যুগযুগ ধরে ভারতে এক অসাধারণ জীবন দর্শন প্রবহমান যা একাত্ম ও সমগ্র। কারণ তার ভিত্তি। আধ্যাত্মিকতা। ভারত বিশ্বাস করে যে ‘সত্যে পৌঁছনোর বিভিন্ন রূপ, নাম। ও পথ থাকতে পারে। বিচিত্র হলেও এই সব পথই সমান। ভারত বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য প্রত্যক্ষ করে এবং ঐক্য স্থাপনে সক্ষম। সে বৈচিত্র্যকে পার্থক্য মনে করে না। এই আধ্যাত্মিকতা আমাদের শিক্ষা দেয় যে প্রত্যেক আত্মাই সুপ্তভাবে দিব্য এবং সেই একই দেবত্ব সমস্ত জীব ও জড় জগতে পরিব্যাপ্ত এবং তাই আমরা সকলে একে-অপরের সঙ্গে আত্মীয়তা সূত্রে আবদ্ধ। এই আত্মীয়তাকে উপলব্ধি করা, আত্মীয়তার পরিধি বাড়ানো এবং আত্মীয়তার ভাব নিয়ে। অন্যের মঙ্গলের জন্য কাজ করাই হলো ধর্মের ভিত্তি। এই ‘ধর্ম’ ‘রিলিজিয়ন’ নয়। এই ধর্ম কাউকেই বর্জন করে না, বরং তা সকলকে অন্তর্ভুক্ত ও সংযুক্ত করে এবং সকলের পক্ষে কল্যাণকর।
জীবনের এই দর্শনই ‘হিন্দু দর্শন’ এবং ভারতের অধিবাসীরা তাদের জাত, প্রান্ত, সম্প্রদায় বা ভাষা নির্বিশেষে এই জীবন দর্শনের সঙ্গে একাত্ম। তাই ‘হিন্দুত্ব’ সকল । ভারতবাসীর পরিচিতি এবং তা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছে। আর এস এসের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ হেডগেওয়ার সকল ভারতীয়র মধ্যে ঐক্য ভাবনা জাগ্রত ও উদ্দীপ্ত করতে এই হিন্দুত্বকে ভিত্তি করেন এবং সমগ্র সমাজকে এই হিন্দুত্বের সূত্রে আবদ্ধ করে সংগঠিত করতে শুরু করেন।
কিন্তু যাঁরা ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক লাভের জন্য সমাজকে টুকরো টুকরো করতে চান, তাঁরা সঙ্কে সাম্প্রদায়িক, পশ্চাদগামী, বিভেদকামী ও সংখ্যালঘু বিদ্বেষী বলে হিন্দুত্ব ও সঙ্ঘের বিরোধিতা শুরু করেছেন। হিন্দুত্বের পথিকৃৎ স্বামী বিবেকানন্দ, দয়ানন্দ সরস্বতীর মতো অনেক মহান ব্যক্তিকে একই অভিযোগে কালিমা লিপ্ত করে তাদের সুমহান কীর্তির বিরোধিতা করা হয়েছে এবং তাদের ব্রাত্য করা হয়েছে।
কিন্তু হিন্দুত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সঙ্ঘের কার্যকলাপ এদের বিরোধিতা এবং না চাওয়া সত্ত্বেও বেড়েই চলেছে ও বিস্তৃত হচ্ছে। এখন এই অশুভ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সমালোচকরা বলা শুরু করেছেন যে, হিন্দুত্ব তো ঠিক আছে কিন্তু নরম হিন্দুত্ব ও গরম হিন্দুত্বের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দের মতো পথিকৃৎদের হিন্দুত্ব নরম, কিন্তু সঙ্ঘ গরম হিন্দুত্বের অনুশীলন করে যা নিন্দনীয়। প্রথমে ‘হোয়াই আই অ্যাম নট এ হিন্দুর মতো বই এবং তারপর ‘হোয়াই আই অ্যাম এ হিন্দু এই ধরনের বই নীতিবাগীশরা লিখেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও হিন্দুত্বের স্বীকৃতি ও বিস্তৃতি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। কারণ তা ভারতের আত্মা, তার অন্তরস্থ সন্দেশ।
আবার কায়েমি স্বার্থান্বেষীরা হিন্দুইজমকে ভালো কিন্তু হিন্দুত্বকে খারাপ বলে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ানো শুরু করেছেন। এক সংবাদমাধ্যম সম্প্রতি আমাকে জিজ্ঞাসা করে ‘হিন্দুইজম’ ও ‘হিন্দুত্বের মধ্যে পার্থক্য কী? আমি তাদের বলেছি যে, তা এক ও অভিন্ন। “গোলাপ’ এবং ‘রোজ’-এ যতটুকু তফাত রয়েছে। একটি ইংরেজিতে ও অন্যটি হিন্দিতে। ড. রাধাকৃষ্ণন তার “হিন্দু ভিউ অব লাইফ’ পুস্তকে ইংরেজিতে ‘হিন্দুইজম’ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন কিন্তু তিনি যদি হিন্দিতে বইটি লিখতেন, তাহলে হিন্দুত্ব’ শব্দের ব্যবহার করতেন। যদি সাভারকর তার বই ‘হিন্দুত্ব’ ইংরেজিতে লিখতেন তবে অবশ্যই ‘হিন্দুইজম’ শব্দ ব্যবহার করতেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি যে, হিন্দুত্বের সঠিক ইংরেজি অনুবাদ “হিন্দুইজম না হয়ে ‘হিন্দুনেস’ হওয়া উচিত।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক ডাঃ মোহনরাও ভাগবতজী সম্প্রতি দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে আয়োজিত তিনদিনের বক্তৃতামালায় ‘হিন্দু ও হিন্দুত্বের’ বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু অপপ্রচারকারীরা সেটার উল্লেখ করেন না, কারণ তা তাদের অশুভ উদ্দেশ্যের সঙ্গে খাপ খায় না। প্রকৃত আদর্শগত লড়াই ভারতের দুটি ভিন্ন ধারণার মধ্যে। একটি ভারতীয় ধারণা যা ভারতের যুগপ্রাচীন আধ্যাত্মিক পরম্পরার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত এবং অন্যটি অ-ভারতীয় যার উৎস বহির্ভারত। সাংবাদিক থেকে রাজনীতিক হওয়া একজন নেতা সম্প্রতি বলেছেন যে, এই নির্বাচনে ‘হিন্দু ইন্ডিয়া’ ও ‘হিন্দুত্ব ইন্ডিয়া’র মধ্যে একটিকে পছন্দ করতে হবে। তার মতো লোকেদের হিন্দু ভারতের কথা বলার একমাত্র কারণ হলো হিন্দুত্বের ক্রমবর্ধমান প্রভাব। এটা তাদের দৃঢ় প্রত্যয়কে প্রতিফলিত করে না, বরং এতে তাদের রাজনৈতিক ভাবে ভূমিকা বদল করতে সুবিধা হয়। ভারত হিন্দুত্বের কারণে। ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় তাদের জাতপাতভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক এবং আঞ্চলিক রাজনীতির ভিত্তি দিনদিন দুর্বল হচ্ছে এবং সমর্থন হ্রাস পাচ্ছে। তাদের সস্তা রাজনীতির জন্য সমাজের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা একান্ত প্রয়োজন। যদি জাতপাত, ভাষা, আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে নাও হয়, তবে হিন্দু এবং হিন্দুত্বের ভিত্তিতে সমাজকে ভাগ করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু বর্তমানে, সাধারণ ভারতীয়রা অতটা বোকা নন যে তাদের ফাঁদে পড়বেন। তাদের গ্রহণযোগ্যতা এইভাবে প্রতিপ্রশ্নের সম্মুখীন।
বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য আরও একটি শব্দের ব্যবহার হচ্ছে সেটি হলো ‘হিন্দুত্ববাদী’ বা ‘হিন্দুবাদী। পুঁজিবাদী, সাম্যবাদী বা সমাজবাদী ধারণা বিশ্বে রয়েছে কিন্তু পাশ্চাত্যের মতো ‘ইজম’-এর কোনও স্থান ভারতে নেই। এমনকী বলপূর্বক নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের উপর চাপিয়ে । দেওয়ার এক হেজিমনিক বা আধিপত্যের প্রবণতা পাশ্চাত্যে ‘ইজম’-এর ক্ষেত্রে দেখা যায়। ভারতে কেবল হিন্দুত্ব রয়েছে। যা অধ্যাত্ম ভিত্তিক জীবনের একাত্ম ও সর্বাঙ্গীণ দৃষ্টিভঙ্গির আলোয় নিজেদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবন অতিবাহিত করা যে সমাজ তাকে ‘হিন্দু বলে। তাই ভাগ ও বিভ্রান্ত করার এই চক্রান্তকে জনসমক্ষে প্রকাশ করা এবং হিন্দুত্বের শাশ্বত দর্শন ও জীবন মূল্যকে নিজেদের আচরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করা আমাদের একান্ত কর্তব্য। এর ফলে ভারতের যে পরিচয় বিশ্বে হাজার হাজার বছর ধরে রয়েছে, তা প্রকট হবে এবং সমাজ ও জাতীয় জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে ভারতের পুরুষার্থ প্রকাশিত হবে। ‘স্বদেশ ও সমাজ’ শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন। যে, সর্বপ্রথম আমাদেরকে আমরা প্রকৃতপক্ষে যা, তা হতে হবে।
(লেখক : সহ সরকাৰ্যবাহ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ)
ড. মনমোহন বৈদ্য
2019-05-24