিন্ন ভিন্ন কারণ আছে সে কথা আলাদা। রাজ্য তদন্তকারী সংস্থাগুলির কাজের সক্ষমতা আদৌ উচ্চমানের নয়। অধিকাংশ লোকই হয়। সাধারণ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নয়তো ভিআইপি-দের নিরাপত্তা দেওয়ার কাজেই নিযুক্ত থাকে। কার্গিল যুদ্ধের পর ১৯৯৯ সালে মাল্টি এজেন্সি সেন্টার তৈরি হয়। এদের দায়িত্ব ছিল অন্যান্য সমস্ত তদন্তকারী সংস্থাগুলির সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটি অত্যন্ত ক্ষুরধার প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করা। কিন্তু বাস্তবে বাকি সংস্থাগুলি তাদের কাজকর্মের প্রথামাফিক রিপোর্ট পর্যন্ত এই মূল নিয়ামক সংস্থার কাছে দাখিল করার প্রয়োজন মনে করে না।
The Nat Grid নামে যে সর্বভারতীয় কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত খবরাখবর আদান প্রদান কেন্দ্র দেশব্যাপী খোলার পরিকল্পনা ২০০১ সালে নেওয়া হয়, তা ২০০৮ সাল অবধি ঠাণ্ডা ঘরেই পড়েছিল। এখনও পর্যন্ত তা পুরোদমে কাজ করার উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেনি।
The Defence Intelligence Agency (DIA) ২০০২ সালে বাজপেয়ীর আমলে চালু হলেও একজন প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত মুখ্য অধিকর্তার অভাবে এই সংস্থারও পূর্ণ সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। The National Security Council (NSC) বা জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ যার মধ্যে রয়েছে মন্ত্রীসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যরা (Cabinet Committee on Security) National Secqurity Adviser (জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা) এঁদের মধ্যে পারস্পরিক দেখা সাক্ষাৎ প্রায় হয়ই না। রাজ্যগুলির নানা ধরনের আপত্তির ফলে National Counter Terrorism Centre-এর কাজের পরিধি ও ক্ষমতা প্রায় খর্বই করে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু আসল সমস্যা হচ্ছে এই সংস্থাগুলি যে কাজই করুক না কেন তা তারা একেবারে নিজেদের নিজস্ব ঘেরাটোপের মধ্যে করে থাকে। যে এনএসএ -এর মুখ্য কোঅর্ডিনেটেরের ভূমিকা পালন করার কথা তার হাত সদাই নিজের কাজে এতই ভর্তি থাকে যে অন্যদিকে দেওয়ার মতো সময়ই থাকে না। এই কারণেই অভ্যন্তরীণ বিষয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি তাদের এপ্রিল ২০১৭ সালে দেওয়া রিপোর্টে বলেছে, “there is no single unified authority to coordinate the operation of these agencies and ensure a quick response in crisis like 26/11 ”
আই এস বর্তমানে কিছুটা দুর্বল হয়ে গেলেও সদ্য ঘটে যাওয়া শ্রীলঙ্কার নৃশংসতা প্রমাণ করল তারা যথারীতি বেঁচেবর্তে আছে। মধ্যে আফগানিস্থান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ বিশ্বের আঠারোটি দেশে তাদের শাখা সংগঠনও চালাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, এদের হাতে রয়েছে অগাধ টাকা। এবার এরা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ফিলিপাইন্স, ইন্দোনেশিয়ায় ঢুকছে, এমনকী ছোট্ট মালদ্বীপও বাদ যাচ্ছে না।
যাইহোক, পাকিস্তানের কল্যাণে ভারতে সন্ত্রাসবাদের ভয় সর্বদাই বজায় থাকবে। আর শ্রীলঙ্কার ঘটনা সতর্ক করে দিচ্ছে। আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে যে চোখ, কান খোলা রেখে সর্বশক্তিতে প্রস্তুত থাকতে হবে নইলে সর্বনাশ।
পবন ভার্মা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.