একটি বিস্মৃত নক্ষত্র

১৯১৯ সাল। বৈজ্ঞানিক জগতে তখন ঘটে চলেছে একের পর এক বিপ্লব। নতুন থিওরি গুলো পুরানো সব ধ্যান ধারণাগুলোকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন পৃথিবী আলোড়নকারী এক এক্সপেরিমেন্ট করে ঘোষণা দিলেন—আলবার্ট আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি থিওরি প্রমাণিত। বিজ্ঞানের জগতে যেন এক মহাযোগ্য চলছে। কেন্দ্রভূমী স্বাভাবিক ভাবেই সাদা চামড়ার মানুষদের ইউরোপ। মানুষ আইনস্টাইনকে বলতে শুরু করেছে, ” দ্য ম্যান অব এ ট্রু সায়েন্টিফিক প্রফেট”। কিন্তু তখন ভারত কোথায়? আমরা তখন পরাধিনতার ছিকল টেনে চলেছি। তার মধ্যেই সত্যেন বসু আইনস্টাইনকে ভুল প্রমাণিত করার কাজে মগ্ন। আসলে বাঙালীদের জন্মগত স্বভাব, বড় বড় শেরদেরকেও হার মানায়। সত্যেন বসুর অন্যতম কাছের বন্ধু মেঘনাদ সাহা ও তখন কিন্তু বসে নেই। সাহা ভেবে দেখলেন, আকাশের নক্ষত্রের চিহ্নিত করতে স্পেক্ট্রোসকপি নামে এক টেকনিক ব্যবহৃত হচ্ছে।

একেক নক্ষত্র, একেক ধরনের স্পেকট্রা (বর্ণালি) দেয়। সুপারমার্কেটের প্রতিটি পণ্যের জন্য যেমন নির্দিষ্ট একটা বারকোড আছে, কতগুলো কালো কালো লাইন দিয়ে যেমন প্রতিটি পণ্যকে আলাদা করা যায়, ঠিক তেমনি স্পেকট্রা হলো ফিঙ্গারপ্রিন্ট। একেকটি নক্ষত্র থেকে একেক ধরনের স্পেকট্রা পাওয়া যায়। মেঘনাদ সাহা ভাবলেন, এই স্পেকট্রার সঙ্গে তাপমাত্রার একটা সম্পর্ক আছে। তাপমাত্রার কম-বেশির সঙ্গে পরমাণুর আয়নীকরণের (আয়োনাইজেশন) সম্পর্ক নিবিড়। আর সে আয়নিকরণের সঙ্গে আছে স্পেকট্রার সম্পর্ক। তিনি সমীকরণ দাঁড় করালেন। সে সমীকরণের নাম হয়ে গেল ‘সাহা আয়োনাইজেশন ইকুয়েশন’। সেই সমীকরণ সহসাই মহাকাশবিজ্ঞানীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠল।

সাহা সমীকরণ দিয়ে নক্ষত্রের তাপমাত্রা ও গঠন সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া সহজ হয়ে গেল। সাহার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপ-আমেরিকার বিজ্ঞানী মহলে। তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে বিজ্ঞানের সবচেয়ে প্রাচীন সংগঠন রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত করা হলো। যদিও নোবেল পুরস্কারের জন্য কয়েকবার নমিনেশন পেয়েছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্য যে শেষ পর্যন্ত পুরস্কার হাতে ওঠেনি।

মেঘনাদ সাহার জন্মদিন হল ১৮৯৩ সালের ৬অক্টোবর এবং মৃত্যুদিন হল ১৯৫৬ সালের ১৬ফেব্রুয়ারি ৷ এই জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী পদার্থবিজ্ঞানে তাপীয় আয়নীকরণ তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে খ্যাত। তার আবিষ্কৃত সাহা আয়নীভবন সমীকরণ নক্ষত্রের রাসায়নিক ও ভৌত ধর্মাবলি ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হয়।
তার বাবার নাম জগন্নাথ সাহা ও মায়ের নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। মেঘনাদ তাদের পঞ্চম সন্তান ছিল। জগন্নাথ সাহা ছিলেন একজন মুদি। ছোটবেলা থেকেই তাই রীতীমতো আর্থিক অনটেনর মধ্যে তাকে মানুষ হতে হয়েছিল। গ্রামের টোলে মেঘনাদের পড়ালেখার সূচনা হয়। গ্রামটিতে তৃতীয় শ্রেণির উপরে পড়ালেখার কোনও সুযোগ ছিল না৷ কিন্তু মেঘনাদের ইতিহাস আর গণিতের সাফল্যে তার শিক্ষকেরা তাকে একটি ইংরেজি স্কুলে পাঠানোর সুপারিশ করেন এবং গ্রামের মানুষের সহায়তায় তা হয়।


সেই সময় কেউ হয়তো ভাবতে পারেন নি যে কৃষ্ণবর্ণের নীচু জাতির এই বালকটির নাম একটি সময় নোবেল কমিটির কাছে যাবে। ১৯৩০ সালে ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী দেবেন্দ্র মোহন বসু এবং শিশির কুমার মিত্র মেঘনাদ সাহাকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করেন। নোবেল কমিটি মেঘনাদ সাহার কাজকে পদার্থবিজ্ঞানের একটি উল্ল্যেখযোগ্য প্রয়োগ হিসেবে বিবেচনা করলেও এটি “আবিষ্কার” নয় বলে তিনি নোবেল পুরস্কার পান নি। মেঘনাদ সাহাকে ১৯৩৭ সালে এবং ১৯৪০ সালে আর্থার কম্পটন এবং ১৯৩৯, ১৯৫১ ও ১৯৫৫ সালে শিশির কুমার মিত্র আবারো মনোনীত করলেও নোবেল কমিটি তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে ৷

মেঘনাদ এবং সত্যেন বোস যুগ্মভাবে সর্বপ্রথম আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সহ তার বিভিন্ন নিবন্ধ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। আইনস্টাইনের ১৯০৫ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত মোট যতগুলি নিবন্ধ জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল তার সবগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ শুরু করেন মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাদের এই অনুবাদ ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রিন্সিপাল্স অব রিলেটিভিটি নামে প্রকাশিত হয়। অনূদিত বইটির ভূমিকা লেখেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। ১৯৭৯ সালে আইনস্টাইনের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে বলা হয় আইনস্টাইনের নিবন্ধগুলির প্রথম অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল জাপানে।


এই ভুল সংশোধন করে অনুষ্ঠানে উপস্থিত নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখরের চেষ্টায় আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদের স্বীকৃতি পান সাহা ও বসু। তাদের এই অনূদিত প্রিন্সিপাল্স অব রিলেটিভিটির একটি প্রতিলিপি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনস্টাইন আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। সাহা ও বসুর এই অনুবাদ সর্বপ্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ শুধু নয়, সারাবিশ্বে এটিই আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদ।

ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে বেশি দিন নিজেকে দূরে রাখতে পারেননি সাহা। একসময় রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। গবেষণা থেকে মনোযোগ কমে আসে। ভারতের বিজ্ঞান ও গবেষণাকে জোরদার করার লক্ষ্যে কাজ করতে শুরু করলেন। বিজ্ঞানের বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ছাড়াও রাষ্ট্রীয় বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে গড়ে তুললেন নিউক্লিয়ার গবেষণাকেন্দ্র। ১৯৫০ সালে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী আইরিন জুলিয়েট কুরিকে দিয়ে সেই গবেষণাকেন্দ্র উদ্বোধন করে চালু করলেন। সে প্রতিষ্ঠানের বর্তমান নাম হলো সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার রিসার্চ।


মেঘনাদ সাহাকে নিয়ে জনপ্রিয় মার্কিন তরুণ লেখক স্যাম কিন ‘একটি বিস্মৃত নক্ষত্র’ শিরোনামে একটি লেখাও লিখেছেন।
বিশ শতকের ঊষালগ্নে যে সব মনিষীরা সমগ্ৰ বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, তাদের মধ্যে মেঘনাদ সাহা ছিলেন অন্যতম। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের জগতে তার অবদান সত্যিই অনস্যিকার্য। একজন এত উন্নত মানের বিজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও তার রাষ্ট্রবাদী বিচারধারা অত্যন্ত অনুপ্রেরণাদায়ক। তাঁর এই পূণ্য জন্মলগ্নে তাঁকে সমগ্ৰ ভারতবাসীর তরফে জানাই শতকোটি প্রণাম।

Mayukh Debnath

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.