১১ই মে, ১৯৯৮ আর ২৭সে মার্চ, ২০১৯। পাশাপাশি রাখুন দুটো তারিখ।
এবার পরপর শুনুন ওই দুদিন ওই দু’জন প্রধানমন্ত্রীর, মানে অটল বিহারি বাজপেয়ি আর নরেন্দ্র মোদির কথাগুলো। মিল পাচ্ছেন কিছু! অবশ্যই পাবেন, কারণ দিনের শেষে দুজনে একটাই দেশের প্রতিনিধি যে দেশটার নাম ভারতবর্ষ। হ্যাঁ, এটা সমাপতন যে দুজনে একটাই দলের প্রতিনিধি হয়ে সংসদে পা রেখেছেন, তবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ এটাই যে ভূরাজনৈতিক চাপের কাছে ওনারা মাথা নোয়াননি – যেমনটা নোয়াতে চাননি লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, বহু বছর আগে। হ্যাঁ, নিজেদের অস্ত্রাগারে হাজার হাজার পরমাণু বোমা জমিয়ে রেখেও চীন-আমেরিকা সেদিন চায়নি ভারত পরমাণু শক্তিধর দেশ হোক। পোখরানে পরীক্ষার পরে পরেই তাই নেমে এসেছিল হাজারো আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ, প্রত্যাশিতভাবেই। অজানা ছিল না কিছুই, তবু ভয় পাননি অটল বিহারি। বলেছিলেন, আগে দেশ বাঁচুক – বাকিটা সামলে নেওয়া যাবে। সামলেও ছিলেন দক্ষ হাতে। যেমন এখন সামলাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি-সুষমা স্বরাজরা। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে চৌকিদার। ভিতরের ছেলেটা পড়ছে নিশ্চিন্তে। জানে, চোর ওর কেশাগ্র ছুঁতে পারবে না ততক্ষণ, যতক্ষণ চৌকিদারকে বাড়ি সামলানোর দায়িত্ব দিয়েছে বাড়ির লোক। অতএব ভালো রেজাল্ট অবশ্যম্ভাবী।
ঘটনা হলো প্রধানমন্ত্রীর নামের সাথে দেশ না জুড়ে দল জুড়ে দেওয়াটাই এখানে দস্তুর। কিন্তু একটি বার দেখুন ওনাদের, শুনুন মন দিয়ে। ওনারা কি সেটা করেন? করেন না। তাই একজন ভরা লোকসভায় দীপ্ত কণ্ঠে জানিয়ে দেন ‘আগে দেশ, পরে দল’ আর অন্যজন আবেগভরা কণ্ঠে বুঝিয়ে যান ‘সরকার আসবে যাবে, কিন্তু দেশটা যেন না বদলায়’।
আসলে এই তুলনাটা হয়তো আসতোই না যদি না আজ, মানে সাতাশে মার্চ, বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে আন্টি স্যাটেলাইট মিসাইলের সফল পরীক্ষা করে এলিট তালিকায় নিজের নাম না তুলতো ভারতবর্ষ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে যে কিচ্ছু লাভ নেই এসব অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়ে। কিন্তু বাস্তব হলো আগামীর ঠান্ডা লড়াইটা তেল নয়, জলের জন্যে হবে আর ভূমি বা সমুদ্র নয়, যুদ্ধক্ষেত্র থাকবে অবশ্যম্ভাবীভাবে আকাশের সীমানায়। শেষ ভারত-পাক দ্বৈতের পর অন্তত এ বিষয়ে আর বিশেষ সন্দেহ থাকাটা উচিতও নয়। বলার প্রয়োজন পরে না আজকের সফল মিশন, ‘অপারেশন শক্তি’, দেশকে অনেকটা এগিয়ে দেবে আগামীর দৈরথে। শেষ কয়েক দশকে অসাধারণ সব মাইলস্টোন ছুঁয়ে ফেলেছে ইসরো – পাঠিয়েছে নানা কাজের অজস্র স্যাটেলাইট। এবার সেগুলোর নিরাপত্তা দরকার। খুব স্বাভাবিক, পাশের বাড়ির ছেলেটার কাছে বন্দুক আছে জানলে আপনি আর গুলি চালাতে সাহস করবেন না।
এক ভদ্রলোকের কথা শোনা যায় খুব। বিজ্ঞানী ছিলেন। শোনা যায় হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আমেরিকা বোমা ফেলার পর তিনি পারমাণবিক বোমার ফর্মুলা তুলে দিয়েছিলেন রাশিয়ার হাতে। তিনি নাকি পরিবর্তে একটা টাকাও নেননি, কারণ তিনি চেয়েছিলেন আর যেন ফিরে না আসে আগস্টের ওই অভিশপ্ত সকাল দুটো।
না, ভারতকে কিনতে বা চুরি করতে হয়নি কিছু – আজকের মিসাইল ভারতেই তৈরি। তবু গল্পটা আজ প্রাসঙ্গিক কারণ দাঁড়িপাল্লায় সমতা আনতে গেলে দুদিকেই ওজন চাপাতে হয়। লাখ লাখ বছর ধরে এমনিতেই আত্মরক্ষার অধিকার জীবমাত্রের মৌলিক অধিকার।
প্রশ্ন ওঠে তাহলে কি সত্যিই যুদ্ধ চায় দেশ। উত্তর হলো না, চায় না। চাইলে অন্যভাবে এর প্রয়োগ দেখতে পেত বিশ্ব। তাছাড়া সেদিনের পোখরান টেস্ট হোক বা আজকের অপারেশন শক্তি, দেশ বরাবর স্পষ্ট করে দিয়েছে যুদ্ধ নয়, আত্মরক্ষার প্রয়োজনটাই আসল তাগিদ – আগে বা অকারণে প্রয়োগের প্রশ্নই ওঠে না। তবু প্রশ্ন তুলবে অনেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে প্রশ্নকর্তা তারাই যারা নতুন বাড়িতে ইলেকট্রিক কানেকশন করার আগে দরজায় কোলাপসেবেল গেট বসিয়ে সীমানায় পাঁচিলটা ঠিকঠাক তুলে নেয়।
কথা হচ্ছে এই সফলতার কৃতিত্ব কি শুধুই প্রধানমন্ত্রী, বা সরকারের! অবশ্যই না। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী আর কর্মীদের বাদ রেখে যারা আগে সরকারে থাকা কর্তা-ব্যক্তিদের নাম খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, বলা বাহুল্য তাদের চোখ আর পাকিস্তানি র্যাডারে কিছুমাত্র পার্থক্য নেই। তাদের অন্ধ বলেই ধরুন যেমন অন্ধত্বের বলি হিসাবে ভাবুন সেইসব চিত্তোন্মাদ লোকজনকে যারা একই সাথে পুলওয়ামায় সরকারি গাফিলতি আর অভিনন্দনে ইমরানি উদারতার সন্ধান করে। হ্যাঁ, সরকারও অল্প একটু কৃতিত্বের ভাগিদার। কিন্তু সেটা অনেক অনেক পরে আর শুধুমাত্র বিগ ব্রাদারদের লাল চোখগুলোকে ভয় না পাওয়ার সৌজন্যে। তথ্য বলছে পোখরানের(২) প্রস্তুতি শেষ হয় নরসীমা রাওয়ের আমলেই আর এই আন্টি স্যাটেলাইট মিসাইল তৈরি হয়ে গিয়েছিল ২০১২ সালে, যখন রেসকোর্স রোডের পরিবর্তে দশ নম্বর জনপথই ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় রাফায়েল থেকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বা আজকের এ-স্যাট কেন দিনের আলো দেখে নি। তাই মোদিকে বিন্দুমাত্র কৃতিত্ব না দিতে চাইলে দেবেন না, ক্ষতি নেই। শুধু ভারতীয় বিজ্ঞানীদের প্রাপ্য সম্মানটা দিন আর সেদিনের ক্ষমতায় থাকা দলকে প্রশ্ন করুন কেন সেনা থেকে বিজ্ঞানী সবাই তৈরি থাকা সত্ত্বেও সব ক্ষেত্রেই সবুজ পতাকাটা বারবার লুকিয়ে দিয়েছে ওরা। কার জন্যে? কিসের স্বার্থে!
ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন। আর ভাবনা শেষ হলে জমিয়ে রাখা প্রশ্নবান ছুঁড়ে দিন ওদের দিকে। ওরা, যারা চীনে গিয়ে মিটিং করে, আইএসআই প্রধানকে খাতির করে আর ক্ষমতার লোভে সাহায্যের হাত পাতে দেশের চরমতম শত্রুদের কাছে। মনে রাখবেন, দেশে ভালো লোকের অভাব নেই। শুধু খারাপ লোকগুলোকে চিনে নিয়ে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিলেই ‘ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’।
জয় হিন্দ
অভিরূপ ঘোষ